ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ॥ ব্যাংকে সরবরাহ কম

ডলারের দাম বাড়ছেই

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২০ ডিসেম্বর ২০১৬

ডলারের দাম বাড়ছেই

রহিম শেখ ॥ ব্যাংকগুলোতে নগদ ডলারের সরবরাহ ব্যাপকভাবে কমে গেছে। ফলে হু হু করে দাম বাড়ছে নগদ ডলারের। বাংলাদেশের মুদ্রা টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েছে ১ থেকে ২ টাকা। খোলাবাজারে মার্কেটে বেড়েছে প্রায় ৩ থেকে ৪ টাকা। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ব্যাংকের সঙ্গে খোলাবাজারে ডলারের দামে বড় পার্থক্যের ফলে বিদেশ যাওয়ার আগে অনেকে ব্যাংক থেকে ডলার কিনলেও দেশে ফিরে বেশিরভাগই বিক্রি করছেন খোলাবাজারে। এছাড়া আমদানি বাড়া ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমার কারণে ডলারের মজুদ কমেছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এদিকে বিশ্ববাজারে ডলারের চাহিদা আবার বেড়ে গেছে। এর ফলে মুদ্রাবাজারে তেজি হয়ে উঠেছে ডলার। প্রায় এক মাস ধরে বেশিরভাগ দেশের মুদ্রার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়ছে। সম্প্রতি ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার বাড়ানোর ইঙ্গিতেই ডলারের দাম বেড়ে ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হয়। অন্যদিকে সোনার দাম কমে ১০ মাস আগের অবস্থানে ফিরে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘ সময় পর এখন ব্যাংক খাতে নগদ সংরক্ষণের পরিমাণ কমে এক কোটি ডলারের নিচে নেমে গেছে। মূলত নগদ ডলার বেশি বেচাকেনা করে রাষ্ট্রীয় মালিকানার সোনালী, জনতা ও অগ্রণী এবং বেসরকারী ও বিদেশী খাতের হাতেগোনা দু-একটি ব্যাংক। সোনালী ও জনতা ব্যাংক রবিবার প্রতি ডলার ৮২ টাকা ১০ পয়সা দরে কিনে বিক্রি করেছে ৮৩ টাকা ১০ পয়সায়। অগ্রণী ব্যাংক ৮২ টাকা ২০ পয়সা দরে কিনে ৮৩ টাকা ২০ পয়সা দরে বিক্রি করেছে। অবশ্য এর চেয়ে কম বা বেশি দামেও অনেক ব্যাংকে ডলার বেচাকেনা হয়েছে। এক সপ্তাহ আগে প্রতিটি ক্ষেত্রে তা অন্তত এক থেকে দুই টাকা কম ছিল। ব্যাংকের দামে এরকম চিত্র থাকলেও খোলাবাজারে প্রতি ডলার ৮৩ টাকা ৬০ পয়সা থেকে ৮৩ টাকা ৮০ পয়সা দরে বিক্রি করা গেছে। আর খোলাবাজার থেকে কিনতে ব্যয় করতে হয়েছে ৮৪ টাকা থেকে ৮৪ টাকা ২০ পয়সা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রবিবার দিন শেষে ব্যাংকগুলোর কাছে ছিল নগদ ৯০ লাখ তিন হাজার ডলার। গত বৃহস্পতিবার ছিল ৯০ লাখ ৪০ হাজার ডলার। এক মাস আগে ৩১ অক্টোবর ছিল এক কোটি ১৮ লাখ ডলার। গত বছরের একই সময়ে ছিল এক কোটি ২২ লাখ ডলার। তার আগের বছরের একই সময়ে ছিল দুই কোটি ৬২ লাখ ডলার। জানা গেছে, বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের সিংহভাগই হয় বিভিন্ন এ্যাকাউন্টে স্থানান্তরভিত্তিক তথা নন-ফিজিক্যাল ফর্মে। বিদেশ থেকে বাংলাদেশে আসতে বা দেশের বাইরে যাওয়ার সময় নগদ ডলার সঙ্গে নিতে হয়। সম্প্রতি বাংলাদেশী হজ, শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসাসহ বিভিন্ন কারণে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ডলার নেয়ার সীমা বাড়ানো হয়েছে। তবে একই হারে বিদেশীরা আসছেন না। যে কারণে নগদ ডলারের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। যদিও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে। তারপরও কমছে না ডলারের দাম। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মানিচেঞ্জার এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি মোস্তফা খান জনকণ্ঠকে বলেন, সরবরাহ সঙ্কটই ডলারের দাম বাড়ার অন্যতম কারণ। সরবরাহ সঙ্কট দেখা দিয়েছে মূলত বিমানবন্দরে কড়াকড়ি আরোপ ও ভারতগামীরা রুপীর নোটের পরিবর্তে ডলার নেয়াসহ বিভিন্ন কারণে। তবে ডলারের দাম এভাবে বাড়তির দিকে থাকলে মানিচেঞ্জারের ব্যবসা কমে। কেননা হঠাৎ দাম বাড়তে থাকলে তখন অনেক প্রতিযোগিতামূলক দামে ডলার বেচাকেনা করতে হয়। বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের সিংহভাগই হয় বিভিন্ন এ্যাকাউন্টে স্থানান্তরভিত্তিক। তবে দেশের বাইরে যেতে বা বিদেশ থেকে এখানে আসার সময় নগদ ডলার সঙ্গে নেয়ার প্রয়োজন হয়। প্রাপ্ত তথ্যমতে, বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে নন ফিজিক্যাল ফর্মে ডলার বাড়লেও নগদ ডলার ধারাবাহিকভাবে কমছে। বিভিন্ন ব্যাংকে নগদ ডলারের পরিমাণ কমে গত ৩১ অক্টোবর এক কোটি ১৮ লাখ ডলারে নেমে আসে। এমন পরিস্থিতিতে গত বছর নগদ ডলার আমদানির জন্য স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডকে অনুমতি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সংশ্লিষ্টরা জানান, এনবিআরের বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী নগদ ডলার আমদানিতে কর ও ভ্যাট বাবদ ৩৭ শতাংশ হারে পরিশোধ করতে হয়। অর্থাৎ প্রতি ১০০ ডলার আমদানি করতে ব্যয় হবে ১৩৭ ডলার। তবে এমন দামে দেশের বাজারে ডলার বিক্রি সম্ভব নয়। এমন প্রেক্ষাপটে কর মওকুফ সুবিধা দিয়ে এসব ডলার আমদানি করতে চাইছে ব্যাংকটি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও চাইছে এক্ষেত্রে ব্যাংকটিকে সহায়তা দিতে। এর আগে ২০১০ সালে একবার বিশেষ ব্যবস্থায় কর ও ভ্যাট মওকুফ সুবিধা নিয়ে ৩০ লাখ ডলার মূল্যমানের নোট আমদানির সুযোগ পেয়েছিল স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড। কর ও ভ্যাটসংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি ছাড়াও এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। তবে সেখান থেকেও সমস্যার সমাধান হয়নি। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, জটিলতা নিরসন হলে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ৪০ লাখ ডলার, আড়াই লাখ ইউরো ও এক লাখ ব্রিটিশ পাউন্ডের নোট নিয়ে আসবে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান জনকণ্ঠকে বলেন, মার্কিন ডলারের প্রতিদ্বন্দ্বী মুদ্রাগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ ইউরো, পাউন্ড, ইয়েন, ইউয়ান, অস্ট্রেলিয়ান ডলার। এর মধ্যে চীন ও জাপান ছাড়া বাকি দেশগুলোয় অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। এসব কারণে ওই সব দেশের মুদ্রার মান কমছে। জাপান ও চীনের অর্থনীতি এখনও তুলনামূলকভাবে রক্ষণশীল। যে কারণে ওই সব দেশের মুদ্রার প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কম। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম কমছে। এ কারণে স্বর্ণ ছেড়ে বিশ্বের কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এখন ডলারে বিনিয়োগ করছে। ডলারের দাম বাড়ার আরও একটি বড় কারণ হচ্ছে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের নীতিনির্ধারণী সুদের হার বাড়ানোর ইঙ্গিত দেয়া। মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে সারাবিশ্বে গত ১৩ বছরের মধ্যে ডলারের দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। গত ১৫ নবেম্বর ১ ডলার পাওয়া যেত ০.৯১ ইউরো দিয়ে। এখন এক ডলার কিনতে ব্যয় করতে হবে ০.৯৩ ইউরো। ওই সময়ে ইউরোর বিপরীতে প্রতি ডলারের দাম বেড়েছে ২ শতাংশ। একই সময়ের ব্যবধানে যুক্তরাজ্যের মুদ্রা পাউন্ডের বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েছে দশমিক ২ শতাংশ। গত ১৫ নবেম্বর ১ ডলার কিনতে ০.৭৮ পাউন্ড ব্যয় করতে হতো। এখন ব্যয় করতে হয় ০.৮০ পাউন্ড। একই সময়ে ভারতীয় রুপীর দাম ৬৬.৬৬ থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৭.৭৮ রুপী। ওই সময়ে প্রতি রুপীর বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েছে ১.৭ শতাংশ। একই সময়ে ইউএস ডলারের বিপরীতে অস্ট্রেলিয়ান ডলারের দাম ১.৩৪ থেকে বেড়ে ১.৩৯ হয়েছে। ওই সময়ে ইউএস ডলারের দাম বেড়েছে ৩.৫ শতাংশ। ডলারের বিপরীতে সৌদি রিয়ালের দাম ৩.৭৫ থেকে বেড়ে হয়েছে ৩.৮০ রিয়াল। ওই সময়ে রিয়ালের বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েছে ১.৩ শতাংশ। কুয়েতের মুদ্রা দিনারের দাম ০.২৯ থেকে বেড়ে ০.৩০ দিনার হয়েছে। ওই সময়ে প্রতি দিনারের বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েছে ৩.৩ শতাংশ। ২০১৭ সালে খুব দ্রুতই সুদের হার আরেক দফা বাড়ানো হবে, ফেডারেল রিজার্ভের এমন ইঙ্গিতেই গত সপ্তাহে ডলারের দাম বেড়ে ১৪ বছরে সর্বোচ্চ হয়। এর বিপরীতে দর হারায় সোনা। সোনার দাম কমে ১০ মাসে সর্বনিম্ন হয়। গত নবেম্বরে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ছিল ১ হাজার ২৮০ ডলার। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৭০ ডলার।
×