ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বেসরকারী ও বিদেশী ব্যাংকের অবস্থান ভাল

আইটি খাতে ভেতরে-বাইরে ঝুঁকি আছে

প্রকাশিত: ০৫:০০, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৬

আইটি খাতে ভেতরে-বাইরে ঝুঁকি আছে

সরকারী ব্যাংকের অবস্থা খুবই খারাপ অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ কয়েকটি ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে এটিএম বুথের সংখ্যা বাড়ছে না বলে মনে করেন গবেষকরা। এ বিষয়ে নীতিগত পরিবর্তন আনা দরকার দাবি করে তারা বলছেন, আইটি খাতে ভেতরে-বাইরে ঝুঁকি আছে, বিশেষ করে ব্যাংকের ডাটার নিরাপত্তা দিতে হবে। সার্বিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিগত সহায়তা আরও বাড়ানো প্রয়োজন। রবিবার বিআইবিএমে আয়োজিত আইটি বিষয়ক এক সেমিনারে গবেষকরা এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সেমিনারটি উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান। বিআইবিএমের মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরীর সঞ্চালনায় ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবুল কাশেম মোঃ শিরিন, ব্যাংক এশিয়ার প্রেসিডেন্ট ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ আরফান আলী, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ইয়াসিন আলীসহ বিভিন্ন ব্যাংকের আইটি বিভাগের প্রধানরা অনুষ্ঠানে অংশ নেন। সেমিনারে ‘ব্যাংকের ব্যবসা ও মুনাফা বৃদ্ধিতে আইসিটির প্রভাব’ শীর্ষক একটি গবেষণা উপস্থাপন করা হয়। গবেষণাপত্রটি তৈরি করেছেন বিআইবিএমের সহযোগী অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান আলম, শিহাব উদ্দিন খান ও সহকারী অধ্যাপক কানিজ রাব্বি। বিআইবিএমের সহযোগী অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান আলম বলেন, বেসরকারী ও বিদেশী ব্যাংক ভাল অবস্থানে আছে। কিন্তু সরকারী ব্যাংকের অবস্থা খুবই খারাপ। অনেক ক্ষেত্রে সরকারী ব্যাংক বেসরকারী ব্যাংকের এজেন্ট হয়ে কাজ করছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের উপমা দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের প্রচুর গ্রাহক গ্রামে। কিন্তু ব্যাংকটি অনলাইনভিত্তিক না হওয়ায় বেসরকারী ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বিকাশের এজেন্ট হয়ে কাজ করছে। এটা হতাশাজনক ও লজ্জাকর বিষয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান বলেন, আইটি ছাড়া ব্যাংকিং কল্পনা করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আগামীর ব্যাংকিং হবে পুরোপরি আইটিনির্ভর। সেজন্য আইটি খাতকে আরও গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান জানান তিনি। ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবুল কাশেম মোঃ শিরিন বলেন, অনলাইন ব্যাংকিংয়ের কারণে কস্ট অব ফান্ড কমেছে। আগে ১০০ টাকা সংগ্রহে ৬ টাকা খরচ হতো, এখন মাত্র ২ টাকা। তিনি বলেন, কয়েকটি ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে এটিএম বুথের সংখ্যা বাড়ছে না। এ বিষয়ে নীতিগত পরিবর্তন আনা দরকার। তিনি বলেন, আইটি খাতে ভেতরে-বাইরে ঝুঁকি আছে, বিশেষ করে ব্যাংকের ডাটার নিরাপত্তা দিতে হবে। সার্বিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিগত সহায়তা আরও বাড়ানোর দাবি জানান তিনি। ব্যাংক এশিয়ার এমডি আরফান আলী বলেন, মাত্র ৩২ ভাগ লোকের ব্যাংক এ্যাকাউন্ট আছে। পেপারলেস ব্যাংকিং করতে হলে প্রত্যেক ব্যক্তির একটি করে ব্যাংক এ্যাকাউন্ট থাকতে হবে। ব্যাংকিং খাতকে ডিজিটালাইজেশন না করলে কী কী ক্ষতি হতে পারে তা ভাবার সময় এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ইয়াসিন আলী বলেন, আইসিটি ছাড়া ব্যাংকিং হবে না। তবে এ খাতের উন্নতির জন্য গ্রুপিং বাদ দিতে হবে। ব্যাংকগুলোতে বিজনেসের লোকেরা এক গ্রুপ। অন্য গ্রুপ হলো আইটি খাতের লোকেরা। এখানে সমন্বয় দরকার বলে মনে করেন তিনি। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রথাগত ব্যাংকিং মাধ্যমে এখন বছরে গড়ে ১৭০ কোটি বার লেনদেন হচ্ছে আর আইসিটির কারণে অনলাইনে ২০০ কোটি বারের বেশি লেনদেন হচ্ছে। প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে ব্যাংক খাতের একজন কর্মী এখন বছরে গড়ে ১০ হাজার লেনদেন সম্পন্ন করছেন। ২০০০ সালের আগ পর্যন্ত ব্যাংকের একজন কর্মীর গড় লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৫ হাজারের কম। অর্থাৎ প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গত দেড় দশকে ব্যাংকের কর্মীদের কর্মদক্ষতা দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। আইসিটিতে বিনিয়োগ করা ব্যাংক খাতের জন্য কতটুকু লাভজনক, মূলত সে বিষয় সামনে রেখে গবেষণাটি করা হয়েছে। গবেষণার প্রাথমিক তথ্যউপাত্ত ২১টি ব্যাংক থেকে নেয়া হয়েছে। আর সেকেন্ডারি বা প্রকাশিত তথ্যউপাত্ত আর্থিক খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এছাড়া ব্যাংক ও আইসিটির বিষয়ে গ্রাহকের মতামত জানতে দেশব্যাপী ৫০০ জন লোকের সাক্ষাতকারও নেয়া হয়েছে। ব্যাংকের আইসিটি খাতে এক টাকা খরচ করলে তা কতটা মুনাফা নিয়ে আসে, সে বিষয়টিও গবেষণায় তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, আইসিটিতে ১ টাকা বিনিয়োগ করলে ব্যাংকের জন্য তা ১৩৬ টাকার সমান উৎপাদনশীলতা তৈরি করে। এর বিপরীতে প্রযুক্তিবহির্ভূত খাতে ১ টাকা খরচ করলে সেটি ৫৮ টাকার সমপরিমাণের উৎপাদনশীলতা নিয়ে আসে। একই ভাবে আইসিটি বিষয়ে জ্ঞান আছে এমন একজন কর্মীর পেছনে ১ টাকা খরচ করলে ব্যাংকের আয় বাড়ে ২৫ টাকার সমান। সাধারণ একজন কর্মীর পেছনে এক টাকা খরচ করা হলে ব্যাংকের আয় বাড়ে ৬ টাকা। অর্থাৎ আইসিটিতে দক্ষ একজন কর্মীর পেছনে ব্যাংকের বিনিয়োগ চারগুণ বেশি লাভজনক। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯০ সালের পর থেকে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে ধীরে ধীরে আইসিটির ব্যবহার শুরু হয়। সে সময় ব্যাংকের একজন কর্মী গড়ে ৪১ কোটি টাকা লেনদেন করতেন। সেটি ২০১৫ সালে প্রায় চারগুণ বেড়ে ১৬০ কোটি টাকা হয়েছে। অর্থাৎ লেনদেন সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে একজন কর্মীর আর্থিক লেনদেনের দক্ষতাও এ সময়ে প্রায় চারগুণ বেশি বেড়েছে। কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যাংকের মুনাফাও এ সময় বেড়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ১৯৯০ সালে বেসরকারী ও বিদেশী খাতের ব্যাংকগুলো মুনাফা করলেও সরকারী ব্যাংকের লোকসানের কারণে সামগ্রিক ব্যাংক খাত লোকসানের মধ্যে ছিল। সে অবস্থা থেকে ২০০০ সালে ব্যাংক খাতের গড় মুনাফা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫৫ কোটি টাকায়। এ মুনাফা ২০১৫ সালে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
×