ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

একাত্তরের ডিসেম্বর ॥ গৌরবের পথপরিক্রমা

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৬

একাত্তরের ডিসেম্বর ॥ গৌরবের পথপরিক্রমা

একাত্তরের ডিসেম্বর প্রতিবারের মতো এবারও আমাদের অগ্নিঝরা সেই নয় মাসের তিক্ত অভিজ্ঞতার স্মৃতির মুখোমুখি দাঁড় করায়। পাশাপাশি অর্জনের আনন্দঘন এক স্মৃতিময় অধ্যায়ের দিকটাও তুলে ধরে। এক রক্তস্নাত দুর্গমপথ পেরোনোর দুঃসহ অভিযাত্রার সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে বিজয় আর গৌরবের এক আলোকোজ্জ¦ল পথপরিক্রমা। নয় মাসের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ এবং অধিকার আদায়ের সুবর্ণ সময়গুলো যতই তাৎপর্য বহন করুক না কেন, এর একটি পরিচ্ছন্ন পটভূমি ছাড়া মাসটির মাহাত্ম্য বোঝা সহজ হয় না। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ’৪৭-এর দেশবিভাগ আসলে উপমহাদেশের ভাগ্যবিড়ম্বিত জনগণের যথার্থ কোন ঠিকানা দিতে পারেনি। ব্রিটিশ উপনিবেশের করাল গ্রাসমুক্ত হয়ে পুনরায় পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর নব্য উপনিবেশের রোষানলে পড়ে আমাদের এই দেশটি। অসংখ্য মানুষের জীবনে নেমে আসে অবর্ণনীয় দুর্দশা। ‘সংখ্যালুঘ’ নামে একটি অনাকাক্সিক্ষত, অবাঞ্ছিত শব্দের উদ্ভব হয়। তা যেমন অমানবিক, একইভাবে বঞ্চনারও করুণ আখ্যান। ফলে ধর্মীয় সম্প্রদায়গত এই বিভাজন সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর যথার্থ কোন দিকনির্দেশনা তো দিতেই পারেনি, বরং শাসক বদলের পালাক্রমে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বলয়ে নেমে আসে দুর্যোগের ঘনঘটা। প্রসঙ্গত, ‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের কিছু বক্তব্য উল্লেখ করা যায়Ñ ‘যে দেশে শুধুমাত্র ধর্মের মিলেই মানুষকে মেলায় অন্য কোন বাঁধন তাকে বাঁধতে পারে না সে দেশ হতভাগ্য। সে দেশ স্বয়ং ধর্মকে দিয়ে যে বিভেদ সৃষ্টি করে সেইটে সকলের চেয়ে সর্বনেশে বিভেদ। মানুষ বলেই মানুষের যে মূল্য সেইটেকেই সহজ প্রীতির সঙ্গে স্বীকার করাই প্রকৃত ধর্ম-বুদ্ধি। যে দেশে ধর্মই সে বুদ্ধিকে পীড়িত করেছে রাষ্ট্রিক স্বার্থবুদ্ধি কি সে দেশকে বাঁচাতে পারে।’ আসলে পারেনি। মাত্র ২৪ বছরের মধ্যে ভৌগোলিক থেকে শুরু করে সব ধরনের স্বাধীনতা অর্জন রবীন্দ্রনাথের এই উক্তির যথার্থতা প্রমাণ করে। আমরা জানি, ’৪৮ সালে উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা দেয়ার প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিরোধের যে আগুন জ্বালিয়েছিলেন সেটাই ছিল ভাষা আন্দোলনের মহান ভিত্তি। এত গেল সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। আর ব্রিটিশ প্রবর্তিত ভূমি ব্যবস্থার আদৌ কি কোন রদবদল হয়েছিল? উৎপাদনের মূল হাতিয়ার ভূমির সাবেকী আমলের সমস্ত জোতদারী নিয়ম-কানুন সবই বহাল ছিল, ফলে ভূমির সাথে সম্পৃক্ত সিংহভাগ কৃষকের অসহায় অবস্থা আরও বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। ১৯৫০ সালে ভূমি-সংস্কার আইন হলেও তা ভূ-স্বামীদের পক্ষেই যায়। অবহেলিত, বিপন্ন জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে তেমন কোন প্রভাবই পড়েনি। এরই মধ্যে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার দাবিতে সারাবাংলা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক ঘটনা স্মরণীয় হয় রক্তঝরা পথ বেয়ে। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারের রক্তবিধৌত ২১ ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে আপন মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। এর পর পরই ঘটে যায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট, ’৬১তে রবীন্দ্র্র জন্মশতবার্ষিকীতে রবীন্দ্র বিরোধিতার প্রতিবাদে জোরালো আন্দোলন যা জন্ম দেয় ছায়ানটের মতো সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের। ’৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন কর্মসূচী এবং ’৬৬ সালে ছয় দফার রূপরেখা যা বাঙালীর স্বাধিকার আন্দোলনের এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ’৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, যা বঙ্গবন্ধুসহ তার নিকটতম সহযোগীদের বিরুদ্ধে এক নেতিবাচক আইনী প্রক্রিয়া। অবশ্য পরে এই মামলা থেকে সবাই অব্যাহতি পান। ’৬৯-এর সাড়া জাগানো সেই গণঅভ্যুত্থান সারাবাংলাকে কাঁপিয়ে দেয়, যার সুস্থ এবং কাক্সিক্ষত পরিণতি রূপে আসে ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সেই সময়ের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি বিশিষ্ট মাইলফলক। বাঙালীর এই অভূতপূর্ব বিজয়ে পাকিস্তানী সামরিকজান্তা পড়ে বিপাকে। আর তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের নানান টালবাহানা। একাত্তরের প্রথম থেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের একগুঁয়েমিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কোন পর্যায় শুরুই হতে পারেনি। শাসন ক্ষমতা দেয়া তো দূরের কথা, স্বায়ত্ত শাসনের প্রশ্নেও কোন সমঝোতায় আসা যায়নি। এমন রাজনৈতিক টানাপোড়েনে এসে যায় সেই অগ্নিস্নাত, তাৎপর্যপূর্ণ মার্চ মাস। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর একতরফা আলোচনার সিদ্ধান্তে বঙ্গবন্ধুও দাবি আর অধিকার আদায়ের প্রশ্নেœ অনড়, অটল থাকেন। উপায়ন্তর না দেখে জঙ্গী সামরিক, শাসকগোষ্ঠী এ দেশের রাজপথে সৈন্যবাহিনীর মহড়া শুরু করে দিয়ে নিরীহ, নিরপরাধ জনগণের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন চালায়। তারপরও বঙ্গবন্ধু তার সংকল্পে অনড় থাকেন। শাসকগোষ্ঠীর এমন অপশাসনের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষণা করেন। এরপর আসে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের সেই যুগ-সন্ধিক্ষণ। যা বাঙালীর জাতীয় জীবনে এক অবিস্মরণীয়, গৌরবদীপ্ত অধ্যায়। যেখান থেকে নির্ধারিত হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের মতো এক সংগ্রামী স্রোতধারার, বঙ্গবন্ধুর সেই বজ্রকণ্ঠ আজও সারা বাংলাকে কাঁপায়। ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, তোমাদের যার যা আছে তা নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা কর। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইন্শাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই অগ্নিঝরা ভাষণে উদ্বেলিত, আন্দোলিত হয় সমগ্র বাঙালী। দেশব্যাপী শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলনের উত্তাল কর্মসূচী। নিয়ম মাফিক বিধি নিষেধের ব্যত্যয় ঘটানো হয়। বেপরোয়া পাকিস্তানী সামরিক শাসকরাও তাদের একমাত্র মারণাস্ত্র সশস্ত্র সেনাবাহিনী। যারা নিরস্ত্র নিরীহ বাঙালীর ওপর প্রতিশোধের স্পৃহায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু শর্ত সাপেক্ষে এই অসহযোগ আন্দোলন তুলে নেয়ার কথা বললেও পাকিস্তান সরকার তা নাকচ করে। যার চূড়ান্ত রক্তাক্ত ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয় ২৫ মার্চের কাল রাতে। ২৫ মার্চের তাৎপর্য বহুমাত্রিক। শুধু রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র অভিযানই নয়, আরও এক অবিস্মরণীয় ঘটনা আজও বাঙালীকে উদ্দীপ্ত করে- বঙ্গবন্ধু কর্র্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণা, যা মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি সংগ্রামী ঐতিহ্যকে তার গতিপথ ঠিক করে দেয়। এর সাথে যুক্ত হয় ভিন্ন মাত্রার এক অসহনীয় বেদনাঘন যন্ত্রণাÑ পাকিস্তানী শাসক কর্তৃক বঙ্গবন্ধুকে আটক করা আর সেই রাতেই বিমানে তাঁকে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া। ২৫ মার্চের রাতে ঘুমন্ত, নিরীহ বাঙালীর ওপর গণহত্যার যে রক্তাক্ত তা-ব শুরু হয় তা আজও ইতিহাসের নিকৃষ্টতম অধ্যায়। নয় মাসের অদম্য অস্থিরতায় সারা বাংলা যখন বিপর্যয়ের মুখে তখন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করেই ক্ষান্ত ছিল না তারা দেশব্যাপী চালায় এক বিভীষিকাময় ত্রাসের রাজত্ব। নির্বিশেষে গণহত্যা, বাসস্থানে অগ্নিসংযোগ এবং অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমহরণের যে নারকীয় তা-ব তা আজ অবধি সভ্যতার চরম অপমান, মানবতার নিষ্ঠুর লঙ্ঘন। বাস্তুহারা হাজার হাজার নিঃস্ব, সর্বস্বান্ত জনগোষ্ঠী ভারতীয় সীমান্তে আশ্রয় নেয়। মুক্তিযোদ্ধাসহ ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তভেজা পথপরিক্রমায় স্বাধীনতার সূর্যের দেখা মেলে। সম্ভ্রমহানি হয় দু’ লাখ মা বোনের। পরাজয় নিশ্চিত জেনে উন্মত্ত, বেপরোয়া সামরিক সরকার উ™£ান্তের মতো নতুন আর এক হত্যাযজ্ঞের লীলা শুরু করে দেয়। ১৪ ডিসেম্বর তাদের সর্বশেষ কামড়ে ক্ষত-বিক্ষত হয় এদেশের জ্ঞানী-গুণী-প-িত ব্যক্তিরা। অনেকের লাশ খুঁজেও পাওয়া যায়নি। নিখোঁজদের অনুমানেই মৃত ধরা হয়। একটি দেশকে ধ্বংস করতে হলে সে দেশের লাইব্রেরিকে শেষ করতে পারলেই যথেষ্টÑ এই আপ্তবাক্যটি মোটা মাথার পাকিস্তানীদের যেভাবেই হোক উদ্বুদ্ধ করেছিল। যে উন্মাদনার শিকার হয় এদেশের খ্যাতিমান বিজ্ঞজনেরা। সেই বিজয়ের মাস, শ্যামল বাংলায় রক্তের আল্পনা আঁকা ডিসেম্বর মাস আজও নীরব আর্তিতে আমাদের মূহ্যমান করে, বেদনাঘন আবেগে আমরা তাড়িত হই, ক্ষমার অযোগ্য সেসব নরপশুর বিরুদ্ধে আমাদের ক্ষোভ, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ নতুন উদ্যমে জেগে ওঠে। এই বিজয়ের মাসে, পতাকা অর্জনের মহিমান্বিত এই ডিসম্বর মাসে আমাদের আবারও বলিষ্ঠ শপথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবেÑ রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এই স্বাধীনতাকে কোনভাবেই বিপর্যয়ে মুখে ঠেলে দেয়া যাবে না। যে কোন মূল্যের বিনিময়ে, সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় স্বাধীনতার সুরক্ষায় অতন্দ্র প্রহরীর মতো সতর্ক থাকতে হবে। প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হেনরি নেভিনশনের একটি মূল্যবান বাণী স্মরণ করা যেতে পারে। ‘প্রেমের মতো স্বাধীনতাকেও আমাদের প্রতি মুহূর্তে জয় করতে হয়, প্রতিবার জয়ের পর নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থেকে যেমন প্রেমকে হারাতে বসি, স্বাধীনতাকেও সেভাবে হারাতে হয়। স্বাধীনতার যুদ্ধ কোনদিনই শেষ হয় নাÑ এই সংগ্রাম নিরন্তর চলতে থাকে।’
×