ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নুরুল করিম নাসিম

১৯৭১ এবং এই প্রজন্ম

প্রকাশিত: ০৬:৪৬, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬

১৯৭১ এবং এই প্রজন্ম

এই প্রজন্ম ১৯৭১-এর মার্চ মাসে শুরু হওয়া মুক্তিযুদ্ধ কিংবা ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবস দেখেনি। এই প্রজন্ম তখনও পৃথিবীতে আসেনি। যা কিছু তাদের দেখা তা পরবর্তী সময়ে নির্মিত রচিত সেই সময়কার প্রামাণ্যচিত্র কিংবা নাটক-চলচ্চিত্রের মাধ্যমে অপ্রত্যক্ষ দর্শন। একাত্তরের উৎস, ইতিহাসবিদরা বলেন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে নিহিত ছিল। ভাষার জন্য কোন জাতি রক্ত দেয়নি, আমরা দিয়েছিলাম। রক্ত দিয়ে আমরা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছি। তদানীন্তন পাকিস্তান আমলে (১৯৪৭-৭১) রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেয়েছিল বাংলা। উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্র পরিচালনার ভাষা ছিল বাংলা, যদিও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ইংরেজদের ফেলে যাওয়া ঔপনিবেশিক ভাষা ইংরেজীকেই আমরা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়েছিলাম। পশ্চিম পাকিস্তানী প্রভুদের স্বৈরশাসন এবং এ দেশের পদলেহী কিছু কুলাঙ্গারের অপপ্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত টেকেনি। সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও, ১৯৭১ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়েও বাঙালী ক্ষমতা পায়নি। ইতিহাসের এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালী মেনে নিতে পারেনি। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীরা দিনের পর দিন শোষিত এবং নির্যাতিত হতে হতে এক সময় তাদের দেয়ালে মাথা ঠেকে গেল। অর্থনৈতিক শোষণের পাশাপাশি ছিল ভয়াবহ এবং নীরব সাংস্কৃতিক শোষণ। আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। মনে পড়ে ১৯৭১-এর মার্চের দিন-রাত্রিগুলো। মার্চের দুই কি তিন তারিখে স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলা চলছিল। তারিখটি ঠিকঠাক মনে নেই। হঠাৎ খেলা বন্ধ হয়ে গেল। জনগণ প্রতিবাদে ফেটে পড়ল। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষ অনার্সের ছাত্র। ইংরেজী বিভাগে পড়ি। ৫ মার্চ বাংলা নাটক বনফুলের লেখা মধুসূদন দত্ত টিএসসিতে মঞ্চস্থ হওয়ার কথা। সেদিন সন্ধ্যায় পর্দার আড়ালে অন্য নাটকের মহড়া হচ্ছিল। এক গভীর ষড়যন্ত্রের নাটক। আমাদের নাটক বন্ধ হয়ে গেল। দেশের এলোমেলো পরিস্থিতিতে নাটক করা হলো না। আমার জীবনের প্রথম নাটক এবং সেই নাটকে মূল চরিত্রে আমি। এরপর ঘটনা খুব দ্রুত ঘটেছে। ঢাকার রাজপথে মিছিলে প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠল। প্রতিদিন, প্রতিটি মুহূর্ত তখন ঘটনাবহুল। গোলটেবিল বৈঠক বসল। জুলফিকার আলী ভুট্টো এলেন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনা করলেন। কিন্তু ভুট্টোর অনমনীয় মনোভাবের জন্য আলোচনা সফল হলো না। তারপর এলো সেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। ইতিহাসের এক টার্নিং পয়েন্ট। শেখ মুজিব চমৎকার সংক্ষিপ্ত ভাষণে এ দেশের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা প্রতিধ্বনিত করলেন। তিনি উদাত্ত কণ্ঠে পরবর্তী পদক্ষেপের রূপরেখা এঁকে দিলেন। জনগণের স্বপ্ন, জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে ধ্বনিত হলো। তিনি বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ দ্রুত রাজনীতির চালচিত্র পাল্টে যেতে লাগল। স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া-ভুট্টো-টিক্কা খানেরা ভিন্ন এজেন্ডা নিয়ে তখন মত্ত। তাদের ছিল ভিন্ন রূপরেখা। ২৫ মার্চের রাতে টিক্কা খানকে দায়িত্ব দিয়ে তদানীন্তন সরকার এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো পালিয়ে গেলেন পশ্চিম পাকিস্তানে। জনগণ কিছুই জানতে পারলেন না। এই ঘৃণা ষড়যন্ত্রের কথা জনগণ উপলব্ধি করতে পারেননি। তবে সবাই অনুভব করছিলেন একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। কেউ বলতে পারছিল না কী ঘটতে যাচ্ছে। ২৫ মার্চের মধ্যরাত তখন অতিক্রান্ত হঠাৎ মর্টারের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে জেগে দেখি পশ্চিম আকাশে লাল। পাকিস্তানী সৈন্যরা রাজারবাগ পুলিশ ক্লাব আক্রমণ করেছে। জগন্নাথ হলে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি কোয়ার্টারে শিক্ষকদের মেরে ফেলা হয়েছে। ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত হত্যালীলা চলতে থাকল। ২৬ মার্চ কার্ফু ঘোষণা করা হলো সারাদেশে। বেতার দখল করে নিল সৈন্যরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে বন্দী করা হলো। সারাদেশে শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানী সৈন্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল জনগণ। গ্রামের প্রত্যাঞ্চল বেছে নিয়ে বাঙালী সৈন্যরা তাদের সীমিত অস্ত্র দিয়ে যুবকদের ট্রেনিং দিতে শুরু করল। বেশ কিছু লোকজন সীমান্তের ওপারে পাড়ি জমাল। সেখানেও প্রশিক্ষণ চলতে লাগল। শুরু হয়ে গেল গেরিলা যুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। বিশ্বের মানচিত্রে নতুন একটি দেশের অভ্যুদয় হলো। দেশের জনগোষ্ঠীর একটা অংশ স্বাধীনতার বিরোধিতা করল। তারা ‘রাজাকার’, ‘আলবদর’ নামে অভিহিত হলো। দীর্ঘ ৪ দশক পরে এসব স্বাধীনতাবিরোধীর আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচার হলো এবং দোষীদের ফাঁসি দেয়া হলো। ঘরের শত্রু বিভীষণ এখনও রয়েছে। এদের শনাক্ত করতে হবে এবং উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। এই প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। ভাষা আন্দোলনের ঘটনাও জানে না। তাদের সঠিক ইতিহাস জানাতে হবে। তা না হলে এই প্রজন্মের কাছে অনেক কিছু, অনেক অকথিত ইতিহাস অজানাই থেকে যাবে। আমরা যারা, সেই দুর্বিনীত সময়ের ভেতর বেড়ে উঠেছি, আমাদের সে সব কথা, সে সব স্মৃতিচিত্র এই প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে। আরও একটি বিষয় ভাববার আছে। যারা প্রবাসে আছেন, যেসব বাঙালী অভিবাসী, তাদের সন্তানেরা দেশ থেকে দূরে থাকার কারণে দেশের ইতিহাস জানে না। দেশের সংস্কৃতি জানে না। তাদের ইংরেজীর মাধ্যমে দেশের সঠিক ও সত্যিকার ইতিহাসটি জানাতে হবে। ১৯৭১ একটি প্রতীক। একটি স্বাধীনতার অন্য নাম। এই তারিখটিকে এই প্রজন্মের চেতনায় গেঁথে দিতে হবে। যারা স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, যারা স্বাধীনতার বিপক্ষে কাজ করেছিল, তাদের মুখোশ উন্মোচন করে দিতে হবে। বাংলাদেশ আমাদের গর্ব। বাংলাদেশ আমাদের অহঙ্কার। কিন্তু এই গর্ব ও অহঙ্কারের বিষয়টি ধরে রাখতে হবে। বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশের জন্য কাজ করতে হবে। এই প্রজন্মের হাতে দেশের ভবিষ্যত। এই প্রজন্মকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে চালিয়ে নিতে হবে এবং এই কাজটি বড় কঠিন এক অগ্নিপরীক্ষা এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্নটি এখানে নিহিত।
×