ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মামলার তদন্তে নাশকতার রহস্য উদ্ঘাটন হবে ;###;ফ্লাইটসংশ্লিষ্ট প্রতিটি বিষয়ের দৈন্যদশা ধরা পড়েছে

ফৌজদারি মামলা হবে

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৬

ফৌজদারি মামলা হবে

আজাদ সুলায়মান ॥ প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইটের দায়িত্ব পালনে সীমাহীন গাফিলতি ও অবহেলার প্রমাণ মিলেছে। শুধু বিমান ও সিভিল এভিয়েশন নয়, ওই ফ্লাইট সংশ্লিষ্ট প্রতিটি সংস্থারও দৈন্যদশা ধরা পড়েছে। বিমানের ‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউরস (এসওপি)’ ফলো করা হয় নাই। বোয়িং কোম্পানির চেকলিস্টও অমান্য করা হয়েছে। তবে অভিযুক্ত পাইলটদের ব্যবস্থা নেয়ার কোন সুপারিশ নেই প্রতিবেদনে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বহনকারী উড়োজাহাজ যে ‘মনুষ্যসৃষ্ট যান্ত্রিক সমস্যায়’ নাশকতার রহস্য উদ্ঘাটনে ফোজদারী আইনে মামলা করবে সরকার। এজন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে চিঠি দেয়া হবে। বহুল প্রতীক্ষিত এ তদন্ত প্রতিবেদনে বিমানের পরিচালনা পর্যদ থেকে শুরু করে বিমানের টপ টু বটমÑসর্বস্তরেরর কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলা, গাফিলতি আর স্বেচ্চাচারিতার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। বিশেষ করে প্রকৌশল আর ফ্লাইট অপারেশন বিভাগের সর্বক্ষেত্রে কর্মকর্তা-কর্মচারী আর পাইলটদের দায়িত্বে গাফিলতির তথ্য স্পষ্ট হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে পাইলটদের ফ্লাইট পরিচালনার ক্ষেত্রে কোন ধরনের এসওপি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেশন প্রসিডিউর) মানা হয়নি। ইঞ্জিনের অয়েল প্রেসার কমে যাওয়ার সিগন্যাল পাওয়ার পর পাইলটরা বোয়িং কোম্পানির চেক লিস্টকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চরম গাফিলতি ও স্বেচ্ছাচারিতার প্রমাণ দেখিয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিবেদনে প্রকৌশল বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী থেকে শুরু করে শীর্ষ কর্মকর্তাদের অধিকাংশ একটি আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্সের এ ধরনের শীর্ষ পদে যাওয়ার মতো যোগ্য নয় বলে মন্তব্য করা হয়েছে। সম্প্রতি বুদাপেষ্টগামী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফ্লাইটে অয়েল প্রেসারজনিত যান্ত্রিক ত্রুটির ঘটনায় তদন্ত রিপোর্টে এ ধরনের ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। এ ঘটনায় গঠিত বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত রিপোর্ট গতকাল রবিবার পেশ করা হয়েছে। এ রিপোর্ট পাওয়ার পর বিকেল তিনটায় জরুরী এক সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন জানান, প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইট বোয়িং রাঙা প্রভাতের বি-নাট ঢিলায় মানুষের হাত ছিল। এ যান্ত্রিক ত্রুটি মনুষ্য সৃষ্ট। এটা নাশকতা নাকি অদক্ষতাজনিত সে রহস্য উদ্ঘাটন আইনী প্রক্রিয়ায় বের করা হবে। এ জন্য বিমানের ইতোমধ্যে বহিষ্কৃৃত নয় প্রকৌশলীসহ সন্দেহভাজন অন্যদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে। কারণ শেখ হাসিনা শুধু দেশের প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা। বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে। মামলার তদন্তে যদি এ অভিযোগ প্রমাণিত হয় তাহলে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে মামলা দায়ের করে সর্বোচ্চ শাস্তি সুনিশ্চিত করা হবে। তদন্ত কমিটির একজন সদস্য জনকণ্ঠকে জানান, ভিভিআইপি ফ্লাইট নিয়ে এত ছিনিমিনি খেলা হয়- এটা এ ঘটনা তদন্ত না করলে বিশ্বাস করা যেত না। শুধু যে বিমান ও সিভিল এভিয়েশনের স্টাফরাই গাফিলতি করেছে তা নয়, এই ফ্লাইট সংশ্লিষ্ট প্রতিটি সরকারী এজেন্সির কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালনে চরম অপেশাদারিত্ব ও গাফিলতির চিত্র ফুটে উঠেছে। এক সংস্থার সঙ্গে অন্য সংস্থার কোন সমন্বয় ছিল না। সচিবালয়ে বিকেল আয়োজিত এক সংক্ষিপ্ত প্রেস ব্রিফিংয়ে রাশেদ খান মেনন বলেন, মোট দু’শ’ পৃষ্ঠার এ তদন্ত রিপোর্টে মূল কারণ ও সুপারিশ করা হয়েছে ৪৮ পৃষ্ঠায়। বাকিগুলো অন্যান্য সংযুক্তি। মন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী ওই ফ্লাইটের ভিভিআইপি নিরাপত্তা নিয়ে চরম গাফিলতি করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ এবং তিনটি তদন্তের ভিত্তিতে যে সুপারিশটা যুক্তিযুক্ত তা হচ্ছে যে, মনুষ্যসৃষ্ট বিষয়টি নাশকতমূলক কি না তা আইনের আওতায় এনে তদন্ত করতে হবে। আইনী পদক্ষেপ গ্রহণ করে তার জন্য যে শাস্তির বিধান থাকে সেই শাস্তি প্রদান করতে হবে। কেননা ওই ফ্লাইটে হয়ত প্রধানমন্ত্রীর ক্ষতি হয়নি, কিন্তু এর চেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন আর আসতে পারে না। তিনি শুধু সরকার প্রধানই নন, বঙ্গবন্ধুর কন্যা। তার জীবননাশের জন্য বহুবার চেষ্টা হয়েছে। গত ২৭ নবেম্বর হাঙ্গেরি যাওয়ার পথে শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি বোয়িং যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তুর্কমেনিস্তানের আসগাবাদ বিমানবন্দরে জরুরী অবতরণে বাধ্য হয়। ত্রুটি মেরামত শেষে প্রায় ৪ ঘণ্টা পর হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টের উদ্দেশে যাত্রা করে উড়োজাহাজটি। ওই উড়োজাহাজের ইঞ্জিন অয়েলের ট্যাংকের একটি নাট ঢিলে হওয়ার পেছনে নাশকতা ছিল কি না তা খতিয়ে দেখতে ২৮ নবেম্বর পাঁচ সদস্যের কমিটি করে বিমান মন্ত্রণালয়। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষও (বেবিচক) আলাদা তদন্ত টিম গঠন করে। ওই দুই কমিটি আগেই তাদের প্রতিবেদন দিয়েছে। বিমান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব স্বপন কুমার সরকারের নেতৃত্বে গঠিত তৃতীয় তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পরই রাশেদ খান সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন। এতে তিনি বলেন, আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করতে তিনটি কমিটি গঠন করেছিলাম। একটি বিষয় তিনটি তদন্ত রিপোর্টেই এসেছে সমস্ত ঘটনাটি, বিশেষ করে নাট ঢিলা হওয়ার ব্যাপারটি মনুষ্যসৃষ্ট। এটা কি ইন্টেনশনাল নাকি আনইন্টেনশনাল তা তদন্ত কমিটিগুলোর পক্ষে নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে এটা কোন নাশকতামূলক কাজ কি না অথবা আনপ্রফেশনাল কাজ কি না, তা নির্ধারণ করতে হবে। এক্ষেত্রে সামান্যতম নাশকতার প্রমাণ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ঘটনার পর বিমানের প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় এই সংস্থার পাঁচ প্রকৌশলীসহ ছয়জনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এরা হলেন- প্রকৌশল কর্মকর্তা এস এম রোকনুজ্জামান, সামিউল হক, মিলন চন্দ্র বিশ্বাস, লুৎফুর রহমান, জাকির হোসাইন ও টেকনিশিয়ান সিদ্দিকুর রহমান। পরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের তদন্ত কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আরও তিন প্রকৌশলীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। বরখাস্তকৃতরা হলেন- বিমানের চীফ ইঞ্জিনিয়ার (প্রডাকশন) দেবেশ চৌধুরী, চীফ ইঞ্জিনিয়ার (কোয়ালিটি এ্যাসিউরেন্স) এস এ সিদ্দিক ও প্রিন্সিপাল ইঞ্জিনিয়ার (সিস্টেম এ্যান্ড মেইনটেনেন্স) বিল্লাল হোসেন। মন্ত্রী এক প্রশ্নের জবাবে জানান- তিনটি কমিটির প্রতিবেদন সমন্বিত করে তা দুই-এক দিনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর হাতে অথবা তার কার্যালয়ে দেয়া হবে বলেও জানান মেনন। সেখানে (প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়) বসেই সুনির্দিষ্ট করা হবে তাদের নির্দেশ অনুসারে, পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে। তদন্ত রিপোর্টে বিমানের দশটি, সিভিল এভিয়েশনের চারটি দুর্বল পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়। এসব জায়গায় ব্যাপক উন্নতি ও সংস্কারের সুপারিশ করা হয়েছে। এ আলোকে বিমানে কোন পরিবর্তন আনা হবে কিনা জনকণ্ঠের এমন এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, প্রয়োজনে বিমান ঢেলে সাজানো হবে। যদিও মন্ত্রণালয়ের কোন ক্ষমতা নেই। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। মেনন বলেন, তিনটি কমিটি একই ধরনের প্রতিবেদন দিয়েছে। প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়েছে, এ দুর্ঘটনা মনুষ্যসৃষ্ট ছিল। তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশে বিমানের সব কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ জরুরী, স্ট্যান্ডার্ড অপারেশন প্রসিডিওর (এসওপি) আরও যুগোপযোগী করা, ভিআইপি বিমানের নিরাপত্তা জোরদার করতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে মামলা করা হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে বিমানমন্ত্রী বলেন, প্রয়োজনে মামলা করা হবে। যেহেতু শেখ হাসিনা কেবলই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু পরিবারেরও সদস্য তাই বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে মামলা কবে করা হবে তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। যান্ত্রিক ত্রুটির বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। এখানে অন্য কোন ইস্যু কাজ করবে না। তবে কার কার নামে মামলা করা হবে সে বিষয়ে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে মন্তব্য না করে বিষয়টি আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সঙ্গে পরামর্শ করে করা হবে বলে জানিয়েছেন। এ ঘটনায় মন্ত্রী হিসেবে আপনার দায় আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন- এ ঘটনায় আমার নৈতিক দায় আছে। তবে অন্য কোন দায় আছে কিনা তা আপনারা বিবেচনা করবেন। যারা প্রাথমিকভাবে দায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এদিকে এপিবিএন দায়িত্ব পালনে গাফিলতি সম্পর্কে এয়ারর্পোর্ট আর্মড ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক রাশিদুল ইসলাম খান জনকণ্ঠকে বলেন, এপিবিএন-এর দায়িত্ব কতটুকু ছিল আর কতটুকু করেছে সেটা আগে সুনির্দিষ্ট করতে হবে। এপিবিএন-এর দায়িত্ব ছিল ভিভিআইপি ফ্লাইটের ভেতরে ও বাইরে যাতে পাস ব্যতীত কোন ব্যক্তি যেতে না পারে সেটা নিশ্চিত করা। এমনকি এপিবিএন-এর কোন সদস্যও তো ওই ফ্লাইটের ভেতরে যেতে পারেনি। তাহলে কেন আসছে এ প্রশ্ন। রাঙা প্রভাতের বি নাট ঢিলা সংক্রান্ত কাজ করেছে বিমানের প্রকৌশল ও মেকানিক বিভাগ। এপিবিএন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করেছে অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছে। তারপরও এ ঘটনার পর এপিবিএন স্বপ্রণোদিত হয়ে ভিডিও ফুটেজ পরীক্ষা করে দেখেছে পাস ব্যতীত কেউ ওই ফ্লাইটে ঢুকেছে কিনা।
×