ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. জাকিয়া বেগম

পারমাণবিক বর্জ্য ফ্লাই এ্যাশ

প্রকাশিত: ০৫:১০, ২১ ডিসেম্বর ২০১৬

পারমাণবিক বর্জ্য ফ্লাই এ্যাশ

ফ্লাই এ্যাশ অতি ক্ষুদ্রাকৃতির কণাবিশিষ্ট এক ধরনের পদার্থ। কণাগুলো বিদ্যুত কেন্দ্রে কঠিন জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের কয়লা দহনের সময় উৎপন্ন হয়। দহনকালে কয়লায় কার্বনের ভাগ নিঃশেষিত হয়ে যায় কিন্তু সিলিকা, এ্যালুমিনা এবং ক্যালশিয়ামের বর্জ্য গলিত অবস্থায় উৎপাদিত অন্যান্য দূষিত ও ঝুলন্ত গ্যাসীয় পদার্থের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে শীতল হয়ে ওঠে ও গোলাকৃতির কণাবিশিষ্ট কঠিন বস্তুতে রূপান্তরিত হয়। পলিমাটি বা কাদামাটির কণার আয়তনবিশিষ্ট তামাটে রঙের এই কণাগুলো পাউডারের মতো খুব মিহি (০.৫ থেকে ১০০ মাইক্রোমিটার আয়তনবিশিষ্ট) এবং প্রায় একই আয়তনবিশিষ্ট হয়ে থাকে। যদিও ফ্লাই এ্যাশে বিদ্যমান উপাদান কি ধরনের হবে তা নির্ভর করে খনি থেকে আহরিত কয়লার ধরন এবং বিদ্যমান অজৈব উপাদানসমূহের ওপর তথাপি সব ধরনের ফ্লাই এ্যাশের প্রধান উপাদানই হচ্ছে সিলিকা। ফ্লাই এ্যাশে কেলাসিত এবং অকেলাসিত (স্ফটিকাকার) অবস্থায় থাকে প্রচুর পরিমাণে সিলিকন ডাই-অক্সাইড এবং ক্যালশিয়াম অক্সাইড। আর্সেনিক, বেরিলিয়াম, বোরন, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, কোবাল্ট, সীসা, ম্যাঙ্গানিজ, পারদ, মলিবডেনাম. সেলেনিয়াম, স্ট্রনশিয়াম, থেলিয়াম, ভ্যানাডিয়াম, পলিসাইক্লিক এ্যারোমেটিক হাইড্রো কার্বন (পিএএইচ), ডাই-অক্সিন ইত্যাদি পদার্থও অতি সামান্য পরিমাণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাত্রায় বিদ্যমান থাকতে পারে যেগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই বিষাক্ত ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক। উপরন্তু প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত কয়লাতে অতি সামান্য পরিমাণে তেজস্ক্রিয়তাযুক্ত পদার্থ ইউরেনিয়াম এবং থোরিয়াম থাকে যার পরিমাণ পোড়ানো কয়লা থেকে উৎপন্ন ফ্লাই এ্যাশে প্রায় ১০গুণ বেড়ে যায়। এ ধরনের তেজস্ক্রিয় উপাদান থেকে ক্যান্সারের সূচনা ঘটতে পারে, কোষকলার ক্ষতিকর পরিবর্তন বা গঠনমূলক পরিবর্তন ঘটতে পারে যা ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। কয়লা স্থাপনায় উৎপাদিত হাজার হাজার টন ‘ফ্লাই এ্যাশ’ সাধারণত স্থাপনা সংলগ্ন গর্তে বা মাটিতে স্তূপ করে রাখা হয়। কখনও কখনও মাটি ভরাটের কাজেও ব্যবহার করা হয়। এ অবস্থায় এগুলো থেকে তেজস্ক্রিয় দূষণ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে এবং নিকটবর্তী এলাকার পানি, মাটি বা শস্যক্ষেত্রকে তেজস্ক্রিয় দূষণযুক্ত করে তুলে মানুষ, জলজ উদ্ভিদ এবং প্রাণীসহ পরিবেশের জন্য তেজস্ক্রিয় ঝুঁকির কারণ হতে পারে। একটি জরিপে দেখা গেছে, কয়লাচালিত বিদ্যুত স্থাপনা সংলগ্ন এলাকার মানুষ পারমাণবিক চুল্লি সংলগ্ন এলাকার মানুষের চাইতে হয় সমান না হয় বেশি পরিমাণে তেজস্ক্রিয়তা দ্বারা সম্পাদিত হয়। কারণ, পারমাণবিক বর্জ্য অতি সাবধানতার সঙ্গে পানি বা শুষ্ক আধারে বিশেষভাবে আবদ্ধ অবস্থায় সংরক্ষণ করা হয়, অথচ কয়লাচালিত স্থাপনা থেকে বহু কিলোগ্রাম ছাই এবং ভস্ম অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় নীতিমালা অমান্য করেই পরিবেশে ছেড়ে দেয়া হয়। বর্তমানে শিল্প ক্ষেত্রেও ফ্লাই এ্যাশ বাণিজ্যিক পর্যায়ে ব্যবহার করা হচ্ছে। শুষ্ক অবস্থায় ফ্লাই এ্যাশের তেমন কোন আবদ্ধকারক ক্ষমতা থাকে না; কিন্তু পানির উপস্থিতিতে সাধারণ তাপমাত্রায় এটি ক্যালশিয়াম হাইড্রো অক্সাইডের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে আবদ্ধকারক ক্ষমতাসম্পন্ন এক ধরনের যৌগ উৎপাদন করে। এই আবদ্ধকারক ক্ষমতার জন্য ফ্লাই এ্যাশ সিমেন্ট এবং কনক্রিট তৈরির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কনক্রিট তৈরির ক্ষেত্রে ফ্লাই এ্যাশের ব্যবহার পানির প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে আনে, উপরিতলে পানি শোষণের কারণে সৃষ্ট অমসৃণতা দূর করে, অধিক কার্যক্ষমতাসম্পন্ন এবং টেকসই করে তোলে এবং কনক্রিট বা সিমেন্টের ওজন কমিয়ে এনে বৃহৎ নির্মাণ কাজে ব্যবহারের ক্ষেত্রে অধিক সহজতর করে তোলে। ‘ফ্লাই এ্যাশ’ ঘর্ষণনিবারক ক্ষমতাসম্পন্ন, তাছাড়া কণাগুলো খুব ক্ষুদ্র, গোলাকৃতি এবং শক্ত হওয়ায় এগুলো শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহৃত বিভিন্ন পদার্থের মধ্যে সৃষ্ট শূন্যস্থান পূরণে বেশ উপযোগী। কোন পদার্থ বা বর্জ্যকে কঠিন আকারে রূপান্তরিত করার কাজেও ফ্লাই এ্যাশ ব্যবহার করা হয়। ‘ফ্লাই এ্যাশে’ বিদ্যমান ইউরেনিয়াম এবং থোরিয়াম থেকে শুষ্ক অবস্থায়ও ‘রেডন’ নামক একটি বায়বীয় তেজস্ক্রিয় পদার্থ নির্গত হয়, যা বদ্ধ পরিবেশে আবদ্ধ হয়ে পড়লে সে স্থানের বাতাসকে তেজস্ক্রিয় দূষণযুক্ত করে তোলে। তাই নির্মাণ সামগ্রী তৈরিতে ফ্লাই এ্যাশ ব্যবহার করা হলে নির্মিত স্থাপনার অভ্যন্তরে ‘রেডন’-এর মাত্রা স্বাভাবিকের চাইতে বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর এ জন্য আন্তর্জাতিকভাবে আবদ্ধ স্থানে ‘রেডনের’ একটা নিরাপদ মাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য সময়ে সময়ে ‘মনিটরিং’-এরও পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। দেখা যাচ্ছে পারমাণবিক চুল্লিই যে শুধু তেজস্ক্রিয় পারমাণবিক বর্জ্যরে একমাত্র উৎস তা নয়, কয়লাচালিত বিদ্যুত স্থাপনায় উৎপাদিত ফ্লাই এ্যাশও পারমাণবিক বর্জ্যভুক্ত। অতীতে কয়লা খনি থেকে সৃষ্ট ‘ফ্লাই এ্যাশ’ কোন নিয়মনীতি না মেনেই পরিবেশে ছেড়ে দেয়া হতো। কিন্তু এর ক্ষতিকারক দিকগুলো বিবেচনায় এনে বর্তমানে এ ব্যাপারে আইন ও নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। বর্তমানে উৎপন্ন এ্যাশের মাত্র ১% পরিবেশে ছাড়ার ছাড়পত্র দেয়া হয়ে থাকে। জনসাধারণ ও পরিবেশ সুরক্ষার লক্ষ্যে কয়লাচালিত স্থাপনার ক্ষেত্রে তাই এ ধরনের নিয়মনীতি মেনে চলা খুবই জরুরী। ফ্লাই এ্যাশ সংরক্ষণ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বিশেষ সতর্ক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। লেখক : পরমাণু বিজ্ঞানী
×