ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ২০ ডিসেম্বর ২০১৬

ঢাকার দিনরাত

বিজয় দিবস উদযাপন নিয়ে বিশদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তবু তাতে কিছু সংযোজন জরুরী। একটা বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়, সেটি হলো বিজয় দিবসটিকে রাজধানীবাসী বেশ ক’বছর হলো বিশেষ উৎসবের দিনে পরিণত করেছে। পহেলা বৈশাখে যেমন অল্পবয়সীদের উচ্ছল ঘোরাঘুরি লক্ষ্য করা যায়, ষোলোই ডিসেম্বরেও তেমনটি ঘটছে। বিশেষ পোশাকও বেছে নিচ্ছে তারা। শীতকে উপেক্ষা করে ছেলেরা পাঞ্জাবি আর মেয়েরা শাড়ি পরছে। লাল-সবুজে ডিজাইনকৃত পোশাক যদি নাও হয় তাহলেও পোশাকে লাল ও সবুজের ছোঁয়া রাখছে। এটি একইসঙ্গে দেশপ্রেম ও সচেতনতা প্রকাশকারী। বেশ একটা প্রাণময় উৎসবের দিনই বানিয়ে ফেলেছে তারা বিজয় দিবসকে। ছুটির দিন হওয়ায় তাদের এই সানন্দ স্বচ্ছন্দ চলাচল অন্যদের মনেও আনন্দের আভা ছড়িয়ে দেয়। তবে কথা হচ্ছে আনন্দটাই সব নয়, আনন্দের পাশে কিছু কষ্ট সহ্য করার মানসিকতাও থাকা চাই। কষ্ট করে দেশের সঠিক ইতিহাস জানতে হবে। যারা তাদের এই আনন্দের উপলক্ষ নিয়ে এসেছেন সেই দেশপ্রেমিকদের জন্যে কিছু ত্যাগ স্বীকারের প্রতিজ্ঞা থাকতে হবে। সেই সঙ্গে এই দেশটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যারা কাজ করে চলেছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, সমাজের অসহায় অপারগ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সামান্য হলেও উদ্যোগ নিতে হবে। তবেই না আনন্দ পুরোপুরি সুখ বয়ে আনবে। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে বিত্তহীন কোন মানুষের জন্য একখানা শীতবস্ত্র কিনে তাকে উপহার দেয়ার ব্যবস্থা নিন, সেই সঙ্গে কাছের বন্ধুটিকেও একই কাজ করার জন্য উৎসাহিত করুন- তাহলে বিজয় দিবসের আনন্দে নিশ্চয়ই ভিন্ন মাত্রা যোগ হবে। সেক্ষেত্রে ‘স্বার্থপর’ আনন্দ হয়তোবা ভিন্নতর সুখের সন্ধান পাবে। বিজয় দিবসের আগের সন্ধ্যায় রাজধানীর কয়েকটি স্থানে ঘুরে দেখতে পেয়েছি বিপণিবিতান শুধু নয়, নামী-দামী রেস্তোরাঁ ও কার্যালয়ের প্রবেশদ্বারে মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্রমালা দিয়ে সাজানো হয়েছে। আর বিভিন্ন সড়ক, সড়ক দ্বীপ ও ভবনে শোভা পাচ্ছিল বর্ণিল আলোকসজ্জা। আলো দিয়ে তৈরি করা হয় প্রিয় লাল-সবুজ পতাকা। মতিঝিল এলাকায় ভবনের বর্ণিল রূপ সত্যিই প্রশংসনীয় কাজ। এবার ব্যতিক্রমী ও আকর্ষণীয় আয়োজনটি হয়েছিল অবশ্য জাতীয় সংসদ ভবনে বিজয় দিবসের সন্ধ্যায়। লেজার শোর মাধ্যমে জাতীয় পতাকা, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি, গ্রামবাংলাসহ বিভিন্ন ছবি প্রদর্শন করা হয়। সংসদ ভবনের দেয়ালজুড়ে প্রদর্শিত ত্রিমাত্রিক দৃশ্যচিত্রে ফুটিয়ে তোলা এসব ছবি ছিল নজরকাড়া ও উদ্দীপনামূলক। জাতীয় সংসদকে ঘিরে ‘১৬ ডিসেম্বর : মৃত্যুঞ্জয়ী বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন ধানম-ির ৩২ নম্বরের বাড়িটি ১৯৭০-৭১ সালে ছিল বাঙালীর চেতনার বাতিঘর। সেই বাড়িটি এখন বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর। বিজয় দিবসে বিপুলসংখ্যক মানুষ আসেন এই বাড়িতে। সকালে এখানে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন প্রধানমন্ত্রী। রাজধানীর ঘরবাড়ি, দোকানপাট, দালানের ছাদ-কার্নিশ, ছুটে যাওয়া মোটরসাইকেল, গাড়ি, রিক্সাসহ যানবাহন, সড়কদ্বীপ- যেদিকে চোখ গেছে, সর্বত্র উড্ডীন জাতীয় পতাকা। বিজয় উৎসবের হরেক রকম অনুষ্ঠানও ছিল শহরজুড়ে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠান ছাড়াও অনেক ছোট ছোট সংগঠন ট্রাকে মঞ্চ করে শহর ঘুরে মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠান করেছে। দুপুরে হাতিরঝিলে ছিল নৌকাবাইচ। তবে বরাবরের মতো বিজয় উৎসবের মূল কেন্দ্র ছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, টিএসসি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও রমনা পার্ক এলাকা। সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে বের হয় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের বিজয় শোভাযাত্রা। এ ছাড়া জোটের আয়োজনে ধানম-ির রবীন্দ্রসরোবরের কবি রফিক আজাদ মঞ্চ, রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণ মঞ্চ, মিরপুরের খন্দকার নূরুল আলম মঞ্চ, দনিয়ার বর্ণমালা স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠের মঞ্চে ছিল সঙ্গীত, নৃত্য, আবৃত্তি। সব মিলিয়ে দারুণ এক বিজয়োৎসব। খালে ঝিলে জলযান! সে এক সময় ছিল যখন ঢাকার চারপাশের চার-নদী ছিল স্রোতোস্বিনী আর নগরের ভেতরের খালগুলোও ছিল প্রশস্ত ও প্রবহমান। এখন দখল-দূষণের শিকার হয়ে নদীগুলো মরণাপন্ন আর অট্টালিকা গড়ার উন্মাদনা, মাত্রাতিরিক্ত নাগরিকদের চাপ এবং বহুবিধ অপরিণামদর্শিতার কারণে অধিকাংশ খালই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। হাতেগোনা যে কটি খাল রয়েছে সেগুলো বাঁচানোর চেষ্টা এবং প্রয়োজন পূরণের জন্য ব্যবহার-উপযোগী করার প্রয়াস নিতে দেখি সামান্য হলেও। যেমন হাতিরঝিল হৃত গৌরব ফিরে পেয়েছে; দু-তিনটি খাল পরিবেশ সচেতন ব্যক্তিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। রাজধানীর খালে ঝিলে আবার ফিরে আসতে শুরু করেছে জলযান। তবে এসব যন্ত্রচালিত জলযান। বিজয় দিবসের উপহার হিসেবে সরকার হাতিরঝিলে ‘ওয়াটার ট্যাক্সি’ চালু করেছে। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে নির্মিত ‘স্বপ্নিল হাতিরঝিল’ প্রকল্পের নতুন উপকরণ ওয়াটার ট্যাক্সিতে মগবাজার, তেজগাঁও, কারওয়ান বাজার এলাকার মানুষ মাত্র ১২ মিনিটে গুলশান ১ নম্বরে পৌঁছে যাচ্ছে। আর এর অর্ধেক সময় লাগছে রামপুরা কিংবা বাড্ডার বাসিন্দাদের। প্রতিদিন ভোর ৬টা থেকে রাত ১০টা ঝিলের পানিতে চলবে চারটি ‘ওয়াটার ট্যাক্সি’। এফডিসি থেকে বাড্ডা পর্যন্ত ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫ টাকা এবং গুলশান-১ পর্যন্ত ৩০ টাকা। হাতিরঝিল উদ্বোধনের পর থেকেই নগরবাসীর বিস্ময়। এটি অনেকের কাছেই বিনোদনকেন্দ্র। অবশ্য বহু মানুষ কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য বাসে করে হাতিরঝিল পাড়ি দেয়। সব সময়েই দীর্ঘ লাইন থাকে। বাসের স্বল্পতার কারণে কিছুটা অপেক্ষাও করতে হয় চলন্ত বাসে প্রবেশাধিকার পেতে। শনিবার ছুটির দিন হওয়ায় ওয়াটার ট্যাক্সিতে যাত্রীর চেয়ে বিনোদনপ্রেমীর সংখ্যাই ছিল বেশি। এ এলাকায় যাদের শৈশব-কৈশোর কেটেছে তারা আকস্মিকভাবে নৌবিহারের সুযোগ পেয়ে সন্তুষ্ট। নদীবহুল আমাদের দেশের মানুষ জলপথে ভ্রমণ করতে ভালবাসে। তাই হাতিরঝিলে চালু হওয়া জলযান সব সময়েই যাত্রীভর্তি থাকবে- এটা আশা করা যায়। যাত্রীসেবার মান নিশ্চিত ও সময় নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষ সচেষ্ট। নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সামনের সারির ৮টি আসন নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া প্রতিটি বোটেই ময়লা ফেলার স্থান রয়েছে। কোন যাত্রী যেন ঝিলের পানিতে ময়লা না ফেলেন, সে জন্য নির্দেশিকাও দেওয়া হয়েছে। একজন কবির প্রস্থানে তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ঢাকা ক্লাবে কবিদের এক আড্ডায়। সেখানে অবশ্য কবি ছাড়াও সাহিত্যের নানান শাখার লেখক উপস্থিত ছিলেন। এরপর দু’তিনবার সাক্ষাত হয়েছে, তার সবই কবি ও কবিতাকেন্দ্রিক আয়োজন। কবি শহীদ কাদরীর মরদেহ রাখা আছে শহীদ মিনারে। অশ্রুসজল নীরা কাদরী দাঁড়িয়ে আছেন কফিন ছুঁয়ে। দ্রুততম সময়ের ভেতর বিটিভিতে কবিকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা সম্ভব হলো। টিভি স্টুডিওতে যাওয়া-আসার সময়টুকুতে নীরা কাদরী একাধিকবার তার নাম উচ্চারণ করলেন। বলছিলাম কবি মাহবুবুল হক শাকিলের কথা। নীরাদি বলছিলেন, কবি শহীদ কাদরীকে বাংলাদেশে এনে সমাহিত করার নেপথ্যে এই শাকিলের অবদানই বেশি। হ্যাঁ, তাঁর কবি পরিচয় ছাপিয়ে ‘প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী’ পরিচয়টিই সমাজে বড় হয়ে উঠেছিল। হয়ত সেজন্যই আমার সঙ্কোচ হতো তার সঙ্গে আলাপ করতে। বরং বিভিন্ন ঈদ সংখ্যায় এবার প্রকাশিত তার কবিতাগুলো পড়েছি। আকর্ষণীয় কর্মপরিচয় ব্যবহার করে কবি-পরিচিতিকে সামনে এগিয়ে নেয়ার অভিপ্রায় তার ছিল- এটা আমার একবারও মনে হয়নি। বরঞ্চ মনে হয়েছে, দুই পরিচয়ের ভেতর কেউ সম্পর্ক খুঁজুক- এটা তার জন্য সমূহ কুণ্ঠার ও বিড়ম্বনার। এক সময়কার ছাত্রনেতা শাকিলকে আমার কবি ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি আর এই কথাটিও তাকে আমার বলা হলো না। আর কোনদিন বলার সুযোগও পাব না। আকস্মিকভাবেই তিনি চলে গেলেন। তার চলে যাওয়ার পর শুধু কবি নয়, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ শোকাহত হয়েছেন, আন্তরিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। ফেসবুকে কয়েকদিন তাকে নিয়ে তুমুল আলোচনা হলো। তরুণ লেখক আখতারুজ্জামান আজাদের এই কথাগুলো মন ছুঁয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘শাকিল জীবনানন্দ ঘরানার কবি ছিলেন বলেই আমার ধারণা হয়। নৈরাশ্যবাদ, বিচ্ছেদ-বেদনা, হার্দিক হাহাকার, নাগরিক নৈঃশব্দতা- এই উপকরণগুলোই ঘুরেফিরে এসেছে তার নাতিদীর্ঘ কবিতাগুলোয়। তিনি বেদনার কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন, পানশালায় প্রবোধ খুঁজেছেন, প্রেম নিয়ে পাশা খেলেছেন, দিনকে রাত আর রাতকে দিন করেছেন। সর্বোপরি তিনি মৃত্যুর প্রয়োজনে বড় হয়েছেন, পদ-পদবিতে বড় হয়েও হামিংবার্ডের মতো ছোট থেকেছেন।’ সে যাক, গত সপ্তাহে তাকে নিয়ে স্মরণসভা হলো বাংলা একাডেমিতে। সেখানে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বললেন, ‘জীবনের মধ্যগগনে এসে আলো নিভিয়ে চলে গেল প্রতিভাবান সাহিত্যিক শাকিল। তাকে ভোলা সম্ভব নয়, আমাদের হৃদয়ে সব সময় বেঁচে থাকবে।’ ১৮ ডিসেম্বর ২০১৬ [email protected]
×