ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের প্রস্তুতি

তিস্তা চুক্তি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু করবে ঢাকা-দিল্লী

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৬

তিস্তা চুক্তি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু করবে ঢাকা-দিল্লী

তৌহিদুর রহমান ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগামী ফেব্রুয়ারিতে ভারত সফর সামনে রেখে তিস্তা চুক্তি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু করবে ঢাকা-দিল্লী। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতকে ইতোমধ্যেই বার্তা দেয়া হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর সফরকে অধিকতর কার্যকর ও ফলপ্রসূ করতে হলে তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন করতে হবে। সে কারণে তিস্তা চুক্তিকেই অগ্রাধিকার দিতে চায় ঢাকা। চলতি বছরের ১৮ ডিসেম্বর থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তিন দিনের দিল্লী সফরের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর আপাতত পিছিয়ে দেয়ার জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতকে অনুরোধ করা হয়। উভয়পক্ষের সম্মতিতে এই সফর গত ৮ ডিসেম্বর স্থগিত করা হয়। এরপর আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে শেখ হাসিনার ভারত সফরের প্রস্তুতি চলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর পিছিয়ে দেয়ার পরে তিস্তা চুক্তির বিষয়ে নতুন করে আলোচনা করবে ঢাকা-দিল্লী। এই সফর অধিকতর কার্যকর ও ফলপ্রসূ করতে হলে তিস্তা চুক্তিকেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর পেছানোর পরে ঢাকা-দিল্লী নতুন করে সফরের আলোচনার বিষয় ঠিক করবে। এছাড়া ডিসেম্বরে সফর পেছানোর পরে নতুন করে উভয় পক্ষের হাতে এখন বেশি সময় রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে আলোচনার বিষয়গুলো পুনরায় যাচাই বাছাই করা হবে। তার মধ্যে প্রধান আলোচনার বিষয় থাকছে তিস্তা চুক্তি। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর পিছিয়ে যাওয়ার পরে গত ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এম জে আকবর এক বৈঠক করেছেন। বৈঠকে এম জে আকবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানিয়েছেন, ভারতের সরকার ও জনগণ শেখ হাসিনার সফরের জন্য অপেক্ষা করছেন। এছাড়া বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলে যে কোন সমস্যার সমাধান করা সম্ভব বলেও মন্তব্য করেন ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। শুক্রবার কলকাতায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় সদর দফতর ফোর্ট উইলিয়ামে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন সাবেক আইনমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় আইন সম্পদক আবদুল মতিন খসরু। তিনি আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরেই তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার বিষয়ে আশা প্রকাশ করেছেন। আবদুল মতিন খসরু বলেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং পশ্চিমবঙ্গের মমতার সরকার সক্রিয় ভূমিকা পালন করলে শেখ হাসিনার ভারত সফরেই দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা এই চুক্তি সম্পাদন হবে বলে আশা করি। কারণ ভারত সবসময়ই আমাদের প্রতি ইতিবাচক। তারা কখনোই বাংলাদেশের সঙ্গে শত্রুতাপূর্ণ মনোভাব পোষণ করে না। ভারত আমাদের দুর্দিনের পরীক্ষিত বন্ধু। তাই আমরা আশাবাদী, প্রধানমন্ত্রী যখন ভারতে আসবেন তখন এই চুক্তি হয়ে যাবে। সূত্র জানায়, আগামী ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর সামনে রেখে নতুন করে তিস্তা চুক্তির জট খুলতে কাজ শুরু করবে ঢাকা-দিল্লী। তিস্তা চুক্তি নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে একাধিকবার আলোচনাও হয়েছে। শেখ হাসিনার ভারত সফর সামনে রেখে আবারও তাদের মধ্যে নতুন করে আলোচনা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লী সফরকালে কি কি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে, সে বিষয়েও নতুন করে আলোচনা করবে উভয় পক্ষ। সাধারণ সফরের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে উভয় পক্ষই এই সফরকে একটি ঐতিহাসিক সফর হিসেবে বিবেচনা করতে চায়। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যেই জানিয়েছেন, কোন রকম শর্ত ছাড়াই তিনি দিল্লী সফরে আগ্রহী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চলতি ডিসেম্বরে ভারত সফরে ঢাকার পক্ষ থেকে তিস্তা চুক্তির বিষয়ে জোর দেয়া হয়েছিল। সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের পর তিস্তা চুক্তিকেই প্রাধান্য দিয়ে আসছে ঢাকা। আর ভারতের পক্ষ থেকে সামরিক-নিরাপত্তা সহযোগিতা ও সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে জোর দেয়া হয়েছিল। ঢাকায় ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকরের সফরে সামরিক সহযোগিতার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে ভারত। তবে শেষ পর্যন্ত ডিসেম্বরের সফর স্থগিত হয়ে যায়। আগামী ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর সামনে রেখে এ বিষয়গুলো নিয়ে পুনরায় আলোচনা শুরু করবে উভয় পক্ষ। তিস্তা চুক্তিতে ঢাকার বিশেষ আগ্রহের জন্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লী সফর সামনে রেখে তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নে উদ্যোগী বলে জানিয়েছিল ভারত। সকল পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে বলেও জানিয়েছিল দেশটি। এছাড়া তিস্তা চুক্তির বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতাকেও বিশেষ বার্তা দিয়েছিল দিল্লী। ভারতের কেন্দ্রীয় পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী সঞ্জীব কুমার বালিয়ান গত ২ ডিসেম্বর লোকসভায় একটি বিবৃতিতে জানিয়েছিলেন, ‘তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়ে ভারত সরকার উদ্যোগী। সব পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান সূত্র খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে’। তবে মমতাকে কেন্দ্রীয় সরকারের এমন বার্তা দেয়া হলেও ডিসেম্বরে শেখ হাসিনার সফরে তিস্তা চুক্তির বিষয়ে দিল্লীর সাড়া পায়নি ঢাকা। সূত্র জানায়, তিস্তা চুক্তির বিষয়ে ঢাকার চূড়ান্ত প্রস্তুতি রয়েছে। ২০১১ সালের ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকালেই তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে একটি সিদ্ধান্ত ছিল। সেটিতেই বাংলাদেশের সম্মতি রয়েছে। তাই নতুন করে চুক্তির খসড়া প্রস্তুত করতে হবে না। ভারত চাইলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লী সফরের সময় তিস্তা চুক্তি করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সবচেয়ে বড় দুটি সমস্যার মধ্যে একটি ছিল সীমান্ত চুক্তি, অপরটি তিস্তা চুক্তি। তবে নানা কারণে এই দুটি চুক্তি একসাথে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পরে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে এখনও তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন হয়নি। আর তিস্তা চুক্তির ক্ষেত্রে এক সময় বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এদিকে পশ্চিমবঙ্গকে পাশ কাটিয়ে তিস্তা চুক্তি করতে পারছে না মোদি সরকারও। তাই যেভাবেই হোক মমতাকে রাজি করিয়ে তিস্তা চুক্তি করতে চায় দিল্লী। সেকারণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত বছর ৬ জুন ঢাকা সফরে এলে মমতাকেও সফরসঙ্গী করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মমতা-মোদির একসঙ্গে বৈঠকও হয়। বৈঠকে ভারতের দুই নেতাই তিস্তা চুক্তির বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছিলেন। তবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় রুপীর নোট বাতিলের পরে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন মমতা। সে কারণে তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তবে ঢাকার কূটনীতিকরা বলছেন, তিস্তা ইস্যুতে মমতাকে মোদি কিভাবে ম্যানেজ করবেন, সেটা তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয়। ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয়ে বাংলাদেশের বলার কিছু নেই। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির গত বছর ঢাকা সফরের আগেই বহু আলোচিত তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হবে না, তা আগেই ভারতের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করা হয়েছিল। তখন তিস্তা চুক্তি নিয়ে ধৈর্য্য ধরার পরামর্শ দিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তখন জানিয়েছিলেন, সব কিছু রাতারাতি হয় না। এটা নিয়ে আলোচনা চলছে। মোদির ঢাকা সফরের একদিন আগেই পররাষ্ট্রন্ত্রী বলেছিলেন, তিস্তা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে কূটনৈতিক পর্যায়ে। ডিপ্লোমেসিতে সব কিছু তো পাবলিকলি হয় না। অনেক কিছুই চোখের আড়ালে হয়। তিস্তা চুক্তি নিয়েও আলোচনা চলছে। এটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। ঢাকা সফরে এসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, আমি আত্মবিশ্বাসী যে, ভারতের রাজ্য সরকারগুলোর সহযোগিতায় তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি বণ্টনে সুষ্ঠু সমাধানে পৌঁছতে পারব। আমাদের নদীগুলো দূষণমুক্ত ও নাব্য বজায় রাখতে একসঙ্গে কাজ করব। আমাদের নদীগুলো আমাদের সম্পর্ককে লালন করবে, বিভেদের উৎস হবে না। নদী সীমান্তের দুই পাড়ের মানুষের জীবন ও জীবিকাকে তা প্রভাবিত করে। পানি একটি মানবিক ইস্যু, যা আমরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেব। ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহনের ঢাকা সফরের সময় তিস্তা চুক্তি সই হওয়ার কথা থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শেষ মুহূর্তে আপত্তি তোলায় বিষয়টি আটকে যায়। এর প্রায় সাড়ে তিন বছরের মাথায় গত বছর ২১ ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ঢাকা এসে শীঘ্রই তিস্তার জট খোলার আশা দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এরপর মোদির ঢাকা সফরের সময় মমতারও আসার আলোচনা শুরু হলে তিস্তা চুক্তি নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আবারও বেঁকে বসেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ঢাকা সফরে তিস্তা চুক্তি না করার আশ্বাস দিয়েই প্রধানমন্ত্রী মোদি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে সফরে আসতে রাজি করান। চলতি বছরের ১৬ অক্টোবর ভারতের গোয়ায় ব্রিকস-বিমসটেক আউটরিচ সম্মেলনে যোগদানের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়। সে সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশটি সফরের জন্য শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানান। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত বছর ৬-৭ জুন বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। আসন্ন ভারত সফর হবে মোদি সরকার ক্ষমতায় বসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর। যদিও ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির স্ত্রীর মৃত্যুর সময়ে শেখ হাসিনা সংক্ষিপ্ত সফরে দিল্লী গিয়েছিলেন।
×