ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বন্দরে মাইন অপসারণের সময় নিহত রেডকিনকে কর্ণফুলী তীরে কবর দেয়া হয়েছিল

চট্টগ্রামে রেডকিনের সমাধিতে রুশ প্রতিনিধিদের শ্রদ্ধা

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৬

চট্টগ্রামে রেডকিনের সমাধিতে রুশ প্রতিনিধিদের শ্রদ্ধা

মোয়াজ্জেমুল হক/হাসান নাসির ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়াও যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশকে একটি কার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। মহান মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা দিতে গিয়ে যেমন প্রাণ হারিয়েছেন ভারতীয় বহু সেনা সদস্য তেমনি যুদ্ধোত্তর সময়ে দেশের বৃহত্তম বন্দর চট্টগ্রাম বন্দরকে সচল করতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে টানা প্রায় দুই বছর ডুবন্ত নৌযান ও মাইন অপসারণের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে অংশ নেন রুশ সশস্ত্র বাহিনীর ৮শ’ সদস্য। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে একপর্যায়ে এই বন্দর সচল হয়ে স্বাভাবিক রূপ ফিরে পায়। কিন্তু দুঃসাহসিক এ কাজে অংশগ্রহণ করে চিরতরে হারিয়ে গেছেন সেই দলের তরতাজা একটি প্রাণ নাবিক ইউভি রেডকিন। স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশকে পুনর্গঠনে প্রত্যক্ষভাবে এগিয়ে আসে সোভিয়েত ইউনিয়ন। মুক্তিযুদ্ধে অপারেশন জ্যাকপট-এ চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেলে নৌ কমান্ডোরা ডুবিয়ে দেয় বিপুলসংখ্যক নৌযান। যার মধ্যে ছিল পাকিস্তান থেকে আসা মাইনসহ সমরাস্ত্র বোঝাই নৌযানও। ফলে চট্টগ্রাম বন্দর অচল ছিল দীর্ঘ সময়। এ অচলাবস্থা থেকে উত্তরণে সোভিয়েত সরকার বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে এগিয়ে আসে। শুরু করে বন্দরকে সচল করার দুরূহ ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। এতে অংশ নেয় ৮ শতাধিক প্রশিক্ষিত নাবিক। মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন ভারত সরকারের বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ্যপূর্ণ কর্মকা-ের প্রতি দ্ব্যর্থহীন সমর্থন জানায় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। এরই ধারাবাহিকতায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রুশ নৌ সেনারা চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেলে পরিচালনা করেন মাইন অপসারণ কার্যক্রম। এ সময় মাইন বিস্ফোরণে এক রুশ নাবিকের প্রাণ হারানোর দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। তার নাম ইউ ভি রেডকিন। প্রয়াত রেডকিনের স্মৃতি ধরে রাখতে কর্ণফুলীর মোহনা সংলগ্ন তীরে তৈরি হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। (যা বর্তমানে বাংলাদেশ নেভাল একাডেমির নিরাপত্তা এলাকার অভ্যন্তরে) বিজয়ের ৪৫তম বার্ষিকীতে সেই মাইন অপসারণকারী নাবিকদের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসে সরকারের আমন্ত্রণে। শনিবার তারা নেভাল একাডেমিতে এসে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন নিহত রুশ নাবিকের সমাধিতে। নৌবাহিনীর জনসংযোগ বিভাগ সূত্রে জানানো হয়, ৮ সদস্যের রুশ প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ নেভাল একাডেমির অভ্যন্তরে অবস্থিত সেই রুশ নাবিক রেডকিনের সমাধি পরিদর্শন ও বেদিমূলে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে। এই প্রতিনিধি দলে সস্ত্রীক ছিলেন কজুরিন ভিক্টর পাভলভিচ, কারামিশেভ ভøাদিমির আলেকজান্দ্রোভিচ, সুকানিন আলেকজান্ডার কুজমিক, কলোসকভ নিকোলে নিললায়েভিচ। এ সময় প্রতিনিধি দলের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রামের রুশ কনসাল জেনারেল ওলেগ বয়কো, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর পক্ষে চট্টগ্রাম নেভাল এরিয়া কমান্ডার কমোডর এম আবু আশরাফ, সোভিয়েত এলামনাই এ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক স্থপতি আশিক ইমরান, নৌ ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যবৃন্দ। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য স্মৃতিচারণে অংশ নেন নিহত রেডকিনের ওই সময়ের চার সহযোগী। এই সময় তারা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। স্মৃতিচারণে তারা নিহত রেডকিনের অসীম সাহসিকতার ভূয়সী প্রশংসা করে আত্মার শান্তি কামনাও করেন। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন অসামান্য অবদান রাখে। জাতিসংঘে ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ এবং অস্ত্র সরবরাহসহ প্রায় সর্বক্ষেত্রেই সমাজতান্ত্রিক ওই দেশটির ভূমিকা ছিল প্রত্যক্ষ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া বাংলাদেশকে কার্যকর করার ক্ষেত্রেও সক্রিয় ভূমিকা ছিল দেশটির। সেই অবদানের কথা বাংলাদেশের মানুষ এখনও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে। মাঝে কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি হলেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ায় রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উষ্ণতায় রূপ নিয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেলে নিমজ্জিত হয়েছিল ছোট বড় চল্লিশটিরও বেশি জাহাজ। এরমধ্যে গোলা বারুদ ও মাইনভর্তি জাহাজও ছিল। ধ্বংস হয়ে যায় বন্দরের ১৮ মুরিংয়ের মধ্যে ১২ মুরিং। মাইন ও বিস্ফোরকের কারণে জাহাজ চলাচলে প্রচ- রকমের ঝুঁকির সৃষ্টি হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধে বন্দর চ্যানেল থেকে মাইন অপসারণে এগিয়ে আসে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেলে ডুবে যাওয়া সকল জাহাজ উদ্ধার ও মাইন অপসারণের সফল কর্মকা- শেষে ফিরে যাবার পূর্বে অসাধারণ কর্মকা- সম্পন্নকারী সেই সোভিয়েত নাবিক দলকে সংবর্ধনা দেয়া হয় রাষ্ট্রীয়ভাবে। সেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আবেগময় বক্তব্য দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নাবিকদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞতা জানান। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে দেশের বৃহত্তম বন্দরকে সচল ও সব ধরনের নৌযান চলাচল উপযোগী করতে নিঃশর্তভাবে সোভিয়েত সরকারের সাড়া দানের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এই দুরূহ কাজে সোভিয়েত ইউনিয়ন সাড়া না দিলে সদ্য স্বাধীনতা লাভকারী বাংলাদেশকে অত্যন্ত জটিল অবস্থার মুখোমুখি হতে হতো। সোভিয়েত নৌবাহিনীর ৮শ’ নাবিক অংশ নেয় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মাইন অপসারণ কার্যক্রমে। এর নেতৃত্বে ছিলেন রিয়ার এ্যাডমিরাল স্তানিচলাভ জুয়েনকো। এই নাবিকদের বেশিরভাগই ছিলেন রাশিয়ার প্যাসিফিক ফ্লিটের। কার্যক্রম শুরুর তিনমাসের মধ্যে সচল হয় চট্টগ্রাম বন্দর। মাইন অপসারণ চলে দুই বছরেরও বেশি সময়। রাশিয়ান নাবিকদের ভূমিকায় দুই বছরের মধ্যে বন্দর পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্ত হয়। ১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর বন্দর এলাকায় মাইন অপসারণকালে বিস্ফোরণে নিহত হন রুশ নাবিক ইউ ভি রেডকিন। তাঁর মরদেহ আর রাশিয়ায় নেয়া হয়নি। দু’দেশের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় কর্ণফুলী তীরে নেভাল একাডেমিতে। সেখানে নির্মাণ করা হয় একটি স্মৃতিস্তম্ভ। মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে রুশ নাবিকদের এই টিমটি সরকারের আমন্ত্রণে বাংলাদেশে আসে। সরকারের পক্ষ থেকে তাঁদের সম্মাননা প্রদান করা হয়। শনিবার তারা নেভাল একাডেমিতে রেডকিনের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বিকেলে চট্টগ্রাম ত্যাগ করেন।
×