ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

খায় দায় ঘুমায় তীব্র শীত আর মশার কামড় খেয়ে

বাস্তুচ্যুত ৩০ থেকে ৪০ হাজার মানুষ থাকে ঢাকার ফুটপাথে

প্রকাশিত: ০৫:২০, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৬

বাস্তুচ্যুত ৩০ থেকে ৪০ হাজার মানুষ থাকে ঢাকার ফুটপাথে

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ‘এইখানে একই ফুটপাথে আমাগো মতন দেড়শ পরিবার দিন কাটাচ্ছে। অনেক অসুবিধা হয় ডাস্টবিনের পাশের দুর্গন্ধে। সঙ্গে আবার রাস্তার ধুলো-বালি ও শব্দের জ্বালা। রাত আইলে শীত আর মশার জ্বালায় ঘুমানোও কঠিন। পয়সার অভাবেই আমাগো বাড়ি লালমনিরহাট থেকে ঢাহা শহরে আসছিলাম কর্ম করব বলে। মানুষের বাসা-বাড়িতে কাজ করে যে কয় টাকা পাই তাতে খাওনই জোটে না, তার আবার বাড়ি ভাড়া করব কেমনে?’ কথাগুলো বলছিলেন ফুটপাথবাসী করিমন বেগম। রাজধানীর ১০১, সিআর দত্ত রোডের সামনের ফুটপাথে বসে খেতে দেখা গেল তাকে। পাশেই ঘুমাচ্ছে তার ছেলে। ফুটপাথেই তাদের খাওয়ার জায়গা, ঘুমের জায়গাও ফুটপাথ। একপাশে পাবলিক টয়লেট এবং রাস্তার অন্যপাশে ডাস্টবিনের নোংরা পরিবেশেই দীর্ঘ পাঁচ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন করিমন। স্বামীহারা করিমন ১০ বছরের ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে রংপুর থেকে এসেছিলেন কর্মের সন্ধানে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বড় বড় শহরে ভাসমান অনেক মানুষকে দেখা যায় ফুটপাথে, বাস টার্মিনাল, লঞ্চ টার্মিনাল কিংবা রেলস্টেশনে ঘুমাতে। শুধু ঘুম নয় সঙ্গে খাওয়াসহ রান্নার ব্যবস্থাও তারা নিজ নিজ ফুটপাথের জায়গাতে সম্পন্ন করে থাকেন। ঘরহীন এসব মানুষের অনেকেরই নিজ এলাকায় আবাস আছে আবার অনেকের সেই ভিটাবাড়ি পর্যন্তও নেই। কর্মসংস্থানের সন্ধানেই তারা ঢাকা শহরকে বেছে নিয়েছেন। পুরুষের পাশাপাশি নারী উদ্বাস্তুর সংখ্যাও কম নয়। কারওয়ানবাজার, ফার্মগেট, গ্রীনরোড, মৌচাক, গুলিস্তান এলাকার বিভিন্ন ফুটপাথে কয়েক হাজার পথবাসীর জীবন কাটছে। ফুটপাথে বসেই রান্না করছেন মর্জিনা। নোংরা পরিবেশের এই রান্নায় অভ্যস্ত সে। ধুলাবালিসহ সকল জীবাণুই না-কি খাওয়ার পর হজম হয়ে যায়। তার স্বামী ভাঙ্গারী ব্যবসায়ী। তার মেয়ের বয়স সাত বছর। টাকার অভাবে পড়ালেখা করতে পারছে না সাত বছর বয়সী আমেনা। বসে থাকার চেয়ে কাগজ কুড়ানোর দিকেই মনোনিবেশ করেছে সে। মর্জিনাও করিমনের মতো মানুষের বাসায় কাজ করত কিন্তু সম্প্রতি অসুস্থ হওয়ায় ক’দিন কাজে যেতে পারেননি। আর তাই মালিক বলে দিয়েছেন আর আসতে হবে না। আপাতত সে বেকার। স্বামীর রোজগারে তিনবেলা ভাত জোটে না তার ও মেয়ে আমেনার। তাই বাধ্য হয়ে একবেলা কোনরকম খেয়ে দিন কাটান তারা। মর্জিনা ও করিমনের মতো ফুটপাথের সব পরিবারের গল্প প্রায় একই। অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের সন্ধানে আসা এসব পরিবার এভাবে উদ্বাস্তু হয়ে কাটিয়ে দিচ্ছেন দিনের পর দিন। ভাগ্যের উন্নতি কবে হবে, কিভাবে হবে তার কিছুই জানেন না দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী এসব ফুটপাথবাসী। ডিসিসির (ঢাকা সিটি কর্পোরেশন) তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় বসবাসকারী দেড় কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ হাজারের মতো ফুটপাথে বসবাস করে। মূলত প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও কর্মসংস্থানের কারণে বাধ্য হয়ে শহরে এসে পথবাসী হয়ে যান অনেকে। সিআর দত্ত রোডের এই ফুটপাথবাসীরা দীর্ঘ ছয়-সাত বছর ধরে এখানে আস্তানা গেড়েছেন। রাস্তায় বিয়ে হয়েছে, ছেলে-মেয়ে হয়েছে এমনও লোকজন আছেন। ৩০-৩৫ বছর ধরে ফুটপাথে আছেন এমন অনেক উদ্বাস্তু আছেন ঢাকায়। তবে সরকারী এই পরিসংখ্যানের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে অনেকেই বলেছেন, সরকারী হিসাবের চেয়ে দেশে ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যা আরও বেশি। বছর বছর ফুটপাথগুলোতে উদ্বাস্তু লোকের সমাগম বাড়লে পুলিশ ও স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাঝেমধ্যে উচ্ছেদ অভিযান চালালেও সাময়িক সময় পরে আবারও এসব উদ্বাস্তু এসে ঘাঁটি গাড়ে। ফুটপাথবাসী আমিনুল ইসলাম বললেন, ‘উচ্ছেদ করলেও কই আর যামু। ঘুরে ফিরে সেই রাস্তার ধারের ফুটপাথেই তো জায়গা হয়। কত বছর হইল ঘরে ঘুমাইনি! কেউ যদি পাশে দাঁড়াত, কাজ কাম দিত তাইলে খুবই উপকার হইত। ভাঙ্গরীর ব্যবসা করে বউ-বাচ্চার তো খাওয়াইতেই পারি না। বাড়ি ভাড়া নেয়ার সাধ্য কই।’ পাশের ডাস্টবিন থেকে ময়লা পরিষ্কারের কাজ করেন ফাতেমা বেগম। তার বাড়ি ছিল গাইবান্ধাতে। কিন্তু ভাগ্যের পরিক্রমায় বন্যায় সবকিছু ভেসে গেছে তিন বছর আগে। স্বামীহীন ফাতেমা দুই সন্তান নিয়ে জীবন বাঁচাতে তাই ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছেন। ‘আমার বড় পোলায় রিস্কা (রিক্সা) চালায় আর ছোড (ছোট) পোলায় ভাঙ্গারী কুড়ায়। এমনেই কোনমতে দিন পার করিচ্ছি (করছি)।’ ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে গত ছয় বছরে বাংলাদেশের ৫৭ লাখ মানুষ বাস্তুহারা হয়েছে। যাদের বেশিরভাগেরই আবাসস্থল এখন রাজধানীর বুকে। কিন্তু রাজধানীতে এসে কোন রকম বেঁচে থাকার ব্যবস্থা হলেও সবার ভাগ্যে জোটে না মাথা গোঁজার ঠাঁই। নিজ গ্রাম ছেড়ে আসা মানুষদের মধ্যে গুটিকয়েকের ঠিকানা হয় বস্তিতে। বেসরকারী একটি সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে, ঢাকায় মূলত তিন ধরনের পথবাসীর বাস। প্রথমত, গ্রাম থেকে কর্মসংস্থানের খোঁজে আসে অনেক পরিবার। দ্বিতীয়ত, ভাসমান মানুষের তালিকায় রয়েছে নারীপ্রধান কিছু পরিবার। বিশেষ করে যেসব নারীর স্বামী মারা গেছে কিংবা তালাক দিয়ে ছেড়ে গেছে, সেসব নারীরা তাদের সন্তান নিয়ে কর্মের খোঁজে ঢাকায় আসছেন। তৃতীয়ত, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন গুটিকয়েক মানুষ যাদের পরিবারের সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই। এ তালিকায় নারীরাই বেশি, যারা প্রতারণার ফাঁদে পড়ে পরিবার ছেড়েছে এখন বাধ্য হয়েই ফুটপাথে দিন কাটাচ্ছে। বর্তমানে ৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। তাদের দারিদ্র্য থেকে বের করে আনার চেষ্টা এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার ইতিমধ্যে দারিদ্র্য বিমোচনকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে কাজ করে চলছেন। অদূর ভবিষ্যতে অবশ্যই খেটে খাওয়া এসব ‘ফুটপাথের বাসিন্দা’রা আলোর মুখ দেখবে এবং নিজ নিজ ঘরে ঘুমিয়ে রাত কাটাতে পারবে!
×