ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৬

সুদীর্ঘ ষাট বছরের  বিচিত্র কর্মজীবন

কর্মজীবনের প্রথম অধ্যায় ॥ দ্বিতীয় খ- ষষ্ঠ অধ্যায় দেশে ফিরে পশ্চিম পাকিস্তানে পদায়ন (গতকালের পর) করাচীতে থাকাকালীন আমাকে দুটি শোকানুষ্ঠানে যোগ দিতে হয়। একটি ছিল ব্যারিস্টার এটিএম মোস্তাফার মরদেহ গ্রহণ করে তাকে ঢাকায় পাঠানো আর অন্যটি ছিল আমার শিক্ষক ড. ইতরাত হোসেন জুবেরীর মরদেহ গ্রহণ এবং তার জানাজা অনুষ্ঠান। ব্যারিস্টার মোস্তফা সম্ভবত তখন মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়েছেন; কিন্তু সরকারের পক্ষে কোন সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে বিদেশ যান। তিনি বিদেশে মারা গেলে তার মরদেহ করাচীতে গ্রহণ করে আবার তাকে ঢাকা পাঠানোর ব্যবস্থা আমাকে করতে হয়। অবশ্য এই বিষয়ে তৎকালীন বিদেশ মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক খাজা মোহাম্মদ কায়সরের সহযোগিতা ও নির্দেশনা আমার কাজটি সহজ করে দেয়। মোস্তফা সাহেবের ভগ্নিপতি ছিলেন কলকাতার বিচারপতি সৈয়দ নাসিম আলী সাহেবের পুত্র সৈয়দ মহবুব এবং তিনি সরবরাহ মহাপরিচালকের দফতরে সম্ভবত কোন বিভাগ প্রধান ছিলেন। তার ছোট ভাই হলেন ঢাকার প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী সৈয়দ মনজুর এলাহি। তাদের সঙ্গে এই সময়ে পরিচয় হয় এবং তারা আমার কাজ অনেক সহজ করে দেন। করাচী সিটি কর্পোরেশনে তখন প্রধান নির্বাহী কর্মচারী ছিলেন মাসুদ নবী নূর। তার সঙ্গে আমার ভাল পরিচয় হয় লাহোরে থাকাকালে এবং তখন তার বিয়েতে আমি বরযাত্রী ছিলাম। তার সহায়তা ছাড়া এসব শোকানুষ্ঠান সহজে সম্পাদন করা যেত না। ড. ইতরাত হোসেন জুবেরী ছিলেন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির শিক্ষা বিভাগের একজন নামকরা কর্মকর্তা। তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে চল্লিশের দশকে মুসলমান ছাত্রদের অভিভাবক হিসেবে প্রসিদ্ধ হন। তিনি দেশ বিভাগের পর সিলেট মুরারী চাঁদ কলেজে অধ্যক্ষ ছিলেন। তারপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিভাগের প্রধান হিসেবে হন আমার প্রিয় শিক্ষক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি হন প্রথম উপাচার্য এবং দেশে সামরিক শাসন হলে তিনি পদচ্যুত হন। পরবর্তীতে সম্ভবত তিনি কেন্দ্রীয় শিক্ষা বিভাগে যুগ্মসচিব মর্যাদায় কিছুদিন চাকরি করে অবশেষে পদত্যাগ করে আমেরিকায় অধ্যাপক হয়ে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। হঠাৎ একদিন খবর পেলাম যে তিনি বিদেশে মারা গেছেন। তার বড় ভাই আইসিএস কর্মকর্তা মুসরত হোসেন জুবেরী তখন করাচীতে ছিলেন টেলিযোগাযোগ ও ডাক বিভাগের সচিব। আমি তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি আমার সহায়তা চাইলেন। ইতোমধ্যে ব্যারিস্টার মোস্তফার ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতার ব্যবহার করে আমি বিমানবন্দরে মরদেহ গ্রহণের সব ব্যবস্থা নিই। তার বড় ভাই তার দাফনের ব্যবস্থা করেন। ড. জুবেরীর যে এত ভক্ত ছিলেন তার পরিচয় পাওয়া গেল বিমানবন্দরে ও জানাজায়। ড. জুবেরী সে যুগে ছিলেন ইংরেজী সাহিত্যে মেটাফিজিক্যাল কবিতার বিশেষজ্ঞ। তিনি অত্যন্ত উঁচুমানের শিক্ষক ছিলেন। তিনি প্রস্তুত হয়ে তার ক্লাস নিতেন এবং ক্লাস শেষে কি পড়া বা আলোচনা হলো তার ওপর ছোট নোট দিতেন। তার বিষয়ে তার বক্তৃতা বুঝতে পারলেই সব কাজ হতো, এজন্য অন্য কোন সমালোচকমূলক বই পড়তে হতো না। কোন ক্লাসে শিক্ষকের অবদান মাপার শ্রেষ্ঠ উপায় হলো সার্বিকভাবে পরীক্ষার ফলাফলের মান। আমরা ১২-১৩ জন সহপাঠী আমাদের অনার্স পরীক্ষায় এই বিষয়ে ৩-৪ জন প্রথম শ্রেণীর নম্বর পাই এবং কেউই ৪৫ এর কম নম্বর পায়নি। ড. জুবেরী চলে গেলে আমাদের কোর্স শেষ করতে শিক্ষা দেন অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরদা। তিনি বলতেন, এই কোর্স পড়াতে তাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। করাচীতে সূচনাটিই ছিল ভাল। বাঙালী মহল খুব উৎসাহের সঙ্গে নতুন আগন্তুককে গ্রহণ করল। পরিকল্পনা কমিশনেও পরিবেশ ছিল অন্যরকমের। বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা সেখানে কাজ করতেন এবং তাদের প্রত্যেকেরই কায়দা ছিল নিজস্ব। প্রশাসনে ছিল অনেক বেশি শৃঙ্খলা এবং হুকুম বরদারের প্রতি অধীনস্থ কর্মকর্তাদের অনেকটা ভৃত্যসম আনুগত্য ছিল। সবচেয়ে আনন্দজনক ছিল যে সারা পাকিস্তানে এইটিই ছিল একমাত্র মহানগর যেখানে সহজ সরল জীবনযাপন করা যেত। কে বড় লোক, কে বড় কর্মচারী, কে ক্ষমতাধর রাজনীতিবিদ সেটা সহজে জানা যেত না। তাই কাঁচাবাজারে গেলে বা কোন সাহিত্য বা গানের আসরে বা সিনেমা হলে বা খাবার দোকানে গেলে কোন বিশেষ সেবা পাবার সুযোগ ছিল না। লাইনে দাঁড়িয়ে দোকানে ক্রয়কর্ম সম্পাদন বা কোন প্রসিদ্ধ খাবার দোকানে বসে বা লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার নিয়ে রাস্তায় বা গাড়িতে বসে খাবার খেলে কেউ নজরে নিত না। এই যে ধহড়হুসরঃু বা পরিচিত ব্যক্তি না হওয়ার সুযোগ আমাকে খুব আকর্ষণ করে, বলা যেতে পারে আমি তাতে আহ্লাদিত হই। আমরা প্রায়ই গাড়িতে চড়ে অনির্দিষ্ট গন্তব্যে চলে যেতাম। আমরা করাচীতে থাকতেই সেখানে ড্রাইভ ইন সিনেমা প্রদর্শনী শুরু হলো। তাতে আমাদের আনাগোনা হলো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। আমার মেয়ে ড্রাইভ ইনে যাচ্ছি শুনলেই গাড়িতে তার বালিশ ও চাদর নিয়ে যেত এবং কিছুক্ষণ ছবি দেখে আরামে নিদ্রা যেত। আমাদের দুটি খাবার দোকানের প্রতি দুর্বলতা ছিলÑ একটি ছিল বন্ধু খানের কাবাব পরোটার রেস্তরাঁ। সেখানে প্রধান ব্যবসা তখন ছিল গাড়িতে বসে খাওয়া বা খাবার নিয়ে রাস্তায় কোথাও গাড়ি পার্ক করে গাড়িতে বসে খাওয়া। এখনকার মতো বিরাটকায় বসে খাবার জায়গা বন্ধু খানে তখন ছিল না। আর অন্যটি ছিল ফারুকে মুরগি মোসল্লাম বা চিকেন ফ্রাই খাওয়া। সেখানে বসে খাবার ভাল ব্যবস্থা ছিল তবে গাড়ি সুবিধাজনক স্থানে পার্ক করে খাওয়াও চলত। এছাড়া এলফিন স্টোন ও বন্দর রোডের সংগমস্থলের কাছাকাছি একটি খাবার দোকান ছিল। সেখানেও আমরা বেশ ঢু মারতাম। করাচীর সেজান সবরকম ভাল খাবারের জন্য বেশ প্রসিদ্ধ ছিল। চা বা লাঞ্চের জন্য সেজান ছিল একটি উত্তম রেস্তরাঁ। এসব সর্বত্রই ছিল ধহড়হুসরঃু একটি বিরাট আকর্ষণ। আমার গাড়ী আসলে পরে বড় সমস্যা হল গাড়ী চালনায় ভীতি। আমি প্রায়ই আমার সহকর্মী কাউকে পাশে বসাতাম। পরিকল্পনা কমিশনে আমার দুজন সহকর্মীকে আমিই নিয়ে যাই- ফরিদপুরের মাহবুবে রাব্বানি এবং চাঁদপুরের ড. আব্দুস সাত্তার। (সাত্তার আগেই যায় তবে সে বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে এসে আমার সহকারী হিসেবে যোগ দেয়।) তারা দুজনই অত্যন্ত মেধাবী কর্মচারী ছিলেন। প্রশাসনে দায়িত্ব কিছুদিন পালন করার পর আমি প্রোগ্রামিং বিভাগের দায়িত্ব নিই। প্রায় বছরখানেক প্রশাসনে থাকাকালে কেন্দ্রীয় কর্মকমিশনের সদস্য-সচিব শামসুল হক কোরেশির সহায়তায় এবং আমার ভারপ্রাপ্ত সচিব মুজাফর আহমদের পৃষ্ঠপোষকতায় আমি প্রায় চারশত কর্মচারীদের স্থায়ী পদে নিযুক্তি দিই এবং বহুদিন ধরে বন্ধ করা পদোন্নতি প্রদান নিশ্চিত করি। নিযুক্তির ক্ষেত্রে ৪০+৪০+২০ ফর্মুলা প্রয়োগ করে আমি বাঙালি ভালমন্দ কর্মচারীদের উচ্চপদে উন্নীত করার সুযোগ পাই। দুইটি আটকেপড়া নিযুক্তিরও সমাধান করি। পরিকল্পনা কমিশনের বড় কর্তা ডেপুটি চেয়ার সাইদ হাসান ব্রিটিশ আমলের হিসাব রক্ষণ ও হিসাব পরিবীক্ষণ সার্ভিসের কর্মকর্তা ছিলেন। ওহফরধহ অঁফরঃ ্ অপপড়ঁহঃং ঝবৎারপব বা ওঅঅঝ এর সদস্য ছিলেন তিনি এবং নিশ্চয়ই অত্যন্ত উৎকৃষ্ট কাতারের কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি কোন এক সময়ে ঊপড়হড়সরপ ঢ়ড়ড়ষ এর সদস্য হোন। চলবে...
×