আমি যেন দেখে যেতে পারি
ফারুক মাহমুদ
যথার্থ সামান্য কথা - যত হোক, দূরে গেলে কাছে আসা হয়
যে গেছে পড়ন্ত পথে, এবার ফিরাব তাকে। তুমি কিন্তু এসো
হিসাবি মানুষ যারা, অঙ্ক কষে, তারা খোঁজে একটানা জয়
শ্রেষ্ঠ শীর্ষ কিছু নয়, সামান্য বিচ্ছেদ শেষে তবু ভালবেসো
এখনও আকাক্সক্ষা করি: চোখে চোখ হেসে আছে হেসে থাকা হাসি
যেতে যেতে দুটি হাত থেমে আছে মুগ্ধকর অন্য দুটি হাতে
স্মৃতির সামান্য কাজ, তা-ও ভাল, মনে হলে ফিরে চলে আসি
থাকুক দূরের বাদ্য, যেখানে রোদেও কণ্ঠ - চেয়েছি দাঁড়াতে
যখন বিদায় নেব, একবার, আমি যেন দেখে যেতে পারি
এসেছে নতুন কাছে, অভিমান সত্য নয়, প্রিয় সেই নারী
** প্রজন্ম ডাকছে
আলমগীর রেজা চৌধুরী
বহুবর্ণ ধারণ করেছে সবিতা
রঙের ছোটায় পেখম ধরেছে দিগন্তের ল্যান্ডস্ক্যাপ।
বর্ষারানী হঠাৎ মেঘের টোপর পরে সেজেছে-রাজকন্যা,
উদ্যানের কদমগাছে ফুটেছে-আষাঢ়্য দিবসের ফুল।
ফাল্গুনে বর্ষাগীত মানায় না
হঠাৎ দিগন্ত প্রকম্পিত কণ্ঠস্বর,ফাঁসি....
প্রজন্ম ডাকছে।
ওদের কণ্ঠে অ্যানা’র ক্রন্দন
অবরুদ্ধ নগরীর বিলাপ নাৎসী ক্যাম্প থেকে
একাত্তরের বাঙ্কারে বাঙ্কারে জমা হয়ে আছে।
চমকে যাই, থমকে যাই, ওরা ডাকছে...
একাত্তরের প্রজন্ম আমি
চোখে স্বজনের ক্ষতবিক্ষত মুখ;
একাকী, এতটা বছর বদ্বীপের এক বাঙ্গাল যুবা
তাপিত কাঙাল তারে কেউ ডাকেনি।
বর্ষারানী! জলের ফোটায় বসন্ত পরাজিত নয়-
জল ভেঙ্গে আমি ওদের কাছে পৌঁছে যাই।
শাহাবাগের প্রজন্ম চত্বর গর্জে ওঠে, ফাঁসি...
** উছলে ওঠার শক্তি
গোলাম কিবরিয়া পিনু
বেদনার অন্ধকার আসে
অন্ধকূপে কখনো কখনো পড়ে যাই
হাইপাই করি-
একটুকরো রশি নেমে আসে
সেই রশি ধরি!
রশি ধরে উঠে আসি। এইভাবে বাজে বাঁশি!
দুঃখআক্রান্ত চিৎকারের মধ্যে ডুবে থাকতে পারি না-
নদী ও সমুদ্র ভাসিয়ে তুলেছে!
উছলে ওঠার শক্তি টের পাই-
হতাশার কিছু নাই!
ক্রন্দনের আয়ুসীমা আছে-
কতদূর টেনে নিয়ে যাবে ধীবর ও মাছে?
বুকে চেপে বসা পাথরের কারণে গোঙানি
তুঁতপোকা শুধু নয়-আমিও করেছি সহ্য!
কর্জ শোধ করে কাঠফড়িং হয়েছি-
মধুকোষ নিয়ে আমাকে আমিই বহন করেছি!
** বিশুদ্ধ মানব ১৯৭১
মারুফ রায়হান
সে এক আশ্চর্য তরু এই পালাবদলের কালে
একাত্তরের আলোয় জেগে ওঠা এক বিশুদ্ধ মানব
আমরা পায়ের কাছে বসে তার শুধাই যুদ্ধের গল্প
পেতে রাখি কান কোথাও মেশিনগান শোনাবে স্বস্তির গান
কোথাও সেলাই হবে পতাকা, আত্মপরিচয়ের বস্ত্রখ-
আর আমাদের লজ্জা অসম্মান ঢেকে যাবে তাতে
একজন মুক্তিযোদ্ধার মুখোমুখি আমরা ক’জন
চুয়াল্লিশ বছরের পুরনো গৌরবে ছত্রখান হবে আজকের লোভ
আমাদের প্রতীক্ষার ক্ষণ প্রলম্বিত হয়
যোদ্ধার ভেতরে একটি ভূমিকম্প একটি ঘূর্ণিঝড়
নাকি একটি অগ্ন্যুৎপাত প্রস্তুতি নেয় আমরা জানি না
ইতিহাসের একেকটি পর্দা উঠতে থাকে পর্দা উড়তে থাকে
মহান যোদ্ধার সম্মুখে নতজানু আমরা
বিস্ময় নিয়ে দেখি তার একটি চোখ জ্বলতে থাকে
আগুন এবং আগুন এবং আগুন
অন্য চোখ অশ্রুনদী হয়ে বয়ে যেতে থাকে এই বাংলায়
মিশে যেতে থাকে মেঘনায়, ব্রহ্মপুত্রে, ধলেশ্বরী পদ্মায়
অশ্রুর অশ্রুত স্বর শুনবো বলে আমরা উৎকর্ণ হয়ে থাকি...
** একটি পাউডারের কৌটা
কনক চৌধুরী
কালী চরণের একদিন বয়স ছিল ১৭ বৎসর ৯ মাস ৮ দিন
সেদিন ছিল রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চ
বঙ্গবন্ধুর ডাক সে লোকমুখে শোনে একদিন পরে
২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চ লাইটের বর্বরতায়
নিরস্ত্র বাঙালীর রক্তে ভেজে বাংলার মাটি
তারপর থেকে শুরু খোঁজ! খোঁজ! খোঁজ!
হিন্দু কাহা, পুলিশ কাহা, ইপিআর কাহা, আওয়ামী কাহা,
পরে পাকিস্তান হানাদারদের তালিকায় যোগ হয়, মুক্তি কাহা!
কালীর বন্ধু শংকর নাম পাল্টে হয় ইনসাফ আলী
ইনসাফের নিয়তি তাকে বাঁচিয়ে রাখেনি
সে শত্রুর হাতে ধরা পড়ে বেয়নেটের আঘাতে প্রাণ দেয়
তারপর কালীকে আর দেখা যায়নি
কালীকে ধরতে রাজাকারের দল আসে তাদের বাড়ি
তাকে না পেয়ে ধরে নিয়ে যায় তার বড় দিদি আরতিকে
কালীর বাবা বিপিন বিশ্বাস তাদের বাধা দিলে
ওরা তার মুখে রাইফেল বাট দিয়ে থেঁতলে দেয়
ডিসেম্বর ১৩
কালীর বয়স সেদিন ১৮ বৎসর ৬ মাস ১৪ দিন
যশোর গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড
পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে এ্যাম্বুস করেছে একদল মুক্তিযোদ্ধা
সেই গোলাগুলীর মধ্যে হঠাৎই একটি বুলেট এসে পাঁজরে বেঁধে কালীর
সেদিনের কথা আমার আজও মনে আছে
মৃত্যুর আগে কালী বলেছিল
পারলে মাকে গিয়ে বলিস আমি যে আর বাড়ি ফিরতে পারলাম না
মায়ের সাথে দেখাও যে আর হলোনা
আর দিদিকে বলিস
সে যেন তার তিব্বত পাউডারের কৌটায় লুকিয়ে রাখা টাকা আর না খোঁজে
সে টাকা চুরি করে যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে ভারত যাই
ভেবেছিলাম ফিরে এসে দিদির টাকা তাকে ফিরিয়ে দিব
কালীর মা প্রভা দেবীকে আমি কাকিমা বলে ডাকতাম
কাকিমাকে আমি কালীর শেষ কথা পৌছে দিয়েছি
শুধু আরতি দিদিকে বলা হয়নি তার সেই টাকা চুরি যাবার কথা
আরতি দিদি যে আর কোনদিন বাড়ি ফেরেনি
হয়তো আজও তার ক্ষত বিক্ষত আত্মা বাতাসে হু হু করে বেড়ায়
শ্মশানের বহ্নিমান চিতা দেখে কষ্ট পায়
তার দেহটা যদি আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হতো
তার উপর অত্যাচার আর যন্ত্রণা জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যেত
মুক্তিযোদ্ধার মা হিসেবে প্রভা দেবীকে সরকার বাহাদুর ভাতার বন্দোবস্তÍ করে
সে জন্য আমি খুশী
দিদির পাউডারের কৌটার কাছে আমার স্বাধীনতা কিঞ্চিৎ হলেও ঋণী
সে জন্যও আমি ভীষণ খুশী
আজ প্রভা দেবী কেমন আছে তা আমি জানিনা
ডিসেম্বর এলে সে কেমন থাকে তা আমি একেবারেই জানিনা।
শীর্ষ সংবাদ: