ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বললেন নেত্রকোনার মুক্তিযোদ্ধা ব্রজ গোপাল

বিরাই ব্রিজের বাঙ্কারে ছোড়া গ্রেনেডে মরল দুই পাক সেনা ও ২ রাজাকার

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৬

বিরাই ব্রিজের বাঙ্কারে ছোড়া গ্রেনেডে মরল দুই পাক সেনা ও ২ রাজাকার

এমদাদুল হক তুহিন ॥ ‘তিন সারিতে বিভক্ত হয়ে বিরাই ব্রিজের বাঙ্কারের কাছে পৌঁছাই। তৈবাসিন ও ক্ষিতিশ সরকার সবার সামনে। তাদের হাতে বেয়োনেট আর গ্রেনেড। এরমধ্যে তৈবাসিন গ্রেনেড ছুড়বে। পরের সারিতে আরও দুজন-ইজ্জত আলী ও রসুল। তাদের হাতে এসএলআর। তৃতীয় সারিতে আমি ও প্রসেন ভৌমিক। আমাদের হাতেও এসএলআর। আমরা বাঙ্কারের এত কাছে পৌঁছায় যে পাক সেনাদের কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম। ক্যাম্পে প্রতি ঘণ্টায় বেল দেয়া হতো। পরিকল্পনা অনুযায়ী, রাত বারোটার শেষ বেল দেয়া মাত্রই গ্রেনেড ছুড়তে হবে। তখন চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমরা অপেক্ষায়। ওরা হাঁটছে। লক্ষ্য রাখছে চারদিক। আমাদের দৃষ্টিও তীক্ষè। বারোটার বেল শুরু হলো। শেষ বেলের সময় তৈবাসিন ছুড়ল গ্রেনেড। অতি উৎসাহিত হয়ে সে আরও একটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে, যা আমাদের পরিকল্পনায় ছিল না। উপর্যুপরি দুই গ্রেনেডের আঘাতে বাঙ্কারে থাকা ২ রাজাকার ও ২ পাকসেনা নিহত হয়। আকস্মিক এই আক্রমণে ক্যাম্পে থাকা মিলিটারিরা হতভম্ব হয়ে পড়ে। তারা আকাশে সার্চলাইটের আলো ফেলে। ততক্ষণে আমরা নৌকায় করে রন্নারচর এলাকায় ফিরে আসি।’ Ñ মহান বিজয়ের মাসে জনকণ্ঠের কাছে এভাবেই যুদ্ধদিনের স্মৃতি তুলে ধরেন একাধিক গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেয়া নেত্রকোনার মুক্তিযোদ্ধা ব্রজগোপাল সরকার। তিনি খালিয়াজুড়ি উপজেলার চাকুয়া গ্রামের বাসিন্দা। নেত্রকোনার এই মুক্তিযোদ্ধা সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন উপজেলায় একাধিক সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। ভারতে ট্রেনিং নিয়েছেন যুদ্ধের প্রথমার্ধেই। সহযোদ্ধাদের সঙ্গে মিলে নিজ হাতে গড়ে তোলেন ইকো ওয়ান নামক ক্যাম্প, ওই ক্যাম্পে ট্রেনিং নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় তারাই প্রথম। সিলেট অঞ্চলের বিরাই ব্রিজ এলাকায় তাদের হাতে রাজাকারসহ ৪ জন নিহত হওয়ার তথ্য তুলে ধরে মুক্তিযোদ্ধা ব্রজগোপাল সরকার বলেন, ‘এটা যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়। ২১ আগস্ট, ১৯৭১। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা বিরাই ব্রিজে আক্রমণ করতে যাই। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লক্ষ্য নির্ধারিত। বাঙ্কারে অবস্থান করা রাজাকার ও পাক সেনাদের ওপর গ্রেনেড ছুড়তে হবে। দলে থাকা ৩০ মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে এই অপারেশনে ১০ জন অংশ নিই। নৌকায় করে ব্রিজে যেতে পাশেই রাজাকারের ক্যাম্প। তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আমরা ব্রিজের কাছে পৌঁছাই। আর পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা সফল হই। এতে মোট ৪ জন নিহত হয়। হতভম্ব হয়ে পড়ে পাকবাহিনী।’ পরবর্তী যুদ্ধের অন্য একটি ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের ক্যাম্প ছিল ভাটিয়াপাড়া হাইস্কুলে। ভাটিয়াপাড়া থেকে কালনী নদীতে যাব। ওই পথে যাওয়ার সময় দেখা হয় আরস আলীর সঙ্গে। সে বলল আমার এলাকায় যাবেন আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যান। নদীপথে ঘুরলাম। রাতে হাওড়ে থাকলাম। ভাইবনা গ্রামে আমরা অবস্থান নিই। এই গ্রামে দুটি পাড়া। একটি মুসলিম অন্যটি হিন্দু। ভাইবনা গ্রামসহ আশপাশের প্রতিটি বাড়িতে দেখতে পাই পাকিস্তানের পতাকা। নদীতে চলাচলরত নৌকায়ও পাকিস্তানের পতাকা। এখানে পাশর্^বর্তী জয়কলশ বাজারে মিলিটারিদের ক্যাম্প ছিল। পাকিস্তানের পতাকা উড়ছে এমন একটি নৌকার মাঝিকে কাছে ডেকে আনি। আমাদের সঙ্গে নৌকাভর্তি অস্ত্র দেখে ওই নৌকায় থাকা লোকটি ভয় পেয়ে যায়। তাকে বললাম, পতাকা নামাতে। কথা বলার এক পর্যায়ে তাকে বোঝাতে সক্ষম হলাম। সে পতাকা নামাল।’ তিনি বলে যাচ্ছেন। বললেন একটানেই। মুক্তিযোদ্ধা ব্রজগোপালের ভাষ্যÑ ‘এরমধ্যে ভাইবনা গ্রামে আমরা যেখানে অবস্থান করছি হঠাৎ এক লোক ছোট ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের কাছে এসে অনুনয় বিনয় করতে লাগল। তাদের গ্রামে যেতে। পরবর্তী সময়ে জেনেছি সে ছিল দালাল। কথা বলার সময় পাশের বাড়ি থেকে একটি লোক চিৎকার করে বলে উঠল আপনারা এখানে গল্প করছেন, মিলিটারি তো এসে পড়ছে! দ্রুত খালে লাফিয়ে পড়ি। কমান্ডার আব্দুল মজিদও এলএমজি নিয়ে পানিতে পড়ে। আমার সঙ্গে ছিল ম্যাগজিন। আমরা গিয়ে হিন্দুপাড়ায় উঠি। ওরা মুসলিম পাড়া থেকে গুলি করছে। আমি ব্রাশ ফায়ার শুরু করি। ছয়টা ম্যাগজিন শেষ হয়ে গেল। কমান্ডার বলল এখন আমাদের স্যারেন্ডার করতে হবে। আর কোন উপায় নেই। কেননা সেখানে আমি আর কমান্ডারই ছিলাম। আর কোন মুক্তিযোদ্ধা ছিল না। আমি বললামÑ আমরা স্যারেন্ডার করব না। প্রয়োজনে আমাকে মেরে ফেলুন। কারণ আমাদের অস্ত্রসহ নৌকাগুলো ওদের ক্যাপচারে।’ একটু থেমে তিনি বললেন। তার ভাষ্যÑ ‘এরমধ্যে গোলাম রসুল নামে এক মুক্তিযোদ্ধা পানিতে ভাসতে ভাসতে ওপরে ওঠে এলেন। রসুলের সঙ্গে ছিল আরস আলী। রসুল বলল গোপাল যদি নদী থেকে অস্ত্র আনতে যায় তবে আমিও যাব। আমি উৎসাহিত হয়ে উঠলাম। সাহস পেলাম। এগিয়ে গেলাম নদীর দিকে। এরমধ্যে রসুল নৌকায় ওঠামাত্রই পাকবাহিনীর একটি গুলি এসে তার হাতে লাগে। গ্রেনেডের প্যাকেট ও গুলি নিয়ে কোন রকম প্রাণে বেঁচে হিন্দুপাড়ায় উঠি। ফিরে এসে দেখি আমাদের এলএমজি চলে না। মাটি ও কাদা লাগায় এলএমজি থেকে গুলি বের হচ্ছে না। নিরুপায় হয়ে উঠি। এরমধ্যেই আমাদের আরও চারজন যোদ্ধা এলো। অখিল ভৌমিক, সিরাজ, তৈবাসিন; আরেকজনের নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। তিনজনের হাতেই ছিল এসএলআর। আমরা আবার ফাইট শুরু করি। আমি আর আরস ছোট থাকায় ম্যাগজিনে গুলি ঢুকাই। বাকিরা ফায়ার করছে। আকাশ গর্জে উঠল। শুরু হলো ঝড়। তৈবাসিন এগিয়ে গিয়ে গ্রেনেড মারল। সে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই একটা গুলি এসে লাগে আরসের বুকে। সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গেই সহযোদ্ধা আরস শহীদ হলো।’ কথা বলার এই মুহূর্তে তার চোখে জমে ওঠে জল। কান্নার শব্দ। যেন মাত্রই সহযোদ্ধাকে হারিয়েছেন! একটু থেমে তিনি বললেন। ‘আরস তার বাবা-মাকে দেখার জন্য আমাদের সঙ্গে করে তার এলাকায় এসেছিল। তাকে হারানোয় আমরা দিশেহারা হয়ে পড়ি। আবেগ পেয়ে বশে। কিছুসময় পরে আবার যুদ্ধ শুরু করি। আমাদের লক্ষ্য যেকোন মূল্যে পাকদের এখান থেকে সরাতে হবে। তখন সন্ধ্যা ৭টা। ওদের পক্ষ থেকে আর কোন গুলি নেই। একটা লোক এসে বলল, তারা ভেগে গেছে। আপনারা এগিয়ে যান। আমরা যাইনি। গুলি করতে থাকি রাত ৮টা পর্যন্ত।’ এ পর্যায়ে থেমে থেমে তিনি বলেন। তিনি বললেন, ‘পরে ডেডবডি নৌকায় করে ভাটিপাড়া এসে পৌঁছলাম। আরস আলীকে দাফন করলাম। পরের দিন এক বুড়ো লোক এলো আরস অলীর খোঁজে। তিনি বলতে লাগলেন, আমার ছেলে আরস আলী মুক্তিযুদ্ধে গেছে। আপনারা কেউ খোঁজ জানেন? সঙ্গে সঙ্গেই আমরা হাউমাউ করে কেঁদে উঠি। আরজের বাবা বলতে লাগলেন, বাবারা কেঁদো না। তিনি সহজভাবে কয়েকটা কথা বললেন। বললেন, দেশ স্বাধীন হবে, এরমধ্যেই আমার আরস আলীকে খুঁজে পাব।’ আরজের বাবার এমন কথা শুনে ব্রজগোপালসহ অন্য মুক্তিযোদ্ধারা সাহস পায়। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। তিনি বলেন, ‘তখন মনে হয়েছিল, দেশ স্বাধীন হলে আরজের বাবা ও মাকে দেখতে যাব। পরে আর হয়ে উঠেনি। এখনও আরজের মৃত্যু আমাদের যন্ত্রণা দেয়।’ যুদ্ধে ঠিক কবে এবং কিভাবে অংশ নিলেন এমন প্রশ্নে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘তখন আমি ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র। ফার্স্ট পার্ট পরীক্ষা চলছে। পুরোদমে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি। ২৫ মার্চ ঢাকায় আক্রমণ হলে নেত্রকোনা থেকে ৬০ কি.মি হেঁটে গ্রামের বাড়ি পৌঁছি। গ্রামে আছি। রেডিও শুনি। খবরাখবর রাখছি। এরমধ্যেই সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়ে গেল। মোহনগঞ্জ থেকে নেত্রকোনার রেললাইনের মাঝেমধ্যে উপড়ে ফেলা হয়। গ্রামে থাকা অবস্থায় একদিন দেখি কয়েকশ’ নারী-পুরুষ-শিশু কিশোরগঞ্জ থেকে আসছে। তারা হেঁটে আসে। তারা আমাদের গ্রামের ওপর দিয়ে হেঁটে সীমান্ত পারি দেবে। তাদের আমাদের গ্রামে রাখি। এক রাত থেকে তারা চলে যায়। এতে আমাদের মধ্যে অন্য রকম একটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলো। কিছু একটা করতে হবে। এভাবে থাকা যায় না। এরমধ্যে একদিন বাবাকে সদর উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক প্রয়াত সিদ্দিকুর রহমান তালুকদার বললেন ছেলেকে নিরাপদ জায়গায় পাঠিয়ে দিন। আদতে তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যেতে উৎসাহিত করছিলেন। কারণ তিনি এলাকার ছেলেদের মুক্তিযুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ করতেন।’ পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ উল্লেখ করে ব্রজগোপাল সরকার বলেন, ‘পরে আমরা কয়েকজন সীমান্তের উদ্দেশে রওনা দিই। আমি, আমার দাদা জতিন্দ্র চন্দ্র সরকার, মামা অখিল ভূষণ ভৌমিক, প্রসেন কুমার ভৌমিক, হেমেন্দ্র তালুকদার সীমান্তের কাছাকাছি এক আত্মীয়ের বাড়িতে যাই। দুই একদিন পরে বালাক সীমান্তে যাই। ওইখানে গিয়ে দেখি হাজার হাজার শরণার্থী। খোলা ময়দানে তারা মাঠে ঘুমায়। শরণার্থী শিবিরে ঘোরাঘুরি করতে থাকলাম। হঠাৎ একটা জায়গায় দেখি মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট করা হয়। সেখানে চারজন রেজিস্ট্রেশন করলাম। বন্ধু করল না। সে গ্রামে ফিরে গেল। বালাকে পাশের গ্রামের জয়নাল আবেদীন, নুরু মিয়া, চাঁন মিয়া, সাদেক, মমতাজ উদ্দিন, আব্দুল খালেক ও খোরশেদ মিয়ার সঙ্গে দেখা হয়। সিদ্ধান্ত হয় আমরা একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে যাব। এরমধ্যে একদিন আমাদের খবর দেয়া হলো, আজ বিকেলে ট্রাক আসবে। আমাদের নিয়ে যাওয়া হবে ট্রেনিংয়ের জন্য। বন্ধু বাড়িতে ফিরে বাবাকে খবর দিল আমরা মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছি। ৮০ কিমি হেঁটে বাবা বালাক সীমান্তে এলেন। কিন্তু তার আগেই আমরা ট্রাকে উঠি। বাবা আসার খবর পেয়েছিলাম পরে।’ তিনি বলেন, ‘শিলং ক্যান্টনমেন্টে রাত্রিযাপন করলাম। পরের দিন শিলং থেকে উত্তর দিকে রওনা দিই। ইকো ওয়ান (জারাইন) ক্যাম্পে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়। এর ২০ কিলোমিটারের মধ্যে কোন জনবসতি ছিল না। এই ক্যাম্পে আমরাই প্রথম। কারণ তখন নতুন করে ক্যাম্প তৈরি হচ্ছে। আমাদের দলে ছিল ৫০ থেকে ৬০ জন। ট্রেনিং শুরু হলো। কিছুই নেই। তাঁবু করতে হলো। বাথরুম থেকে শুরু করে রান্না-বান্নার জায়গাও আমরা তৈরি করি। তারপর থেকে ট্রেনিং শুরু। ২৪ দিনের ট্রেনিং। ৬ দিন জঙ্গল অপারেশন। জঙ্গল অপারেশনকে বলা হতো প্যাকটিক্যাল অপারেশন। এখানে একদলকে মুক্তিযোদ্ধা ও অন্য দলকে পাক সেনা সাজিয়ে ট্রেনিং দেয়া হতো। ৩০ দিনের মতো ট্রেনিং নিই।’ ট্রেনিং শেষে তারা দেশে ফিরে অংশ নেন সম্মুখযুদ্ধে। জুনের দিকে তাদের ওপর দায়িত্ব পড়ে সাল্লা থানা ও বিরই এলাকায়। সুনামগঞ্জ থেকে পাকবাহিনী যাতে বিরই না আসতে পারে তাদের বিরক্ত করাই ছিল তাদের দায়িত্ব। এক প্রশ্নের উত্তরে ব্রজপোপাল বলেন, ‘নৌপথে চলাচলে বিভ্রাট ঘটানো ছিল আমাদের মূল লক্ষ্য। বিরাই থেকে আজমেরীগঞ্জÑ এখানেই আমাদের অবস্থান ছিল। উপজেলাগুলো মুক্ত রাখা ও তাদের বাধা দেয়াই আমাদের লক্ষ্য। আগস্টের মাঝামাঝি পাকবাহিনী তাদের অবস্থান শক্ত করে। আমরা ওই এলাকা ছাড়তে বাধ্য হই। সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে পুনরায় বিরাই আক্রমণ করি। ৭২ ঘণ্টা আক্রমণ চলল। এই যুদ্ধে শেষ সমেয় এসে আমি অংশ নিই। কারণ আর্মস নেয়ার জন্য আমাকে ভাটিয়াপাড়া যেতে হয়েছিল। তৃতীয় রাতে ওই এলাকার ভেতরে আটকা পড়া পাকসেনারা নাস্তানাবুদ হয়ে পড়ে। ৪র্থ দিন সুনামগঞ্জ থেকে লঞ্চ ভর্তি মেলিটারি এলো। এই যুদ্ধে তিনদিক থেকে আক্রমণ হয়েছিল। তৃতীয়রাতে তিন পক্ষের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় আমাদের ফিরে যেতে হয়। পরে আমরা তাহেরপুর আক্রমণ করি। এই যুদ্ধে ৪০০ মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেয়। এখানে ভারতীয় বাহিনীও অংশ নিয়েছিল। সকাল থেকে ২টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে।’ তিনি বলেন, ‘নবেম্বরের প্রথমদিকে তাহেরপুর মুক্ত হয়। এসময় আমরা চারদিক থেকে পাকিদের অবরুদ্ধ করে রাখি। তাহেরপুর অবরোধ করে রাখার সময় আমার চোখ দেখানোর জন্য আবার শিলং যাই। তখন আমাকে চশমা পরতে হতো। শিলং থেকে ফিরে শুনি তাহেরপুর মুক্ত হয়ে গেছে।’ তিনি বলেন। এবারও বললেন একটানে। তার ভাষ্যÑ ‘পরে সিলেটের সুনামগঞ্জে অবস্থান করি। আর সিলেটের জামালগঞ্জে থাকা অবস্থায় দেশ স্বাধীন হলে বিজয়ের আনন্দে মেতে উঠি। ডিসেম্বরের শেষদিকে নেত্রকোনায় ফিরে আসি। যে বাসায় থাকতাম এসে দেখি সে বাসার সব লুটপাট হয়ে গেছে। সদর থেকে গ্রামে ফিরে আসি। খালিয়াজুড়ি এলাকায় ৩ দিনের জন্য মিলিটারিরা অবস্থান করলেও ওরা তেমন কোন আক্রমণ করেনি। এটা অনেকটা হাওড় এলাকা। তাই পাকসেনারা আসতে পারত না। এই এলাকা ছিল মিলিটারি মুক্ত। আর এখান দিয়েই যাতায়াত করত মুক্তিযোদ্ধারা। এই এলাকা ছিল রাজাকার মুক্তও।’ স্বাধীনতার এতবছর পর কেমন আছেনÑ এমন প্রশ্নে মুক্তিযোদ্ধা ব্রজগোপাল সরকার (মুক্তি বার্তা নংÑ০১১৬১০০০৮২, গেজেট নংÑ৭৪১ ও সনদ নংÑম ৪৮০৭৭) বলেন, ‘আমি ভাল আছি। খুবই ভাল। আমার জীবনের গৌরবময় অধ্যায় হলো স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
×