ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাইমারীর শিশুদের উপবৃত্তি লোপাটের প্রমাণ মিলেছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২১ ডিসেম্বর ২০১৬

প্রাইমারীর শিশুদের উপবৃত্তি লোপাটের প্রমাণ মিলেছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিভিন্ন উপজেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের উপবৃত্তির টাকা লোপাটের আলোচিত সেই ঘটনার প্রমাণ পেয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। কয়েকটি স্থানে অভিযোগের সত্যতা না পেলেও কয়েকটি উপজেলায় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে শিশুদের উপবৃত্তির টাকা লোপাটের প্রমাণ পেয়েছে মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি। অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরকে নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। এদিকে উপজেলা থেকে একের পর এক অভিযোগ আসা এবং ঘটনার সত্যতা পাওয়ার প্রেক্ষাপটে উপবৃত্তি বিতরণ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই কয়েকটি বিদ্যালয়ে শিশুদের উপবৃত্তির টাকা বিতরণের অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে জানিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোঃ নজরুল ইসলাম খান মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেছেন, তদন্ত হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে। আবার অনেকের বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যাদের বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া গেছে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আমরা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দিয়েছি। অনিয়ম করে কেউ পার পাবে না। অধিদফতর অবশ্যই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা নেবে। এখানে গাফিলতির আর কোন সুযোগ নেই। নজরুল ইসলাম খান জানান, যেহেতু অভিযোগ আসছে তাই এখন থেকে আমরা উপবৃত্তি বিতরণ প্রক্রিয়া শতভাগ স্বচ্ছ রাখতে বেশকিছু পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছি। যেখানে ভাল শিক্ষক-কর্মকর্তারা পুরস্কার হিসেবে বিদেশ সফরেরও সুযোগ পাবেন। জানা গেছে, এবার গত কয়েক মাস উপবৃত্তির টাকা লোপাটের ঘটনায় অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে বেশকিছুৃ জেলা ও উপজেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। মানবন্ধনসহ নানা কর্মসূচীও শুরু করেন অভিভাবকরা। জনরোষে পড়ে কয়েক উপজেলায় প্রকাশ্যে দায় স্বীকার করে টাকাও ফেরত দেন কোন কোন প্রধান শিক্ষক। তবে দুর্নীতিবাজ এসব শিক্ষকের কেবল বদলি নয় তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাসহ কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার দাবি ওঠে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। এমন এক প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে উপবৃত্তির টাকা বিতরণের অনিয়ম তদন্ত করে দায়ীদের চিহ্নিত করতে ১১ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিয়েছিল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, কর্মকর্তাদের সরেজমিনে তদন্ত করে অনিয়মের জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করে ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণে প্রয়োজনীয় সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দেবেন। প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি টাকা বিতরণে অনিয়মের বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে মন্ত্রণালয় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালায়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত যেসব তদন্ত শেষ হয়েছে তার মধ্যে কয়েকটি বিদ্যালয়ে অর্থ লোপাটের প্রমাণ মিলেছে। এখানে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অভিযোগের সত্যতা পেয়েছেন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কর্মকর্তারা। অনেক উপজেলায় অনিয়মের ঘটনা নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে অসন্তোষ আসছে। এ অবস্থায় মন্ত্রণালয় পুরো প্রক্রিয়া নতুন করে ঢেলে সাজানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ বিষয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপসহ উপবৃত্তি বিতরণ ব্যবস্থায় কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা ও ত্রিশাল উপজেলা, কুমিল্লা জেলার নাঙ্গলকোট, টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর, বরিশাল জেলার বাউফল, কাঠালিয়া, বেতাগী, ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা উপজেলা সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলায় উপবৃত্তির টাকা আত্মসাতের কোন অনিয়ম পাওয়া যায়নি। তবে সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলার জামতৈল উত্তর পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ আবু শামার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। এছাড়া কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার মেটাংঘর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম ও হোসনাবাদ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এস এম মাসুমা সারোয়ারের অর্থ আত্মসাতের চেষ্টার অসৎ উদ্দেশ্য সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলার নবগ্রাম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রানী বালা সরকারের বিরুদ্ধে অভিভাবকসহ এলাকাবাসীর আনীত অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার ৩৬নং নবগ্রাম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উপবৃত্তিপ্রাপ্ত ৩৬৪ ছাত্রছাত্রীর মাঝে এক হাজার ২০০ টাকা করে দেয়ার কথা থাকলেও প্রধান শিক্ষিকা অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে ৬০০ টাকা করে প্রদান করেন এবং বাকি টাকা তিনি আত্মসাত করেন বলে অভিভাকরা লিখিত অভিযোগ করেছেন। তদন্তের সময়েও তারা সাক্ষ্য দিয়েছেন। ছাত্রছাত্রীর অভিভাবকরা ডিজি, জেলা প্রশাসক, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার বরাবরও লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। জনরোষের পরে প্রধান শিক্ষক দায় স্বীকার করে কিছু টাকা ফেরতও দিয়েছেন। তবে তার অপসারণসসহ কঠোর শাস্তির দাবিতে অসন্তোষ বাড়ছে এলাকাজুড়ে। তদন্ত কমিটি বলছে, কুমিল্লায় জেলার মুরাদনগর উপজেলার মেটংঘর ও হোসনাবাদ গ্রামের পৃথক দুটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তুলেছিলেন এলাকাবাসী। এ নিয়ে ওই এলাকায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে। জেলার মুরাদনগর উপজেলার মেটংঘর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির ১২শ’ থেকে ৬শ’ টাকা করে কেটে রাখেন। হোসনাবাদ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মাসুমা সারোয়ারের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ ওঠে। তদন্তে তাদের অর্থ আত্মসাতের চেষ্টার অসৎ উদ্দেশ্য সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। অভিযুক্ত এ শিক্ষকদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়ে মন্ত্রণালয় তার প্রতিবেদনে বলেছে, ভবিষ্যতে উপবৃত্তির টাকা বিতরণের সময় প্রতি জেলায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর থেকে ২ কর্মকর্তার সমন্বয়ে ভিজিল্যান্স টিম গঠন করে উপবৃত্তির টাকা বিতরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। উপবৃত্তি প্রকল্পের পরিচালককে আরও সক্রিয় হওয়ার জন্য বলা যেতে পারে, যাতে প্রতি জেলায় কর্মরত মনিটরিং কর্মকর্তার স্ব স্ব দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন এবং প্রকল্প পরিচালককে আরও নিবিড়ভাবে তদারকির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মন্ত্রণালয় আরও বলেছে, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার/উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে বিতরণ কার্যক্রম তদারকির জন্য আরও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। যে জেলায় সুষ্ঠুভাবে উপবৃত্তির টাকা বিতরণ হবে, সেই জেলার কর্মকর্তাদের দেশে/বিদেশ প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। যেখানে উপবৃত্তি বিতরণে অনিয়ম হবে, সেখানের সংশ্লিষ্ট উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাসহ মনিটরিং কর্মকর্তাকে ব্যক্তিগতভাবে দায়ী করা যেতে পারে এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে বলে চিঠিতে বলেছে মন্ত্রণালয়। ১১ কর্মকর্তার প্রতিবেদন পাওয়ার পর তা পর্যালোচনা ও অনুমোদন শেষে দোষী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরে চিঠি পাঠানো হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন তৈরির সমন্বয়ক, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব নেছার আহমদ বলেছেন, অনিয়ম করে কেউ পার পাবে না। আমরা চাই যেন ভবিষ্যতে শিশুদের উপবৃক্তি নিয়ে কেউ আর অনিয়ম করার দুঃসাহস না দেখায়। তদন্তে যাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের প্রমাণ আমরা পেয়েছি তাদের বিরুদ্ধে এখন ব্যবস্থা নেবে অধিদফতর। আমরা নির্দেশনা পাঠিয়েছি। এখানে ছাড় দেয়ার কোন সুযোগ নেই। তবে অনেক এলাকায় এখনও অসন্তোষ আছে। ২৫টিরও বেশি এলাকায় অনিয়মের অভিযোগ এসেছে, অথচ তদন্তের আওতা এক কম কেন? এমন প্রশ্নে এ কর্মকর্তারা বলেন, বেশকিছু এলাকায়তো তদন্ত হয়েছে। গণমাধ্যমে অভিযোগের প্রেক্ষাপটেই তদন্ত। অনেক এলাকায় তদন্তে অভিযোগের সতত্যা মেলেনি। সতত্য না পাওয়া গেলে আইনত কিছু করার থাকে না। তবে মাঠপর্যায়ের কয়েকজন শিক্ষা কর্মকর্তারা অনেকেই বলেছেন, কয়েকশ’ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উপবৃত্তির অর্থ বিতরণে অনিয়ম হলেও তদন্ত প্রতিবেদনে তার প্রতিফলন হয়নি।
×