ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আসছে দাম বৃদ্ধির চাপ

গৃহস্থালির গ্রাহকের অব্যবহৃত গ্যাসে সিস্টেম গেইন

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৬

গৃহস্থালির গ্রাহকের অব্যবহৃত গ্যাসে সিস্টেম গেইন

রশিদ মামুন ॥ গৃহস্থালির গ্যাস গ্রাহকের অব্যবহৃত গ্যাস দিয়েই চুরি সামলে সিস্টেম গেইন করছে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো। আবার গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সময় গৃহস্থালির গ্রাহকের ওপরই চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। সারাদেশের মোট গ্রাহকের ১২ ভাগ আবাসিক গ্রাহক। আবাসিক গ্রাহকের অন্তত ৭০ ভাগ তাদের বেঁধে দেয়া সীমার চেয়ে কম গ্যাস ব্যবহার করেন। এতে করে বিপুল পরিমাণ গ্যাস সাশ্রয় হয়। বেঁচে যাওয়া গ্যাস দিয়েই সব রকমের অপকর্ম ধামা চাপা দেয় বিতরণ কোম্পানিগুলো। বিতরণ কোম্পানি এবং পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, গৃহস্থালির গ্রাহকদের জন্য ৯২ ঘনফুট (সিএফটি) হিসেব করে গ্যাসের দাম নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু সেখানে তারা স্বাভাবিক গ্যাসের চাপের সময়ই ব্যবহার করে ৪২ সিএফটি। শীতের সময় এই ব্যবহার আরও কমে আসে। ফলে দ্বিগুণেরও বেশি গ্যাস সাশ্রয় হয়। জানা যায়, গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাসের এলাকার শত শত কিলোমিটার অবৈধ গ্যাস পাইপ লাইন অপসারণে টাস্কফোর্স গঠন করা হয় ২০১৩ সালে। পরের বছর থেকে এই টাস্কফোর্স মাঠে নামে। এখন পর্যন্ত ৮২০ কিলোমিটার পাইপলাইন অপসারণ করেছে তারা। অবৈধভাবে গ্যাস ব্যবহারকারীর সংখ্যা তিতাসের হিসেবেই ছিল প্রায় সাড়ে চার লাখ। তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানি সূত্র বলছে ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর এবং নরসিংদীতে অবৈধভাবে স্থাপিত গ্যাস পাইপ লাইন রয়েছে। তিতাসের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহায়তায় ঠিকাদাররা এসব সংযোগ দিয়ে বিলও আদায় করে। শুধু তিতাসই নয় প্রত্যেকটি বিতরণ কোম্পানির এলাকায় অবৈধভাবে গ্যাস ব্যবহার বা সরাসরি চুরির অভিযোগ রয়েছে। সঙ্গত কারণে বিতরণ কোম্পানি যে পরিমাণ গ্যাস পেট্রোবাংলার কাছ থেকে ক্রয় করে ঠিক সেই পরিমাণ গ্যাস বিক্রির বিল তাদের হিসেবে জমা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বছর শেষে যখন হিসেব করা হয় দেখা যায় বিতরণ কোম্পানিগুলোর সিস্টেম গেইন হচ্ছে। অর্থাৎ যে পরিমাণ গ্যাস পেট্রোবাংলার কাছ থেকে কেনা হচ্ছে বিল আসছে তার থেকে বেশি। জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. হোসেন মনসুর বলেন, সাধারণত একজন গৃহস্থালির গ্রাহকের প্রতিমাসে যে পরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করবে হিসেব করে দাম বৃদ্ধি করা হয় তাদের মধ্যে ৭০ ভাগই এর থেকে কম গ্যাস ব্যবহার করে। এতে করে সাশ্রয় হওয়া এই গ্যাসেই সিস্টেম গেইন হয়। জানা যায়, বিতরণ কোম্পানিগুলো গৃহস্থালির গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ কোন ব্যবহারকারীর পরিমাণকে ভিত্তি ধরে থাকে। এতে করে কম গ্যাস ব্যবহার করেন এমন গ্রাহকের হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন এখানে কয়েকজন ব্যবহারকারীর হিসেব নিয়ে গড় মূল্য নির্ধারণ করলে সঠিক প্রতিফলন পাওয়া যেত। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) দাম বৃদ্ধির যে প্রস্তাব জমা দিয়েছে সেখানে দেখানো হয়েছে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানি ১ দশমিক ৮২ শতাংশ, জালালাবাদ বিতরণ কোম্পানি শূন্য দশমিক ৩৩ শতাংশ, কর্ণফুলী ৪ দশমিক ২৯, বাখরাবাদ ৪ ও পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানির সিস্টেম গেইন ছিল ৫ শতাংশ। এই ধরাবাহিকতা শুধু এবারের নয় প্রত্যেকবারই গ্যাস বিতরণ কোম্পানি এমন সিস্টেম গেইন করে। এখন আবার গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে সায় দিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। যে কোন সময়ই গ্যাসের বর্ধিত দর ঘোষণা করতে পারে কমিটি। আগামী জানুয়ারি থেকে এই দাম কার্যকরের ঘোষণাও দিয়েছেন কমিশন চেয়ারম্যান। গ্যাস বিতরণ কোম্পানির বর্তমান দর বজায় থাকলেও সবগুলো বিতরণ কোম্পানিই মুনাফা করবে। কমিশন গঠিত মূল্যায়ন কমিটি গ্যাসের দাম বৃদ্ধি না করার সুপারিশ করেছে। যদিও কমিশন দাম বৃদ্ধির শুনানির সময়ই বলে দিয়েছে গ্যাসের দাম তারা বৃদ্ধি করবেই। এ বিষয়ে সকলকে প্রস্তুত হওয়ার জন্যও আহ্বান জানানো হয় ওই সময়। বিতরণ কোম্পানির প্রস্তাবে দেখা যায় আবাসিক গ্রাহকদের দুই চুলার ক্ষেত্রে এখনের ৬৫০ টাকার দর ৮৫ ভাগ বৃদ্ধি করে এক হাজার ২০০ টাকা এবং এক চুলার ক্ষেত্রে ৬০০ টাকার স্থলে ৮৩ ভাগ বৃদ্ধি করে এক হাজার ১০০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর আগে ২০১৫ সালে ২৭ আগস্ট গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করে। এর আগে এক চুলার গ্যাসের গ্রাহকের বিল ছিল ৪০০ টাকা দুই চুলায় এই বিল ছিল ৪৫০ টাকা। অন্যদিকে সরকার বলছে আবাসিক গ্রাহকের গ্যাসের দর পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি করে সাধারণ মানুষকে গ্যাস ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করা হবে। এর বিপরীতে সরকার ভর্তুকিমূল্যে এলপিজি সরবরাহ করবে। কিন্তু এ বিষয়ে সরকার এখনও পর্যন্ত কোন পদক্ষেপ নেয়নি। এখনও পর্যন্ত বেসরকারী বিভিন্ন কোম্পানির কাছেই জিম্মি রয়েছে এলপিজি ব্যবসা। সরকার সামান্য কিছু এলপিজি বিতরণ করলেও তা সিন্ডিকেটের দখলে রয়েছে। জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা এসব বিষয়ে বারবার এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। তিনি দাবি করেন আবাসিক গ্রাহকের সীমা ধরা হয় ৯২ সিএফটি কিন্তু তারা ব্যবহার করেন ৪২ সিএফটি। শীতের সময় এটা গড়ে ২০ সিএফটিতে নেমে আসে। এসব বিষয়ে বার বার বলার পরও কমিশন কর্ণপাত করে না। কমিশনের মূল্যায়ন কমিটি গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রয়োজন নেই বলে মতামত দিলেও কমিশন গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করছে। এটি গণশুনানি বা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দাম বৃদ্ধি করার যে নীতি তাকে প্রশ্নবিদ্ধই করছে না বিপর্যয় সৃষ্টি করছে।
×