ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রাজধানীর ২০ রুটে চলে দু’শ’ এমন ছোট যান;###;বিআরটিএর কাছেও হিউম্যান হলার আর লেগুনার কোন তথ্য নেই

ওস্তাদের অপ্রাপ্তবয়স্ক সাগরেদই পরে ধরে লেগুনার স্টিয়ারিং

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২০ ডিসেম্বর ২০১৬

ওস্তাদের অপ্রাপ্তবয়স্ক সাগরেদই পরে ধরে লেগুনার স্টিয়ারিং

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ রবিবার দুপুর দুটো। যাত্রীবোঝাই করে ফার্মগেট থেকে জিগাতলায় রওনা দিল ইন্দিরা পরিবহন নামে ফিটনেসবিহীন একটি লেগুনা। পেছনে যথারীতি ঝুলে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে হেলপারসহ তিন-চারজন। হেলপার বলতে আট বছরের এক শিশু। চালকের আসনে ১৫ বছরের এক কিশোর। সে এই রুটে তিন মাস আগেও ড্রাইভারের সহকারী অর্থাৎ হেলপার ছিল। মাত্র এক মাসের ট্রেনিংয়েই আজ সে পরিপক্ব ড্রাইভার! রাজধানীর বিভিন্ন রুটে নিয়মিত চলছে ফিটনেসবিহীন এমন অসংখ্য লেগুনা নামের ছোট্ট বাহন। ড্রাইভারের পাশে দু’জনসহ পেছনের দুই সারিতে ছয়জন করে মোট চৌদ্দ যাত্রী নিয়ে যাওয়া-আসার কথা থাকলেও প্রতিটি লেগুনার পেছনে কোনরকমে হেলপারের সঙ্গে ঝুলে নিত্য যাতায়াত করে আরও পাঁচ-ছয় যাত্রী। কোন কোন লেগুনার বডি এতটাই লক্কড়ঝক্কড় যে, দেখে মনে হবে চললেই খুলে বুঝি পড়বে। আবার কোনটির ড্রাইভারের পাশের দরজা দুটি দড়ি দিয়ে বাঁধার ব্যবস্থা করা, যা চলন্ত অবস্থায় যে কোন মুহূর্তে খুলে যেতে পারে। সঙ্গে আছে অদক্ষ এসব ড্রাইভারের বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর রেস। হাবিব নামে লেগুনাচালকের ড্রাইভিং লাইসেন্সও নেই। সে বলল, ‘এমনিতেই আমি ভাল গাড়ি চালাই। দুই বছর হইলো, এহন পর্যন্ত আমার হাতে কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি। আর লাইসেন্স কেউ দেখতেও চায় না।’ শুধু হাবিব নয়, এমন অনেক অপরিপক্ব লেগুনা ড্রাইভার আছে যাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দূরের কথা, ড্রাইভিং লাইসেন্সও নেই। পারিবারিক টানাপোড়েনের জের ধরেই লেগুনার ড্রাইভারের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করে হাবিব। দুই বোনসহ বাবা-মায়ের পরিবারে অর্থের অভাবে তৃতীয় শ্রেণীর গ-ি পেরোতে পারেনি সে। রিক্সাচালক বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লে বাধ্য হয়েই হাবিব কাজে নামে ১৩ বছর বয়সে। সে জানায়, ‘পরথমে (প্রথমে) ডেলি (প্রতিদিন) দেড় শ’ ট্যাকা (টাকা) পাইতাম। আর এহন (এখন) এক হাজার করে পাই।’ প্রতিটি লেগুনাচালকের শুরু তার ওস্তাদের সাগরেদ থেকেই। কেউ আর্থিক অনটনে এসেছে, কেউবা পড়ালেখাকে পায়ে ঠেলে নিজের পায়ে দাঁড়াতে এসেছে। জানা গেছে, রাজধানীতে ৬৮টি রুটে প্রায় ৬ হাজার লেগুনা চলাচল করে। এর মধ্যে ফার্মগেট থেকে মোহাম্মদপুর, জিগাতলা ও কৃষি মার্কেটÑ এই তিন রুটে ইন্দিরা পরিবহনের প্রায় ১২০ লেগুনা চলাচল করে। গাবতলী-মহাখালী রুটে ৬০, মিরপুর-মহাখালী রুটে ৭০, মোহাম্মদপুর থেকে গুলশান হয়ে বাড্ডা পর্যন্ত ৮০টির মতো লেগুনা চলাচল করে। এছাড়া নীলক্ষেত-ফার্মগেট, গোড়ান-গুলিস্তান, মিরপুর-১-জিগাতলা, মিরপুর-২-ফার্মগেট, গুলশান-১ ও মহাখালী, মিরপুর-১০-মোহাম্মদপুর, শিয়া মসজিদ, গুলিস্তান থেকে লালবাগসহ আরও বেশ কয়েকটি রুটে লেগুনা নামে এসব ছোট ছোট বাহন চলছে। লেগুনার পেছনের পা-দানিতে ঝুলতে থাকা হেলপারের বয়স মাত্র আট বছর। এ বয়সে তার বই নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা। কিন্তু বইয়ের বদলে একহাতে লেগুনার হ্যান্ডেল ও অন্যহাতে খুচরা টাকা নিয়ে যাত্রী ডাকতে ব্যস্ত মিঠু নামে এই শিশুটি। সে জানাল, ‘পড়তে ইচ্ছা করে। তয় (তবে) টাহা (টাকা) নাই। আমার মা-ই (মা) মানুষের বাড়িতে কাজ করে। বাপে ছাইড়া (ছেড়ে) গেছে। আরেকটা ছোট বইন আছে। ওরে স্কুলে পড়াই। পরতিদিন মারে দেড় শ’ টাহা (টাকা) নিয়ে দেই। মা খুশি হয়।’ পরিবহন স্বল্পতাসহ সময় বাঁচানোর জন্যই যাত্রীরা বাধ্য হয়ে এসব ফিটনেসবিহীন ছোট গাড়িতে উঠছেন। তানভীর নামে এক যাত্রী বললেন, ‘সময় বাঁচাতেই আমি লেগুনাতে উঠি। আসলে বাসে চলাচল করা অনেক সময়সাপেক্ষ। এছাড়া রিক্সায় চলাচল করলেও অনেক খরচ। যদিও এসব গাড়ির চালক এবং হেলপাররা শিশু-কিশোর। খামখেয়ালিপনার ভিত্তিতে অনেকটাই বেপরোয়া হয়ে ওরা গাড়ি চালায়। অনেকটা ভয় নিয়েই লেগুনাতে উঠতে হয়। আসলে আমি না উঠলেও অন্য কেউ উঠবে, না উঠেও তো উপায় নেই।’ দেশের সংবিধানের ২৮ ধারায় শিশুদের সুবিধাপ্রাপ্তি সংক্রান্ত বিশেষ বিধান রয়েছে। এছাড়া শ্রম আইন-২০০৬ অনুসারে, কাজে যোগদানের ন্যূনতম বয়স হচ্ছে ১৪ বছর আর ঝুঁকিপূর্ণ কাজের ক্ষেত্রে তা ১৮ বছর হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। ১২-১৪ বছর বয়সের মধ্যে হালকা কাজকে ঝুঁকিমুক্ত কাজ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা শিশুদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। রাজধানীতে চলাচল করে এসব লেগুনার হেলপার দৈনন্দিন হয়ে উঠছেন একেকজন ড্রাইভার। এসব ক্ষুদে ড্রাইভার কি দিতে পারবে যাত্রীদের নিরাপত্তা? বিআরটিএর কাছে লেগুনা ও হিউম্যান হলারের সঠিক কোন হিসাব নেই। নেই নীতিমালা। অথচ রাজধানীর ৬৮ রুটে প্রায় ৬ হাজার লেগুনা চলছে। এর ভাড়াও সরকার নির্ধারিত নয়। এদের জন্য আলাদা লেগুনাস্ট্যান্ডও নেই। মূলত স্থানীয় প্রভাবশালীদের সহায়তায় পার পেয়ে যাচ্ছে এসব লেগুনা ড্রাইভার-হেলপাররা। তবে আশা করা যায়, রাস্তায় কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশের সঠিক নজরদারিই পারে ফিটনেসবিহীন এসব লেগুনা ও অপরিপক্ব ড্রাইভারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে।
×