ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আনন্দ-বেদনার ‘স্বাধীনতা মঞ্চ’

ইতিহাসের ঠিকুজি একের মধ্যে বারো...

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৬

ইতিহাসের ঠিকুজি একের মধ্যে বারো...

মোঃ হারেজুজ্জামান হারেজ ॥ একটি স্মৃতিস্তম্ভ। বড়ই করুণ তার অন্তরালের কাহিনী। এটি যুগ যুগ ধরে বহন করে আসছে দেশ ও জাতির নানান ইতিহাস-ঐতিহ্য। এর নেপথ্যে লুকিয়ে রয়েছে একাধিক ঐতিহাসিক ঘটনাবলী। বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলার সান্তাহারে ২০১৫ সালে নির্মিত হয় এই স্মৃতিস্তম্ভ। তখন থেকে এই স্তম্ভ বহন করে আসছে সেই ১৭৫৭ সালের ঐতিহাসিক পলাশীর যুদ্ধ এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের নানান ইতিহাসের নমুনা। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর বজ্রকঠিন ভাষণে স্বাধীনতার ডাক দেয়ার পর থেকে দেশের অন্যান্য স্থানের মতো বগুড়ার জংশন শহর সান্তাহারও হয়ে যায় ইতিহাসের অংশ। বিহারী অধ্যুষিত এই শহরের প্রায় ২৫ হাজার অবাঙালী তাদের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী মরণকামড় দেয়। বিহারীরা অবাধে শহরে শুরু করে বাঙালী নিধন কর্মকা-। কিন্তু শেষপর্যন্ত সফল হতে পারেনি। তাদের হত্যাযজ্ঞে ভীত না হয়ে সেদিন বরং ঘুরে দাঁড়ায় বাংলার অকুতভয় স্বাধীনতাকামী দামাল ছেলেরা। নির্যাতিত বাঙালীরা পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলে অর্ধ মাসের মধ্যে নিধন করে ফেলে বিহারী জনগোষ্ঠীকে। বাঙালীর এই বীরত্বগাথা সেদিন ফলাও করে প্রচার করে বিবিসি বাংলা রেডিও। এ ঘটনার মাধ্যমেই সান্তাহার শহরের নাম ঠাঁই পায় ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও অর্থাৎ ২০১৫ সাল পর্যন্ত কেউ এই শহরে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কথা চিন্তাও করেননি। সময়ের বিবর্তনে বিষয়টি হতাশ করে তোলে বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে। তারা এ নিয়ে ভাবতে থাকে। যেমন ভাবনা তেমনই কাজ। আদমদীঘি উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মোঃ সাজেদুল ইসলাম চম্পার ওপর দায়িত্ব পড়ে নক্সা তৈরির। তরুণ লেখক সাজেদুল ইসলাম চম্পা ‘একের মধ্যে অনেক’-এই তত্ত্ব মাথায় নিয়ে বাংলার স্বাধীনতার ইতিহাস সন্নিবেশিত করে তৈর করেন নক্সা। কিন্তু সেটি কোথায় নির্মাণ করা হবে এবং এত টাকা কোথা থেকে আসবেÑ এ ভাবনা পেয়ে বসে তাদের। এমন সময় রেলভিত্তিক সান্তাহার শহরের রেলওয়ে লেভেল ক্রসিংয়ের ভেতর ‘ঠক্কর’ নামক স্থানে গড়ে ওঠা অবৈধ হকার্স মার্কেট উচ্ছেদ করে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এ সুযোগে স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির স্থান মিললেও টাকা যোগাড় করতে হাঁপিয়ে উঠেন উদ্যোক্তারা। এমন সময় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন রাসেদুল ইসলাম রাজা নামের এক তরুণ ব্যবসায়ী। উপজেলা শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক রাসেদুল ইসলাম রাজা তার মরহুম মুক্তিযোদ্ধা বাবার যোগ্যসন্তান হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে প্রাথমিক কাজে ব্যয়ের একটি বড় অংশ ব্যয় করেন। মোটা অংকের টাকা দিয়ে সহযোগিতাকারীদের মধ্যে রয়েছেনÑ সান্তাহার পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাসেম, সান্তাহার পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ব্যবসায়ী এসএম জাহিদুর বারি, ব্যবসায়ী মোঃ ইসমাইল হোসেন, হাফেজ বেলাল হোসেন ও শ্রী রাকেস সাহা। এছাড়া শহরবাসীও এক বস্তা সিমেন্ট থেকে সাধ্যমতো টাকা সহায়তা দিয়েছেন। সরকারী কোন আর্থিক সহযোগিতা ছাড়াই ২০১৫ সালের ৩ এপ্রিল ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ‘স্বাধীনতা মঞ্চ’ নামক স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ কাজ। এটির প্রাথমিক নির্মাণ কাজ শেষ করে উদ্বোধন করা হয় ওই বছরের ১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায়। সাজেদুল ইসলাম চম্পা তার নক্সায় ও নির্মাণে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ বোঝাতে এটির স্থান নির্ধারণ করেছেন ৫৬ ফুট। স্তম্ভে উঠার জন্য নয়টি সিঁড়ি বা ধাপকে বোঝানো হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস হিসেবে। আর এই বাংলাদেশ যে এক দিনে বা একটি আন্দোলনে স্বাধীন হয়নি সেটি বোঝাতে ১২টি পার্শ¦ ও একটি মূল স্তম্ভ দিয়েছেন ১২টি বড় আন্দোলনকে লক্ষ্য করে। এগুলো হলোÑ পলাশীর যুদ্ধ, সিপাহী বিপ্লব, বঙ্গভঙ্গ, খেলাফত আন্দোলন, লাহোর প্রস্তাব, দেশ বিভাগ, ভাষা আন্দোলন, যুক্তফন্ট, ছয় দফা, আগরতলা মামলা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ’৭০-এর নির্বাচন। স্তম্ভটি পুরো কালো রংয়ের। এর কারণ হিসেবে ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদদের স্মারক হিসেবে দেখানো হয়েছে। স্তম্ভের উচ্চতা ২১ ফুট করার কারণ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ২১ ফেব্রুয়ারিকে বুঝিয়েছেন। স্তম্ভের গোড়ায় স্থাপন করা বেদির মাপ ১১ ফুট, যা মুক্তিযুদ্ধের ১১ সেক্টরকে বোঝানো হয়েছে। আর মুক্তিযুদ্ধকালীন পতাকাটি স্থাপন করা হয়েছে স্তম্ভের একদম উপরে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সাত বীরশ্রেষ্ঠকে বোঝাতে সাতটি খুঁটি দিয়ে স্তম্ভটিকে সুরক্ষিত দেখানো হয়েছে। লাল-সবুজ বৈদ্যুতিক বাতি দিয়ে বোঝানো হয়েছে জাতীয় পতাকাকে। রাতের বেলা এ দৃশ্যটি বেশ নয়নাভিরাম। দিনের বেলাও দৃষ্টি কাড়ে ট্রেন, বাসসহ সব যানবাহনের যাত্রী ও পথচারীর। এ পর্যন্ত এটি নির্মাণ কাজে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ টাকা। কিন্তু অর্থাভাবে নক্সা অনুযায়ী এখনও শেষ হয়নি পুরো কাজ। পুরো কাজ শেষ করতে আরও সমসংখ্যক টাকার প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন নক্সাকার ও স্তম্ভ নির্মাণের প্রধান উদ্যোক্তা সাজেদুল ইসলাম চম্পা।
×