ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ইউজিসির

টিআইবির প্রতিবেদন শুধু মর্যাদাহানিকর নয়, উদ্দেশ্যমূলক

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২০ ডিসেম্বর ২০১৬

টিআইবির প্রতিবেদন শুধু মর্যাদাহানিকর নয়, উদ্দেশ্যমূলক

বিভাষ বাড়ৈ ॥ প্রভাষক নিয়োগে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ লেনদেন হয়- ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এমন অভিযোগে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ ছাড়া ঢালাওভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে লাখ লাখ টাকা অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ তোলায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন ইউজিসি চেয়ারম্যান, উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যসহ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ৩৭ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ৮টির বিষয়ে তথ্য নিয়ে আসা এবং সেই তথ্যেও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ না থাকায় টিআইবির অবস্থানকে উদ্দেশ্যমূলক ও রহস্যজনক হিসেবে অভিহিত করেছেন তারা। একই সঙ্গে তারা অভিযোগের স্বপক্ষে সব তথ্য প্রমাণ দিতেও টিআইবির কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এর আগে রবিবার রাজধানীতে এক সংবাদ সম্মেলনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক নিয়োগে ৩ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ এনেছে টিআইবি। সংস্থাটির পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রভাষক নিয়োগে পদে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য দিতে না পারলেও সংস্থাটি বলেছে, ১৩ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করে দেখা গেছে যে, আটটি বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রভাষক নিয়োগে আর্থিক লেনদেন হয়েছে। যেখানে নিয়োগে তিন লাখ থেকে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়েছে। ‘সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক নিয়োগ : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনের বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন টিআইবির দুই গবেষক দিপু রায় ও রেজাউল করিম। ২০০১ থেকে ২০১৬ সালের ঘটনা নিয়ে গবেষণাটি করা হয়েছে উল্লেখ করে সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলেছেন, গবেষণাটি করা হয়েছে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত। দেশের ৩৭ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৩ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গবেষণাটি পরিচালিত হয়। সংবাদ সম্মেলনে অর্থ লেনদেনের সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ হাজির করতে পারেনি টিআইবির কর্তা ব্যক্তিরা। এদিকে সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ ছাড়া ঢালাওভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ তোলায় নিন্দা জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান। তিনি ইতোমধ্যেই টিআইবির রিপোর্টকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পরিবারের জন্য মর্যাদাহানিকর বলে অভিহিত করে বলেছেন, টিআইবি মাঝে মাঝে বোমা ফাটায়। এখন যা করেছে এটা তারই ধারাবাহিকতা মাত্র। যে গবেষণা তারা করেছে তা সাবজেক্টিভ ভিত্তিক, এখানে অবজেক্টিভ কিছু নেই। কোথায় কবে কোন ব্যক্তি ঘুষ নিয়েছেন? কে মধ্যস্থতা করেছে কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। টিআইবি বলছে, ১৩ বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা করে ৮টিতেই প্রমাণ পেয়েছে। এ বিষয়ে ইউজিসি চেয়ারম্যান বলেন, তারা তথ্য প্রমাণ দিক। আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেব। টিআইবির অভিযোগ ও গবেষণা সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেছেন, টিআইবি দুর্নীতির যে কথা তুলেছে তা যদি সত্য হয় তবে অবশ্যই কারও কাম্য নয়। এটা কেউ চান না। তবে মূল কথা হচ্ছে একটি গবেষণা রিপোর্টে যদি সঠিক তথ্য, সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকে তবে কোন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে তো ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ থাকে না। এতে একদিকে যেমন গবেষণার উদ্দেশ্য নষ্ট হয় তেমনি ঢালাওভাবে অভিযোগ তোলায় বিভ্রান্তিও দেখা দেয়। এ ধরনের অবস্থান নেয়া তো ঠিক নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান টিআইবির গবেষণা ও অভিযোগকের বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, যথাযথ তদন্ত ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্য প্রমাণ ছাড়া এ ধরনের রিপোর্ট গ্রহণ করা যায় না। কারণ বস্তুনিষ্ঠ তথ্য প্রমাণ ছাড়া গদবাধা ও দায়িত্বহীনভাবে এ ধরনের একটা কথা বলা যায় না। করলে এর কোন গ্রহণযোগ্যতাও থাকে না। বরং এ ধরনের ঢালাও অভিযোগ দেশ ও শিক্ষার মর্যাদা ক্ষুণœœ করে বলেই আমি মনে করি। উপ-উপাচার্য টিআইবিকে যথাযথ তদন্ত ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্যের আলোকে রিপোর্ট প্রকাশের পরামর্শ দিয়েছেন। সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ ছাড়া ঢালাওভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে লাখ লাখ টাকা অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ তোলায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী। তিনি টিআইবির রিপোর্টকে রহস্যজনক ও উদ্বেগজনক অভিহিত করে বলেছেন, একটা তথ্য এনে বলা হলো ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন করা হচ্ছে। কারা কোথায় অপরাধটা করেছে তা বলতে তো হবে। আমি মনে করি সরকারের বিষয়টি দেখা উচিত। টিআইবিকেও তাদের অভিযোগের পক্ষে সব তথ্য প্রমাণ হাজির করতে হবে। কারণ একটা কথা ঢালাওভাবে বলে দিলেই হবে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একজন উপাচার্য বা অন্য কেউ একা নিয়োগ দেন না। এর জন্য অনেক প্রক্রিয়া আছে। কমিটি আছে। তাতে অনেক শিক্ষক থাকেন। ঢালাওভাবে এ ধরনের কথা বলে সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের মর্যাদা ক্ষুণœœ করার চেষ্টা আছে কিনা তা ভেবে দেখা দরকার। এর মাধ্যমে নষ্ট করা হয়েছে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা। তাই এ পেছনে কোন রহস্য আছে কিনা দেখা দরকার। আর যদি তথ্য প্রমাণ তারা দেখাতে পারে তবে অবশ্যই অভিযুক্ত যারা তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। টিআইবির অবস্থান ও তথ্যকে স্পষ্ট করার পরামর্শ দিয়ে দাবির পক্ষে সব প্রমাণ হাজির করার দাবি করেছেন রাজধানীর শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলছিলেন, ৩৫ বছর ধরে শিক্ষকতার সঙ্গে আছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আছি। শিক্ষক নিয়োগের কমিটিতে কাজ করেছি। শত শত কোটি টাকার কাজ হয়েছে হাত দিয়ে। কেউ কোন দিন তো বলতে পারেনি যে অবৈধ টাকা লেনদেন করেছি। আমার আগের উপাচার্য মহোদয় আজো আমাকে ফোন করে বলেছেন কেউ কোনদিন তোমরা কোন নিয়োগে আমাকে টাকা দিয়েছ? আমি বলেছি কখনও এমন হয়নি। তাহলে টিআইবি এভাবে সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ ছাড়া ঢালাওভাবে তথ্য কেন দিল? উপাচার্য এক প্রশ্নে জবাবে বলেন, আমি মনে করি টিআইবি কর্তৃপক্ষ তাদের তথ্য প্রমাণ শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি ও বিশ্ববিদ্যালয়কে অবশ্যই দেবে। যদি সত্যতা থাকে তবে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া উচিত। তবে সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ ছাড়া বললে কেবল বিভ্রান্তি-ই হয়। এটা তখন শিক্ষকদের জন্য মর্যাদাহানীকরও হয়ে দাঁড়ায়। এদিকে টিআইবির ঢালাও রিপোর্টে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট)। শিক্ষকরা এ রিপোর্টকে শিক্ষকদের মর্যাদাহানিকর বলে অভিহিত করেছেন। প্রতিষ্ঠানটির অধ্যাপক ড. আবদুল জব্বার খান বলছিলেন, বুয়েটে টাকা নিয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার ঘটনা কোন দিন ঘটেনি। অথচ ঢালাওভাকে বলে দেয়া হয়েছে ৩ থেকে ২০ লাখ পর্যন্ত টাকা লেনদেন হয়। কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ ছাড়া এ ধরনের ঢালাও বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি আমি। বুয়েটের এ শিক্ষক বলেন, আমি মনে করি টিআইবির এ ধরনের বক্তব্যের পর বুয়েট শিক্ষক সমিতিসহ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের অবস্থান নেয়ার প্রয়োজন। টিআইবি গবেষণা প্রতিবেদন নিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে বলেছে, আর্থিক লেনদেন বা অনিয়মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাম সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ না থাকায় জনসাধারণের মনে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা বা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে টিআইবি দেশের ৩৮ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে যে ১৩ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর যে গবেষণা চালিয়েছে সেখানে অনিয়ম বা অনৈতিক লেনদেনের সংশ্লিষ্ট তথ্য সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয় ছিল। তা হলে বিষয়টি সকলের সামনে পরিষ্কার হতো বলে মনে করেন তারা। বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রত্যেকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে স্বতন্ত্র নিয়োগ নীতিমালা। সে ভিত্তিতেই নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। ফলে এক্ষেত্রে কোন এক বা একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট নিয়োগ বিষয়ে কোনরকম অনিয়ম বা অনৈতিক লেনদেন হয়ে থাকলে তার দায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর বর্তায় না। এদিকে তথ্য প্রমাণ হাজির করার বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, গবেষণা প্রতিবেদনের নিয়ম অনুসারে কাজ করেছি আমরা। যদি সরকারের সংশ্লিষ্টরা আমাদের প্রতিবেদন ও আনুষাঙ্গিক তথ্য চান তবে অবশ্যই আমরা সহযোগিতা করব। আমরা তথ্য দেব।
×