ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

হামিদ কায়সার

রেডিওনামা

প্রকাশিত: ০৬:৪০, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬

রেডিওনামা

অফিস থেকে ফিরতেই মাহজাবীন বলল, ‘ফ্রেশ হয়ে নাও! তোমার সঙ্গে কথা আছে!’ কথাটা ও এমনভাবে বলল, সারওয়ারের আর তর সইলো না, ‘না না। আগে শুনে নেই। তারপর ফ্রেশ হবো!’ ‘ইস! একটা কিছু বললেও বিপদ! কাপড়টাপড় ছেড়ে নাও না!’ ‘অত ধৈর্য আছে আমার! তুমি জানো না?’ ‘একজন মানুষ বটে তুমি!’ উষ্মা প্রকাশ করতে করতে বিছানায় সারওয়ারের পাশে গা ঘেঁষে বসতে বাধ্য হলো মাহজাবীন। জানে তো, এই ভূত ঘাড় থেকে না নামা পর্যন্ত শান্তি নেই ওর। নিজের ওপরই বরঞ্চ একটু রাগ হলো- কথাটা পরে তুললেই পারত! কোন রকম ভণিতা না করেই মাহজাবীন জানতে চায়, ‘আচ্ছা, মার সঙ্গে তোমার কী হয়েছে বলো তো?’ ‘কেনো কি হবে আবার?’ ‘আজ খুব কাঁদছিল!’ একটু দমে গেল সারওয়ার, ‘আমার কোন আচরণে! বলো কী? আমি আবার কী করলাম?’ ‘মনে করে দেখো!’ ‘উহুঁ! হতেই পারে না! তুমি কি ভাবতে পারো মাকে আমি সজ্ঞানে কোনো আঘাত দিতে পারি?’ ‘তাহলে কি হয়েছে মার! এমনভাবে কাঁদছিল! আমি তো বেশ অবাক হয়ে গেলাম! তুমি তো এমন কোনো আচরণ করো না যে উনি এতো হার্ট হবেন!’ ‘কেনো, আমার কথা কিছু বললো নাকি?’ ‘বললো আবার বললোও না, শুধু আক্ষেপ করছিল, উনাকে বোঝার মতো কেউ নেই! উনি একা, উনাকে কেউ দেখে না!’ মার তো এমন বলার কথা না, এমন কথা শুধু শুধু বলবার মানুষও নন... একা একাই গুঞ্জরিত হয় কথাগুলো ওর মনের মধ্যে... তবে কি... মনে করার চেষ্টা করলো সারওয়ার! কবে মার সঙ্গে কখন কী কথা হয়েছে, মা-ই বা কি বলেছে, ওইবা মাকে... ভাবতে ভাবতে হঠাৎই খেয়াল হয়, মা সেদিন রেডিওর কথা তুলেছিল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুলেছিলই তো! বলেছিল খোকা রেডিওটা ঠিক করে দিসতো! শুধু সেদিন নয়, আরো একদিন বলেছিল রেডিওর কথাটা! কী আশ্চর্য ও বেমালুম ভুলে বসে আছে। মা কি সে কারণেই কষ্ট পেল? এরকম একটা তুচ্ছ কারণে! হতে পারে। আজকাল তুচ্ছ কারণেই তো কষ্ট পায় মা। ছেলেমানুষের মতো আচরণ করে। সেভিয়ার মাইন্ড স্ট্রোকটা হওয়ার পর, শরীরের বাম অংশ পুরো অবশ হয়ে গিয়েছে! শুধু কী শরীর! তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়ে গেছে মনের। ভেতরে ভেতরে যেন দপ করে নিভে গিয়েছে একটা বাতি। পুরো বাড়িটাই কেমন বিষণœ মেদুর অন্ধকার এখন। জাঁদরেল পুলিশ কনস্টেবল, তারচেয়েও বহুগুণ জাঁদরেল স্ত্রী, সেই শক্ত ধাতের মানুষটা হঠাৎ করেই কেমন যেন একটু অস্বাভাবিক রকমেরই, বড় বেশি ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছে, মেনে নিতে কষ্ট হয়। সারওয়ারের আর কাপড়চোপড় ছাড়তে ইচ্ছে করলো না। সে অবস্থাতেই বিছানায় নিজেকে সঁপে দিল। যে মানুষটা জীবনে বড় বড় সব আঘাতগুলো অনায়াসে বুকে বয়ে বেড়িয়েছে, সে-ই আজকাল তুচ্ছ থেকে অতি তুচ্ছ কোনো বিষয়ও স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেন না! রেডিওর বিষয়টা তুচ্ছ? সত্যিই তুচ্ছ? প্রশ্নটা কাঁটার মতো খচ খচ করতে থাকে মনের মধ্যে। রেডিওটার সঙ্গে বিশাল একটা আবেগ জড়িয়ে আছে মায়ের, এই এখন কথাটা মনে পড়লো ওর, উপলদ্ধি হলো ওটা শুধু যুদ্ধের স্মৃতি নয়, মার জীবন-সংগ্রামের অংশও হয়ে আছে। ওকে এভাবে থম মেরে বসে থাকতে দেখে তাড়া দিয়ে উঠলো মাহজাবীন, ‘কী! মন খারাপ হয়ে গেল! যাও ফ্রেশ হয়ে মার সঙ্গে দেখা করে আসো! মন ভালো হয়ে যাবে!’ নড়তে ইচ্ছে করছে না সারওয়ারের। ভেতরে ভেতরে ও কখন এতটা অসাড় হয়ে পড়েছে! হবেই তো! যে মার সামান্য কষ্টকে ও সহ্য করতে পারে না, সেই মায়ের এত বড় আবেগকে এভাবে অবমূল্যায়ন করলো! আসলে রেডিওর ব্যাপারটা মাথা থেকে আউট হয়ে গিয়েছিল। একদমই আউট হয়ে গিয়েছিল। মাথায়ই ছিল না। কীভাবে থাকবে? সে আজকের কথা? সেই কবে মা রাগ করে অভিমান করে ঢাউস সাইজের রেডিওটাকে আলমারির ভেতরে ঢুকিয়ে রেখেছে, নিজামী যেদিন মন্ত্রী হলো! হ্যাঁ, ঠিক সে-রাতে! মা সেদিন খায়নি, খেতে পারেনি, গুম মেরেছিল! তারপর কত দিন পার হয়েছে, কত ইতিহাস পাল্টে গিয়েছে! রেডিওর কথাটা কারো মনে থাকে, না মনে থাকার কথা? মাতো নিজেও ভুলে বসেছিল। সত্যিই কী মা ভুলেছিল না ভোলার চেষ্টা করেছে? এখন মনে হচ্ছে চেষ্টাই হবে! ও কখনো বুঝতে পারেনি। বোঝার চেষ্টাও করেনি। মা ভেতরে ভেতরে একাই যুদ্ধ করেছে, ক্ষয়ে পড়েছে, নুয়ে গিয়েছে। বুকটা ভেঙে আসে সারওয়ারের। বুকের ভেতরটা ভেঙে চৌচির হয়ে যায়। কেন ও মার কথাটাকে সেদিন সামান্যও গুরুত্ব দিল না! কেন মা হঠাৎ এতদিন পর রেডিওটা ঠিক করতে চাইলোÑ এ ভাবনা পর্যন্ত এলো না! আচ্ছা, নিজামীদের বিচার হয়েছে, ফাঁসি হয়েছে, তাই? মায়ের আনন্দবেদনার কোনো আবেগের সঙ্গেই নিজেকে মেলাতে পারলো না! আক্ষেপে পুড়তে লাগলো সারওয়ার। ‘অ্যাই! কী হলো? এই সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে... আচ্ছা তুমি বরঞ্চ আগে মার সঙ্গেই দেখা করে আসো! দু’জনের মনই হালকা হয়ে যাবে!’ মাহজাবীনের তাড়ায় উঠে দাঁড়াল সারওয়ার। হ্যাঁ, সেটাই বরঞ্চ ভালো। এমনিতেও মা ভীষণ টানছিল। মা চোখ বুঁজে শুয়েছিল বিছানায়। বুক পর্যন্ত কাঁথা মুড়ি দেওয়া। সারওয়ার বুঝতে পারলো না, ঘুমিয়েছে না জেগে আছে। ও মার সঙ্গে কখনো যা করে না, আজ তাই করলো, মার কপালে হাত রাখলো। অমনি চোখ খুললো মা, ধড়ফড়িয়ে উঠে বসতে চাইলো, ‘কিরে?’ ‘না। এমনি?’ ‘তোর কিছু হয়েছে?’ মার কণ্ঠ উদ্বিগ্নে ভরা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো সারওয়ারকে। যে ছেলে এভাবে কখনো মাথায় হাত রাখে না, আড়ষ্ট থাকে, হঠাৎ আচরণে পরিবর্তন হলে তো মনে উদ্বিগ্নতা বাসা বাঁধবেই! ‘না না। কি হবে!’ ও স্বতঃস্ফূর্ত হওয়ার চেষ্টা করে। ‘কখন ফিরলি?’ ‘এই তো মাত্র!’ ‘ও!’ মা আবার চুপ হয়ে গেল। সারওয়ার মার কপাল থেকে হাত সরিয়ে সোজা আলমারির দিকে তাকায়। তিন নম্বর তাকে দেখা যাচ্ছে পুরনো মডেলের বিশাল সাইজের সেই রেডিওটা। যেটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মার আড়ালে এক সদ্য নববিবাহিতা কামরুন নাহারের অনেক অনেক হিরন্ময় স্মৃতি। সৎ পুলিশ কনস্টেবল বাবা বোধ করি এই রেডিওটা ছাড়া জীবনে মাকে তেমন কিছুই দিয়ে যেতে পারেন নি। বিয়ের পর পরই ঢাকা থেকে বদলি হয়ে চলে গিয়েছিলেন কুমিল্লাতে। সেখানকার পুলিশ স্টাফ কোয়ার্টারে মার সময়গুলো বড্ড একা একা কাটতো। সেলাই করে, সংসার সামলিয়ে আর কতক্ষণ কাটানো যায়? বাবা তাই একদিন এই ঢাউস সাইজের রেডিওটা কিনে দিয়েছিলেন মার জন্য। যাতে গানটান শুনে মার সময়গুলো ভালো কাটে! প্রথম যেদিন রেডিওটা আনা হলো, সেদিনকার গল্পটা মার মুখ থেকে যে কতবার শোনা! ‘সেদিন ছিল ফুটফুটা চান্নি রাইত। আমি আর তর বাবা বারান্দার মধ্যে বইসা বইসা রাতের বেলা মধুমালার নাটক শুনছিলাম!’ আগে আগে গল্পের ফাঁকে গানও গেয়ে শোনাত মা ‘আমি স্বপ্ন দেখলাম যাইতে হবে গো মধুমালার দেশে...’ এই রেডিওকে ঘিরে সেদিন সেই মফস্বল শহরে দু’জন মানুষের জীবনটা নতুন এক উন্মাদনায় ভরে গিয়েছিল। ‘তোর বাবা খুব হিন্দি গান পছন্দ করতো। বাসায় যতক্ষণ থাকতো খালি আগরতলা সেন্টার ধরতো, খুঁইজা খুঁইজা হিন্দি গানের অনুষ্ঠান বাইর করতো!’ বাবার গল্প বলতে গেলে মা কেমন ছেলেমানুষের মতো হয়ে উঠেন। আবেগ ঝরে পড়ে। ‘তর বাবা যখন থাকত না, আমার সময়টাও যে কেমন কইরা কাইটা যাইতো রেডিওটার তালে তালে, বুঝতে পারতাম না! আজকালকার দিনে কতকিছু বাইর হইছে, টিভির পর টিভি, ডিশের লাইন, ইন্টারনেট, হাবিজাবি, কত কিছু! কিন্তু সেই যে রেডিওর মজা! সেইটার সঙ্গে আর কোন কিছুর তুলনা হয় না!’ রেডিওর প্রতি মার এই পরম আবেগটা যে আসলে কোথা থেকে তৈরি হয়েছে, সারওয়ারও তা জানে। গভীরভাবেই জানে। মার মুখে শুনেছে, কিছু কিছু নিজের চোখেও দেখেছে। আবার খালা-মামার কাছেও কিছু শোনা। একাত্তরের সেই দিনগুলিতে ওর বয়স তখন ছিল মাত্র তিন কী চার! ঝাপসা ঝাপসা অনেক স্মৃতিই রয়ে গেছে মনের মধ্যে। সেই ঝাপসা স্মৃতি দিয়েই ও জানে, বড় তীব্রভাবেই জানে, একাত্তরে এই রেডিওটাই হয়ে উঠেছিল মার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন, আশ্রয়, প্রেরণাও। সেই ঝড়ো হাওয়ার দিনগুলোতে যখন পুলিশ কনস্টেবল বাবা আজহারুল ইসলাম কী করবেন ঠিক বুঝতে পারছিলেন না, একদিকে সরকারী চাকরির কর্তব্যনিষ্ঠতা অন্যদিকে দেশের মানুষের প্রতি চরম অত্যাচারের বদলা নেওয়ার ভেতর তাগিদ- এই দ্বন্দ্বে যখন জর্জরিত, তখনই একদিন খবর এলো রাজারবাগ পুলিশ লাইনে হায়েনারা কাপুরুষের মতো চুপিসারে আক্রমণ করে পুলিশ বাহিনীর হাজার হাজার সদস্যকে হত্যা করেছে, তখন তখনই রাগে-দুঃখে ক্ষোভে পুলিশ ফাঁড়ি থেকে কৌশলে বেরিয়ে এসেছিলেন। মা আর ওদেরকে গ্রাম সাইডের এক স্কুল মাস্টার বন্ধুর বাড়িতে রেখে সোজা চলে গিয়েছিলেন আন্ডারগ্রাউন্ডে। দেশের স্বাধীনতার টানে সন্তান, প্রিয়তমা স্ত্রী কারো জন্যে পিছু ফিরে পর্যন্ত তাকাননি, এক মুহূর্তের জন্যও দেরি করেননি, উল্কার মতই ছুটে গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। বাবা চলে যাওয়ার পর সন্দেহ নেই যে, মায়ের জীবনটা অসীম শূন্যতায় ভরে গিয়েছিল। মানুষটা কোথায় আছে, কী খাচ্ছে না খাচ্ছে এসব চিন্তা তো ছিলই, মাঝে মধ্যেই আতঙ্কে সারা গা শীতল হয়ে আসতো মা াপাশি ওকে নিয়েও কম দুশ্চিন্তায় ভোগতে হতো না! কতবার যে মিলিটারি আসার সংবাদ শুনে পালাতে হয়েছে এ-গ্রাম থেকে সে-গ্রামে। সেসব টানাহেঁচড়ার দিনগুলোতেও রেডিওটাকে মা পরম যতেœ বুকের একপাশে আগলে রাখতেন। এক মুহূর্তের জন্যও সঙ্গছাড়া করতেন না। যেন রেডিওটার মধ্যেই লুকিয়ে আছেন বাবা, বাবাকে মা স্পষ্ট দেখতে পান, ছুঁতে পান হাত বাড়িয়ে। বাবার কাছ থেকেই মা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনার অভ্যেসটা রপ্ত করেছিল। বাবা মুক্তিযুদ্ধের এক একটা সাফল্যের খবর শুনতেন, আর নতুন দেশকে ঘিরে স্বাপ্নিক হয়ে যেতেন। চরমপত্রের খবর শুনে মাঝে মধ্যে ছেলেমানুষের মতো হাততালিও দিয়ে উঠতেন। পরমুহূর্তেই সামলে নিতেন নিজের আবেগ। তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনাটাও যে একটা ঘোরতর বিপদ ছিল! সেই ভয়ানক আতঙ্কের দিনগুলোতেও যখন চারদিক থেকেই আক্রমণ আসার আশঙ্কা, যখন অনিশ্চয়তার অন্ধকার ঘন হয়ে এসেছে, তখনও এই রেডিওটা দিয়েই বাবার অভাবটা ভুলতে চেয়েছে মা। আজও মনে আছে, এত ভয়ের মধ্যেও লুকিয়ে লুকিয়ে মা ভলিয়ম কমিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনেছে। মুক্তিযোদ্ধারা কেমন আছে, কোথায় কেমন করছে, কোনো আতঙ্কের খবর শুনতে হবে কীনা, এক বাবার ছায়ায় যেন পুরো মুক্তিযোদ্ধারাই আপন হয়ে উঠেছিল। রেডিওর মাধ্যমেই বুঝি মানুষটাকে আবার নিজের কাছে ফিরে পেত। মার কাছেই শোনা, তখনকার সমস্ত অনুষ্ঠানই তার এক রকম মুখস্থ ছিল। মার দিশেহারা মন সবসময় খুঁজে বেড়াত বাবার কোনো সংবাদ পাওয়া যায় কীনা! না বাবার কোনো সংবাদ কখনো রেডিওতে পাওয়া যায়নি। রেডিওতে কেন, কোনো সূত্র থেকেই নয়। কম চেষ্টা করেছে মা? পুলিশ ডিপার্টমেন্টের প্রতিটি দরোজায় দরোজায় খোঁজ করেছে, কেউ কোনো হদিস দিতে পারেনি। একজন শুধু জানিয়েছিল, আগরতলার ট্রেনিং ক্যাম্পে আজহারুল ইসলাম সাহেবকে একবার দেখেছিলেন। সে পর্যন্তই। তারপর যুদ্ধ শেষ হলো। বিজয় এলো সগৌরবে। কিন্তু বাবা নামের সেই মানুষটা আর কোনোদিন ফিরে এলো না। শুরু হলো মার এক নতুন যুদ্ধ। বেঁচে থাকার, টিকে থাকার, দু’দুটি সন্তান নিয়ে। যুদ্ধের সময়ই পুলিশ ডিপার্টমেন্টের কোয়ার্টার ছাড়তে হয়েছিল, সেখানে আর ফেরা হলো না। কুমিল্লার এক নিভৃত গ্রামে মা ওদের দুই ভাই-বোনকে যে কত কষ্ট করে মানুষ করেছেন, সেটাও এক অবর্ণনীয় অভিজ্ঞতা। পুলিশ বিভাগের সৎ অফিসার আজহারুল ইসলাম এক টাকাও ব্যাংক ব্যালান্স রেখে যেতে পারেননি। কিন্তু বুকের রক্ত দিয়ে কামরুন নাহারকে এক নতুন দেশের স্বাধীন ভূমি উপহার দিয়ে গিয়েছিলেন আর স্বাধীনভাবে বাঁচার স্বপ্ন। সেইটুকু ছিল মার সম্বল। সেটা নিয়ে যে কী প্রবল উৎসাহ মার। একদিনের জন্যও কোনোদিন দমে যাননি। গরু, খাশি, মুরগি সব পেলেছেন, গরুর দুধ বিক্রি করে পয়সা জুটিয়েছেন। মুরগির ডিম বিক্রি করে স্কুলের বেতন যুগিয়েছেন। এক দিনের জন্যও কখনো বুঝতে দেননি, সংসারে অভাব আছে দারিদ্র্য আছে। শুধু কী মুরগি-হঁাঁস-গরু পালন, শাকসবজি বুনেও মা রোজগার চালাতেন। তারপর ধীরে ধীরে গড়ে তুললেন আজহার কুটিরশিল্প কেন্দ্র। মা নিজের হাতে মাটির পুতুল গড়েছেন, চমৎকার ডিজাইনের সব ঘর সাজানোর পাত্র বানিয়েছেন। বাহারি ডিজাইনের শিকা, বেতের ঝুড়ি, বেতের পাটি, প্রাকৃতিক সম্পদ দিয়েই মা ধীরে ধীরে পসার বাড়িয়েছেন। কুমিল্লার সেই ছোট্ট গ্রামের সেইসব মৃৎপাত্রের যশ সারা শহরেই ছড়িয়ে পড়েছে, শহর ছাড়িয়ে রাজধানীতেও। সব রকম সামগ্রীর অর্ডারের পর অর্ডার আসতে লাগলো। ওদের ভাই-বোনকে মানুষ করতে মাকে আর বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু বেচারীকে কষ্ট করতে হয়েছে। প্রতিনিয়তই অসম্ভব কষ্ট। সব কষ্টই মা হাসিমুখে সয়ে গেছেন। আর, তখনো মার এই কষ্ট এই সংগ্রামের একমাত্র সঙ্গী ছিল এই রেডিওটা। মাকে একটা এলসিডি টিভি কিনে দিয়েছিল ও, কিন্তু মা ওটা ছেড়েও দেখতেন না। দেখার অভ্যাস বা প্রয়োজনই যেন বোধ করতেন না। কাজের সময়, কাজের অবসরে এই রেডিও শুনে শুনেই তিনি শক্তি পেতেন, প্রেরণা পেতেন, যেন বাবাই ছুঁয়ে থাকত মাকে। অথচ একদিন সেই রেডিওটাকেই ছুঁড়ে ফেলে দিলেন হাত থেকে। সেও এক ব্যর্থতার ইতিহাস। ওরা তখন ঢাকা এসে নতুন করে মাথা গোঁজার চেষ্টা করছে। অদিতি কলেজে ও ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে নতুন চাকরি পেয়েছে, ব্যাংকে। মার কুটিরশিল্পের ব্যবসাটা তখনো চলছে রমরমিয়ে। যখন মার সম্পূর্ণ নির্ভার আর নিশ্চিত হওয়ার কথা, তখনই যেন শুরু হলো মর্মদাহনের নতুন যন্ত্রণা! একের পর এক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শেষে এমন এক স্তরে পৌঁছাল, যেখানে মতিউর রহমান নিজামী বনে গেলেন শিল্পমন্ত্রী! যে রেডিওতে বাবার সঙ্গে রাতের পর রাত গান শুনতেন-নাটক শুনতেন, যে রেডিও শুনে শুনে দু’জনে ভবিষ্যতের স্বপ্ন রচনা করেছেন, যে রেডিও শুনে বাবার স্মৃতিকে বুকে আগলে রাখতে পেরেছেন, সেই রেডিওতে মা রাজাকারদের গাড়িতে রাষ্ট্রীয় পতাকা রাখার খবরটা কোনভাবেই মেনে নিতে পারেননি। শুধু কী পতাকার খবর! সেই বকধার্মিকদের কাছ থেকে শুনতে হলো দেশ গড়ার নতুন ছবক! রাগে দুঃখে ক্ষোভে মা রেডিওটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। রেডিওটা দেখলেও যেন বুক জ্বলে উঠে তার। ওটা রেখে দিয়েছেন আজ বারো বছর হলো আলমারির ভেতর। এই বারো বছর পর এখন কী এমন ঘটলো যে, মা রেডিওটার জন্য এমন অস্থির হয়ে উঠেছেন? মুহূর্তেই মনে পড়লো নিজামীর ফাঁসি হয়েছে! শুধু কি নিজামী? বেশ কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয়েছে। আশ্চর্য! এই সামান্য কথাটা ওর মনে আসেনি কেনো এতদিন! বুঝতে পারলো, মুক্তিযুদ্ধকে মা কী সংগোপনে বুকের গভীরে লালন করে। লজ্জাও হলো মার অনুভূতিকে ও ঠিকঠাক উপলব্ধি করতে না পারায়। অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর মা জিগ্যেস করলেন, ‘কিরে! কিছু বলবি?’ ‘মা আলমিরার চাবিটা কোথায় বলো তো?’ ‘কেনো, কি করবি?’ ‘বলো না কোথায়?’ মা শুয়ে শুয়েই বিছানার লেপের নিচে হাতড়িয়ে মুহূর্তেই আলমারির চাবিটা বের করে দিল। চুপচাপ উঠে দাঁড়াল সারওয়ার। এগিয়ে গেল পুরনো সেই আলমারির দিকে। হাত বাড়িয়ে রেডিওটা বের করে মার সামনে এসে বসলো। কামরুন নাহার চুপচাপ তাকিয়ে ছেলের কা- দেখেন। মার দিকে তাকিয়ে ¯িœগ্ধ হাসি ছড়িয়ে সারওয়ার রেডিওটার নব ঘোরায়। বাজে না ওটা। হালকা ঝিরিঝিরি শব্দ পাওয়া যায়। সারওয়ার মরিয়া হয়ে একবার ঝাঁকায়, আরেকবার ব্যাটারিগুলো বের করে উল্টেপাল্টে দেখে। কাজ হয় না। বাজে না। হঠাৎ মা কান্না ভেজা গলায় বলে উঠলো, ‘খোকা ওটা আর বাজবে না?’ সারওয়ার তখনো চেষ্টা করে যাচ্ছে। ‘আমার নাতি-নাতনিকে আমি কী শোনাবো, কী জানাবো? খোকা ওটা আর ঠিক হবে না?’ সারওয়ার মুখ তুলে তাকাল কিন্তু হাল ছাড়লো না। রেডিওটা নিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো, ‘যেখান থেকে পারি আমি আজই এক্ষণি এটা ঠিক করে আনবো! মা তুমি কোন চিন্তা করো না।’ ঘর থেকে রেডিওটা হাতে নিয়ে সারওয়ার বের হয়ে যায়। এখন এই রাতের বেলা খোকা তার কোথায় যাচ্ছে, কীভাবে কোথ থেকে ঠিক করবে রেডিও? কামরুন নাহার ভেবে পায় না, তবু অপেক্ষার বাতি জ্বালিয়ে বসে থাকে।
×