ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সাযযাদ কাদির

একাত্ম একাত্তরে

প্রকাশিত: ০৬:৪৬, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬

একাত্ম একাত্তরে

পঁচিশে মার্চের রাতে পাকিস্তানী বাহিনীর অস্ত্র যে মুহূর্তে গর্জে ওঠে আমাদের বিরুদ্ধে তখনই পরাজয় নিশ্চিত হয় তাদের। আর প্রতিরোধ যুদ্ধের সূচনা করে ওই ক্ষণেই আমরা ঘোষণা করি আমাদের বিজয়। এরপর ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। সে সময় কেটেছে যুদ্ধে। প্রতিরোধে। তখন বাতাসে বারুদের গন্ধ, রক্তে ও অশ্রুতে সিক্ত মাটি। একদিকে উদ্যত সঙ্গীনের নিচে অবরুদ্ধ মানুষ, অন্যদিকে সংশয়ে সঙ্কুল দুর্ভোগপীড়িত শরণার্থী জীবন। আরও ছিল নাড়া খাওয়া বিশ্ববিবেক, এগিয়ে আসা সাহায্য সহায়তার হাত, পাশে দাঁড়ানো সুহৃদ স্বজন। সবাইকে মনে রাখি, সমস্ত কিছুকে স্মরণ করি স্বাধীন স্বভূমির মুক্ত বাতাসে নিশ্বাস নিতে-নিতে। ডিসেম্বরের হানাদারমুক্ত দিনগুলোতে সে স্মরণ অর্থবহ হয়ে ওঠে আরও। খুব মনে আছে পথে পথে বেরিয়ে পড়া সেই সব স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল শোভাযাত্রা, এখনও শুনতে পাই সেদিনের দীপ্ত-দৃপ্ত স্লোগানগুলো- ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’... তবে মনে পড়লেই এ কথাটা ভাবি, সেদিন সকলের মুখে ধ্বনিত ওই সব স্লোগান এখন শুনি না কেন সকলের মুখে? সেদিন কোন রাজনীতি ছিল না, বিভাজন ছিল না- সবাই আমরা তখন একাত্তরে একাত্ম। বিজয়ের ক্ষণেও দেখেছি সেই ঐক্যচেতনা, ঐক্যবোধ। কবে থেকে এ স্লোগান হারাল সর্বজনীনতা, কেন হারাল, কারা দায়ী এ জন্য- সে রাজনৈতিক ইতিহাস খুঁজে দেখা যেতে পারে, তবে আরও জরুরী সে স্লোগানকে সবার মুখে ফিরিয়ে আনার রাজনীতি। আমাদের ইতিহাসের, সংগ্রামের, যুদ্ধের, জাতির এ মুক্তিধ্বনি আবার শুনতে চাই মুখে মুখে। যে উদার গণতান্ত্রিক কল্যাণ রাষ্ট্রের স্বপ্ন নিয়ে দেশবাসী লড়েছে- মরেছে জুলুমশাহির বিরুদ্ধে, অকাতরে প্রাণ দিয়েছে- নির্যাতন সয়েছে আন্দোলনে সংগ্রামে যুদ্ধে সেই স্বপ্নকে সার্থক করে তোলার দায়িত্ব স্বাধীনতার সুফলভোগী সকলের। ‘জয় বাংলা’ ফিরে আসুক জাতিধ্বনি হয়ে, বাংলা ও বাঙালীর জয় হোক প্রতিদিন চিরদিন। ডিসেম্বরের সেই বিজয়ের দিনগুলোতে শুনেছি অনেক দুঃখ-কাহিনীর সঙ্গে আরও এক আঘাতের ঘটনা। এ আঘাত হয়ে আসে ধূর্ত চতুর ষোড়শ বাহিনী। নানা মানবিক দুর্বলতার ছিদ্রপথে আবির্ভাব ঘটে তাদের। ১৬ ডিসেম্বরের পর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আবির্ভূত ভুয়াদের দৌরাত্ম্য সেই থেকে চলছে এখনও। ওই সুযোগ সন্ধানীরা প্রকৃত ও নির্যাতিত মুক্তিযোদ্ধাদের বঞ্চিত করে পেয়ে চলেছে প্রতিষ্ঠা প্রতিপত্তি। তারা সচেষ্ট ভুয়া পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে সব জায়গা থেকে বিশেষ সুবিধা নিতে। আমাদের ভালবাসার দুর্বলতাকে যথেচ্ছ ব্যবহার করে তারা কেড়ে নিয়েছে সরকারী চাকরি থেকে ব্যবসা পর্যন্ত বহু ক্ষেত্রে প্রকৃতজনের প্রাপ্য। প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা, সামাজিক সম্মান, ধন-সম্পদ প্রভৃতি বাগিয়ে নিয়েছে সুকৌশলে। এদের শনাক্ত করার চেষ্টা থাকলেও তা সর্বত্রগামী হতে পারছে না নানা কারণে। বিভিন্ন মোহের কাছে বার বার পরাজিত হচ্ছে ভুয়া উৎখাতের সৎ উদযোগ। আশার কথা তখনও যেমন শুনেছি, এখনও তেমন শুনছি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের শনাক্ত করার ব্যাপারে। তবে এখন আর আশা নয়, ভরসা করার- আস্থা রাখার দৃষ্টান্ত দেখতে চাই অবিলম্বে। যে উদার গণতান্ত্রিক কল্যাণ রাষ্ট্রের কথা বলেছি- তা ছিল স্বপ্ন। সে স্বপ্নসাধ পূরণ হয়নি আমাদের। এখনও আমরা ঘুরপাক খাচ্ছি আত্মপরিচয়ের অন্বেষণে, স্বরূপের সন্ধানে। তাই আমরা ‘বাঙালী’ না ‘বাংলাদেশী’র মতো অবান্তর প্রশ্নে পীড়িত হই কখনও। আবার কখনও হাঁসফাঁস করি ‘ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশ’ নাকি ‘মধ্যপন্থী (মডারেট) মুসলিম দেশ’ পরিচয়ের গেরোতে পড়ে! বিজয় দিবসে মনে পড়ে কত কথাই! সব কি বলা যাবে একবারে? কিছু বললাম, আর একটি কথা বলে শেষ করি আপাতত। এ কথাটা রাজনীতিকদের সম্পর্কে। সেই ভাষার লড়াই থেকে দেখে আসছি তাদের। তারপর দেখেছি স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে, স্বাধিকারের সংগ্রামে, স্বাধীনতার যুদ্ধে। তাদের সে ভূমিকা গৌরবোজ্জ্বল। আজ যে স্বাধীন জাতি হিসেবে সার্বভৌম দেশে বাস করছি তাতে তাদের অবদান বিপুল। এ জন্য তারা হয়ে আছেন আমাদের গর্বের, অহঙ্কারের মূর্ত প্রতীক। কিন্তু স্বাধীন দেশে রাজনীতিকদের অনেকেই ভুলেছেন গণতন্ত্রের চেতনা ও আদর্শ, জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা। ক্ষমতা ও সম্পদ আহরণের উদগ্র ক্ষুধা তাদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে জনতার কাতার থেকে। এ ক্ষুধার অবসান ঘটাতে হবে, জনগণের সঙ্গে দূরত্ব ঘোচাতে হবে, ভাঙতে হবে উভয়ের মধ্যে সৃষ্ট বিভেদের প্রাচীর। আজ প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য ও সংহতি। আমাদের উত্তীর্ণ হতে হবে হিংসাত্মক বিভাজন থেকে। গালভরা বক্তৃতা-বিবৃতি ও ভুয়া প্রতিশ্রুতি-অঙ্গীকারের দিন শেষ। ভবীরা আর ভোলে না ওতে। দেশবাসী আজ রাজনীতিকদের কাছে চায় নিঃস্বার্থ, সাহসী ও দেশাত্মবোধে প্রত্যয়ী নেতৃত্ব। এ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে রাজনীতি, প্রশাসন, শিক্ষা থেকে রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে। তবেই দুর্নীতির অভিশাপ থেকে, ভুয়াদের দৌরাত্ম্য থেকে, ধর্মীয় উন্মাদনা থেকে, জঙ্গী সন্ত্রাসী চরমপন্থার কবল থেকে মুক্তি পেতে পারি আমরা, গড়তে পারি এক মন এক প্রাণ জাতি। বিজয় দিবসের কামনা তাই, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত সকলে এক হও, সকল কুক্রিয়াশীল দূর হও। জয় বাংলা।
×