ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দীপক চৌধুরী

একাত্তরের যাত্রী

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬

একাত্তরের যাত্রী

শহরজুড়ে আতঙ্ক। সকাল দশটা। আগেই ঘোষণা করা হয়েছিল সকাল দশটা থেকে কার্ফু শিথিল করা হবে। অতীতে কখনও শহরের এমন রূপ দেখিনি। আমরা গতরাতে এই ভুতুড়ে শহরের বাসিন্দা ছিলাম। মৃত্যুনগরী থেকে বেরিয়ে এসেছি। এটা সম্ভব হয়েছে যার জন্য তিনি প্রিয় জমিলাবু। আমরা দৌড়ে পালাচ্ছি শহর থেকে। উঠব লঞ্চে। এটি সুনামগঞ্জ শহরের ঘাট ছেড়ে যাবে। কখন ছাড়বে আমরা কেউ জানি না। তবু ছুটে চলছি লঞ্চের উদ্দেশে। ভাগ্য ভাল বলতে হয়- লঞ্চ পেলাম। শেষ যাত্রী শুধু আমরা নই। পুরো শহরের মানুষ যেন এর যাত্রী। তাড়াহুড়ো সবার মধ্যে। যাত্রীদের মধ্যে সিঁড়িতে পা দেয়ার প্রতিযোগিতা। আজ যেন অভিভাবক জমিলাবু। তার পিছনে আমি, আমার শার্টে ধরে জয়া। লঞ্চের উঁচুতলায় উঠছি। বসার জায়গা নেই। এখানেও জমিলাবুকে যেন বসার জায়গা করে দেয়া হচ্ছে। সম্ভবত যাত্রীরা তার প্রতি উদার। প্রথমে জয়াকে এরপর আমাকে বড় বড় চোখ করে একবার পড়ে নিল যাত্রীরা। সবার চোখ একসঙ্গে এদিকে। জমিলাবু বলল, বইসা পড়। প্রথম দর্শনেই জমিলাবুকে আমার ভালো লেগেছিল। তার হাসি-হাসি মুখ সারাক্ষণ। কঠোর পরিশ্রম শেষেও তার মুখে ক্লান্তি নেই, হাসি দেখা যেত। জীবনের সুখ-দুঃখ কষ্ট-ভালোবাসা সবকিছুই জয়াদের পরিবারকে ঘিরে। ব্যক্তিগত কোন চাওয়া পাওয়া নেই এ মহিলার। অত্যন্ত বিশ্বস্ত এ নারী শিশুকাল থেকেই জয়াদের পরিবারে। বড় হওয়ার পর বিয়েও হয়েছিল। জয়ার বাবা তাকে বিয়ে দিয়েছিলেন। স্বামী এ বাড়ির বাজার-হাট করতেন। নানারকম ফুট ফরমায়েশ করতেন। তাদের দাম্পত্য জীবনও বেশ ভালোই কাটছিল। কিন্তু ছয় বছরের সংসার জীবনেও জমিলাবুর কোন সন্তান না হওয়ায় একদিন স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যান। এসব ঘটনা প্রায় পনেরো বছর আগের। অবশ্য এজন্য জমিলাবুর আফসোস নেই। কষ্টও নেই। জয়া একদিন গভীর বিশ্বাস থেকে গল্পচ্ছলে বলেছিল, জমিলাবুর ধৈর্য-সাহসের তুলনা হয় না রে বাবলা। শতাধিক নারী-পুরুষে বোঝাই লঞ্চ। নদীর বুক চিরে দুইপাড়ে ঢেউ তুলেছে। নিজের মতো ছুটে চলেছে সুরমা রিভার এক্সপ্রেস। যাত্রীদের চোখমুখ দেশে বুঝতে পারি তাদের বুকেও পাহাড় সমান কষ্ট। ফুঁপিয়ে কাঁদছিল এক নারী। হঠাৎ তার কান্না বন্ধ। আমাকে দেখিয়ে জয়ার কাছে জানতে চাইল, তোমার সোয়ামি। মহিলা জয়ার জবাব না পেয়ে আমার দিকে তাকাল। নিশ্চয় ভেবে বসে আছে- আমি স্বামী, জমিলাবু আমাদের বাসার কাজের মহিলা। জয়া আমার স্ত্রী। আবারও জানতে চাইলো, তোমার সোয়ামি? মাথা নেড়ে আমি বললাম, না। কেউ মুখে কাপড়ের আঁচল গুঁজে কান্না দমাচ্ছে। ওরাও আমাদের মতোই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ছুটছে। কঠিন ও জটিল মুহূর্তগুলোতে জমিলাবুর ধৈর্য ও সাহসের পরীক্ষা দেখলাম। গত বিশ ঘণ্টায় কখনও আমি আবার কখনও জয়া দুজনই জ্ঞান হারিয়েছি, বমি করেছি, বিধ্বস্ত ছিলাম। তাজা মৃত্যুর শোক সহজে ভুলবার নয়। তবু যেন শহর থেকে দূরে কোথাও এক নিরাপদ গ্রামে পৌঁছতে যাচ্ছি- একথা ভেবে আপাতত এক ধরনের স্বস্তিবোধ করছি। কারণ, এই লঞ্চের হামিদ মিস্ত্রি বলেছে গোপালপুর আর বেশি দূরে নয়, সামনেই। জমিলাবু বার বার ভরসা দিয়ে যাচ্ছে, মুনির সাহেবের বাড়িতে কোন সমস্যা হবে না। তার বাড়িতে জয়ার কদর হবে। এটাই স্বাভাবিক। জয়াদের ডাইনিং টেবিলে জমিলাবুর হাতে বহুদিন ভাত খেয়েছেন মুনির হোসেন। গোপালপুর লঞ্চঘাটে নেমেছি আমরা। ছবির মতো একটি গ্রাম। গাছ গাছালিতে ভরা। জয়া একটি কিশোরকে ডেকে বলল, খোকা, মুনির সাহেবের বাড়িটি চেন? চিনবো না ক্যান? ভালা কইরা চিনি। আপনেরা তাইনের কুটুম? জয়া উত্তর দিল, হ্যাঁ, আমরা উনার বাড়িতেই যাব। কিশোর জমিলাবুর হাত থেকে একটি ব্যাগ নিয়ে বলল, আসেন, আমার লগে আসেন। উনি মনে হয় বাড়িতেই আছে। আমরা তাকে অনুসরণ করি পিছন থেকে। দোতলা পাকা বাড়ি। এর একপাশে দোচালা টিনের ঘর। উত্তর পাশে লম্বা টিনের ঘর। গোয়ালঘরে গরু-মহিষ সারি সারি বাঁধা। বাড়ির এদিক ওদিক আম-জাম-কাঁঠাল-পেয়ারা গাছ। নারকেল গাছ মাথা উঁচিয়ে আছে টিনের চালা ছাড়িয়ে। উঠোনে আরাম কেদারায় আধশোয়া হয়ে তামাক খাচ্ছিলেন এক মধ্যবয়স্ক মানুষ। আমাদের দিকে পলকহীন তাকালেন কয়েক সেকেন্ড। এরপর স্বাগত জানানোর ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে গেলেন। বললেন, জয়া না? তুমি তো জয়া? নাকি ভুল বলছি? মুনির চাচা, জি, আমি জয়া। মুখে ওড়না চেপে জয়া ফুঁপিয়ে উঠল। কিছু বোঝার কথা নয় মুনির সাহেবের। মারে, তোমার বাবা মা কেমন আছেন? শুনেছি শহরের অবস্থা খুব খারাপ। তারা আসলেন না কেন? তার কথা শুনে জয়ার বুক ফাটা কান্না শুরু হলো। মাথা নুইয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল জয়া। মা-বাবা কেউ নেই এখন। রাজাকাররা দেখিয়ে দিল। তাদের ধরে নিয়ে গেছে পাঞ্জাবী মিলিটারি। পালিয়ে এসেছি আমরা। সকল উৎকণ্ঠা মুনির সাহেবের চোখেমুখে। হতভম্ব হয়ে গেলেন। বলো কী। প্রায় মিনিটখানেক তার মুখে শব্দ নেই। মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে আছেন। জমিলাবু জয়ার হয়ে সহজভাবেই কথাগুলো জানানোর জন্য বলল, আহারে, শুনেছি মিলিটারিরা লাইন ধরে মানুষ মারে। দুইটা দিন চইলা গেল, খোঁজ পালাম না। খালাম্মারে যদি একবার চোখের দেখা দেখতে পারতাম। তারা এখন কেমন আছে, কি করতাছে আল্লাহ্ জানে। মুনির সাহেবের অবস্থা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তিনি যেন আকাশ থেকে পড়েছেন। শব্দহীন তিনি কাঁদছেন। অস্ফুটে উচ্চারণ করলেন, ভাবির ঋণ কোনদিন শোধ করতে পারব না। তিনি আমাকে ঋণী রেখে গেলেন রে মা। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে পরম মমতায় জয়াকে বুকে টেনে নিয়ে বললেন, আমি তোমার আব্বাকে খুঁজে বের করব, খুঁজে বের করব। মুনির সাহেব আমাদের নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। আমরা তাকে অনুসরণ করছি কেবল। ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ঘরে কয়েকটি লণ্ঠন জ্বলছে। মুনির সাহেব স্ত্রীর সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমাদের গুরুত্ব ও অসহায়ত্ব বোঝাতে এভাবে বললেন, শোনো শিরিনের মা, এই হচ্ছে আকবর ভাইসাহেবের একমাত্র মেয়ে। তোমার কাছেও বহুদিন এ মেয়ের গল্প করেছি। আজ থেকে এ বাড়িতেই তারা থাকবে। ওদের দেখাশোনার সব দায়িত্ব তোমার। আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকা কিশোরীর চোখ দুটি মেহমানদের স্বাগত জানাল। স্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কিশোরীকে মুনির সাহেব বললেন, শিরিন, তোমার জয়া আপুর সঙ্গে সারাক্ষণ থাকবে তুমি। যাতে আমার এই মায়ের কোন কষ্ট না হয়। যখন যা দরকার তোমার আম্মুকে জানাবে। রাতে আমাদের দোতলায় ঘুমুতে দেয়া হয়েছে। দক্ষিণমুখী একটি কক্ষ। দুটি খাট। বড় খাটে চিংড়ি মাছের মতো শুয়েছে জয়া। জানালার পাশে ছোট একটি খাট। শুয়ে আমি বাতাস খাচ্ছি। হালকা বাতাস আমার গা বুলিয়ে দিয়ে যায়। গাছের পাতাগুলো ছন্দের তালে তালে নড়ে। আমার চোখে একফোটা ঘুম নেই। গতরাতের নিষ্ঠুর ঘটনাগুলো জীবনে কখনও ভুলতে পারব না। সকালবেলার নৃশংস দৃশ্যগুলো চোখ থেকে সরাতে পারছি না। পিতার সামনে সন্তানকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যার পর উল্লাস করছিল কিছু মিলিটারি। আমার চোখের সামনে নেচে উঠছে সেই দৃশ্য। কিশোরীদের চুলের গুছিতে ধরে মিলিটারিরা কীভাবে গাড়িতে তুলছিল। তারা প্রায় বিবস্ত্র করা তরুণীদের আর্তনাদ উপভোগ করছিল। প্রাণপণ ছুটে পালাতে যাওয়ার মুহূর্তেও মানুষগুলোকে পাখির মতো গুলি করে মেরেছিল মিরিটারিরা। কীভাবে পালিয়ে এসেছিলাম একথা ভাবতেই গা শিরশির করছে। আমাদের দুজনের মধ্যখানের ফ্লোরে ঘুমিয়েছে জমিলাবু। তার এভাবে ঘুমানোটা আমার কাছে দৃষ্টিকটু ঠেকছে। জমিলাবু আমার খাটে ঘুমাবেন ভেবে খাটের একপাশে কাৎ হয়ে আছি। ভাবছি কাল দিনে তাকে আমার খাটে শুইতে বলব। হঠাৎ শুনি জমিলাবু ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। কান্নার শব্দ যাতে বাইরে না যায় সেই চেষ্টা করতে গিয়ে নিজের মুখে কাপড় চেপে ধরেছেন। তার বুক ফেটে যাচ্ছে যেন। নিশ্বাসের শব্দ পাচ্ছি। লণ্ঠনের আলো বাড়িয়ে জমিলাবুর পাশে বসি। কীভাবে সান্ত¡না দেব বুঝতে পারছি না। জমিলাবুর কান্না থামবার নয়। বাইরে পথ ধরে কেউ একজন গলা ছেড়ে গান গেয়ে হেঁটে যায়, হলদিয়া পাখি সোনারই বরণ, পাখিটি ছাড়িল কে.... পুরো গানটি গায় লোকটি। আমি নিশ্চিত জয়া ঘুমায়নি। বারবার কষ্টের শ্বাস ফেলছে। আমার বুকের ভিতরটা অস্থির হয়ে উঠেছে। এসব কথা ভেবে হঠাৎ করেই বেশি বেশি কষ্ট পাচ্ছি। জয়ার বাবা-মায়ের মুখটি চোখে ভাসছে বারবার। মাঝেমধ্যেই তারা বলতেন- বাবলা, তোমার মতো একটি ছেলে যদি থাকত আমাদের। কেন এমন কথা বলে লজ্জা দিতেন জানি না। হঠাৎ আমার বাবার মুখটিও চোখের ওপর ভেসে ওঠায় অস্থিরতা শুরু হয়েছে। কয়েক মিনিট পর তা আরও বেগবান হয়েছে। অথচ এমনটা হওয়ার কথা না। তার সঙ্গে আমার কোন আকর্ষণীয় মুহূর্তের কথা মনে করতে পারছি না। বরং মায়ের সঙ্গে আমার অনেক মধুময় স্মৃতি রয়েছে। খারাপ মানুষের কুনজর থেকে মুক্ত থাকার জন্য মৌলভী সাহেবের তাবিজ সুতায় বেঁধে আমার কোমরে পরাতেন। গোসলের পর মা আমার কপালে বড় একটি কালো টিপ পরিয়ে দিতেন। আমি কয়েক মিনিটের মধ্যেই এটি মুছে ফেলতাম। মা ফের কালো টিপ পরিয়ে দিতেন। রাতে শাদা পরীর গল্প বলে ঘুম পাড়াতেন। চাঁদ থেকে লালঘোড়া নেমে আসার কথা ছিল। সেই ঘোড়া কেবল মা আর আমাকে চাঁদে নিয়ে যাবে। আমার প্রশ্ন, বাবাকে নেবে না মা? না বাবা, শুধু তুই আর আমি যাব, মা-ছেলে। মায়ের মুখের সেই গল্প কতদিন শোনা হয়নি। তিনদিন পর। সকালে নাস্তার টেবিলে আমি আর জয়া। মিসেস মুনির আমাদের নাস্তা খেতে দিয়ে চা আনতে গেছেন। জয়া আজও কিছুই খাবে না। জমিলাবু এ বাড়ির পরিবেশের সঙ্গে মিশে যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন সম্ভবত। তাকে রান্নাঘরের দিকে ছোটাছুটি করতে দেখা গেছে। শিরিন আমাদের টেবিলের পাশে এসে দাঁড়ালে জয়া ওকে হাত ধরে পাশে বসাল। নাস্তার টেবিলে এসে মুনির সাহেব বললেন, চোখ দেখে বুঝতে পারছি তোমাদের ঘুম হয়নি। গ্রামের পরিবেশটাই অন্যরকম। এ পরিবেশে খাপ খাওয়াতে সময় লাগবে রে মা। মুনির সাহেবের কৌতূহল আমাকে নিয়ে। আমি কোত্থেকে এসেছি, কে? তার চোখ পড়ে আমি বুঝতে পারি এ কৌতূহল। আমি নিশ্চিত জানি জয়া এখনই বিষয়টি পরিষ্কার করবে। সত্যিই তা-ই হলো। জয়া আমাকে দেখিয়ে বলল, মুনির চাচা ও হচ্ছে বাবলা। কলেজ হোস্টেলে থাকত। মা তো খুব পছন্দ করতেন বাবলাকে। বাবাও ওকে খুব ভালোবাসতেন। আমি তাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি। আমার সকল শরীর পড়ে নিয়ে জয়াকে উদ্দেশ্য করে মুনির বললেন, খুব ভালো করেছো। জয়া খানিকটা ইতস্তত করে বলল, মুনির চাচা, বাবা-মায়ের খোঁজ নিতে হবে আপনাকে। মুনির সাহেব কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, বলো কীরে মা। একথা কী তোমার বলতে হবে? শহরে লোক পাঠিয়েছি। যে কোন পরিস্থিতিই হোক না কেন তাদের নিয়ে আসা হবে। তুমি একদম চিন্তা করবে না। তিন সপ্তাহ কেটে গেছে। জয়ার বাবার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না, মায়েরও না। মুনির সাহেব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মা-বাবাকে বাজারে দেখা গেছে- উড়ো খবর পেয়ে গতরাতে ফের দুজন লোক পাঠিয়েছেন ধর্মপাশা বাজারে। তিন সপ্তাহের মাথায় জয়ার মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আজ বুধবার। জয়ার জন্মদিন। মানসিক বিপর্যয় কিছুটা হলেও কাটিয়ে উঠেছে। ধর্মপাশা বাজারে মিলিটারি এসছে এখবর গাঁয়ে চাউর হলে হঠাৎ উত্তেজনা বেড়ে যায়। সন্ধায় শোনা গেল- খবর সঠিক নয়। রাজাকারেরা দুদিন পর এ গাঁয়ে আসবে মিলিটারি নিয়ে। জমিলাবু পুরোপুরি মিশে গেছেন এ পরিবারের সঙ্গে। রান্না ঘরেই তিনি বেশিক্ষণ সময় কাটান। জয়া আর আমার পছন্দ অপছন্দের খাদ্যতালিকা জানিয়ে দেন অন্দর মহলকে। সেখান থেকে আমাদের সামনে সুন্দরভাবে পৌঁছে দেয়া হয় টক-ঝাল-মিষ্টি খাবার। শিরিন শুরুর দিকে আমার দিকে লাজুক চোখে তাকাত। সারাক্ষণ জয়াকে নিয়ে তার ব্যস্ততা ছিল। এখন জয়ার সঙ্গে ব্যস্ত সময় কাটানোর চেয়ে আমার সঙ্গে গল্প করা, আড্ডা দেয়াটা বেশি পছন্দ করে। আরও বুঝতে পারি শিরিন লজ্জা কাটিয়ে উঠেছে নিজে থেকেই। অকারণেই একদিন জানতে চাইলো, বাবলা ভাইয়া কেমন আছেন? তাকালাম ওর দিকে। উত্তরের জন্য শিরিন অপেক্ষা করল না। বলা যায় ভ্রƒক্ষেপও করলো না। লক্ষণীয় বিষয়- শিরিন যেচে যেচে কথা বলতে চায় নানা প্রসঙ্গে। তার ভাই সম্পর্কে জানিয়েছে, ওর ভাই ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। ছাত্রলীগের লিডার। বাড়িতে এলে গ্রামের মানুষ দলবেঁধে তাকে দেখতে আসে। মিলিটারিরা তাকে খুঁজছে। ইয়াহিয়া খানের অর্ডার রয়েছে ‘ভাইয়া’কে দেখামাত্র গুলি করে মেরে ফেলা হবে। ঢাকায় গোলাগুলি শুরু হওয়ার পরই তিনি পালিয়ে আত্মগোপন করেছেন। শুনেছি, ঢাকার পাশে মুন্সীগঞ্জে এখন। গোপালপুর উচ্চ বালক বালিকা বিদ্যালয়ের ক্লাস টেনের ফার্স্ট গার্ল শিরিন বেগম। খুবই চালাক জিনিস। আমার সঙ্গে একান্তে গল্প করার জন্য দুপুর বেলাটা সে বেছে নিয়েছে। এ সময় ওর মা রান্নাঘরে চুলা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। বাড়ির গৃহকর্মী নারী-পুরুষ থাকেন নানা কাজে। জয়া গোসল করতে যায়। আজ শিরিন কানের কাছে মুখ এনে বলল, তুমি নাকি যুদ্ধে যাবে? মুক্তিযুদ্ধে? কে বলল? জয়া আপু। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে শিরিন। কিছু বলতে চাও? আমিও তোমার সঙ্গে যুদ্ধে যাব। হঠাৎ এ পরিবর্তন? আমি খানিকটা বিস্মিত। তবু বললাম, তা হবে না। তুমি মেয়ে। জয়া আপু মেয়ে না? সে যদি যেতে পারে আমি পারব না কেন? তুমি ছোট। অপ্রাপ্তবয়ষ্ক। মিথ্যা কথা। আমি গ্রামের মেয়ে। ক্লাস টেনে পড়ি। ম্যাচিউরড। কিন্তু? কোন কিন্তু নয়। আমি শুধু তোমার সঙ্গে থাকব।
×