ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সেলিনা হোসেন

মুক্তিযুদ্ধের গ্রাম

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬

মুক্তিযুদ্ধের গ্রাম

মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে একটি উপন্যাস লিখব বলে তথ্য সংগ্রহের জন্য গিয়েছিলাম ১১নং সেক্টরের কামালপুর ও ধানুয়া গ্রামে। এ দুটি গ্রাম বর্তমান জামালপুর জেলার অন্তর্গত এবং ভারতের মেঘালয় সীমান্তের কাছে বাংলাদেশের অংশ। সীমান্তের ওপারে যে গ্রাম তার নাম মহেন্দ্রগঞ্জ, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ১১নং সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ছিল। ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র’ ১০ম খ-ে ১১নং সেক্টরের কথা যারা লিখেছেন, তারা প্রত্যেকে জানিয়েছেন যে, কামালপুর ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুর্ভেদ্য ঘাঁটি। কারণ স্থলপথে জামালপুর-টাঙ্গাইল-ঢাকা সড়কের প্রবেশদ্বার ছিল এই কামালপুর। ওরা জানত মুক্তিবাহিনীর হাতে কামালপুর ঘাঁটির পতন হলে মুক্তিবাহিনী দ্রুত ঢাকার পথে এগিয়ে যেতে পারবে এই পথে। এদিক থেকে মুক্তিবাহিনীরও লক্ষ্য ছিল কামালপুর ঘাঁটির পতন। তাই এখানে বেশ কয়েকটি ভয়াবহ বন্দুকযুদ্ধ সংঘটিত হয়। ব্রিগেডিয়ার আমিন আহমদ চৌধুরী তার লেখায় লিখেছেন, ‘তখনকার দিনে পাকশিবিরে বন্দী মেজর আজিজের ভাষায় বলতে হয়, পাকিস্তানীদের নিজেদের মতে কামালপুর হলো পাক সৈন্যদের মরণঘাঁটি। জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে আজিজকে জিজ্ঞাসা করা হতো ‘হয়ার ইজ ধানুয়া কামালপুর কিংবা হয়ার ইজ ইওর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট।’ উপন্যাসের পটভূমির একটি অংশ হিসেবে আমি ধানুয়া-কামালপুরকে বেছে নেই। কারণ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের ১১ নং সেক্টরের মুক্তিবাহিনী প্রথম ঢাকায় প্রবেশ করে। সে জন্যই জায়গাটি দেখতে যাওয়া। ঢাকা থেকে কামালপুর পৌঁছতে পাঁচ ঘণ্টা লাগল। ব্রহ্মপুত্র নদের অপর পাড়ে ফুলপুর, শেরপুর বকশীগঞ্জ হয়ে কামালপুর পৌঁছলাম। যে রাস্তাটি সোজা রৌমারির দিকে চলে গেছে, সেই রাস্তার মোড়ে কয়েকটি দোকান ছিল। সেখানে থাকলাম আমরা। এই দোকানের পাশ দিয়ে একটি কাঁচা সড়ক উত্তর দিকে সোজা চলে গেছে মহেন্দ্রগঞ্জ সীমান্তে। ইদানীং এই সড়ক দিয়ে বোল্ডার আর কয়লা আমদানি করা হচ্ছে। চারদিকে খোলা মাঠ। কাঁচা রাস্তা ধূলি-ধূসরিত। ট্রাম গেলে ধুলার কুয়াশা তৈরি হয়। কিছুক্ষণের জন্য চোখ মেলে রাখা যায় না। সীমান্তের অপর পাড়ে কাঁটাতারের বেড়া, টাওয়ার। ইমিগ্রেশন পোস্ট নোম্যান্স ল্যান্ডে গরু চরে বেড়ায়। একাত্তরের দিনগুলোতে কী ভয়াবহ ছিল এসব এলাকা! কর্নেল তাহেরের লেখায় পড়েছি, ধানুয়ায় একটা বিশাল জলাভূমি ছিল। এক সময়ে নকল রক্ষাব্যূহ তৈরি করে পাকিস্তান আর্মিকে ওই জলাভূমিতে বের করে এনে হত্যা করা হয়েছিল। মনে হলো, এখনও সেই জলাভূমি আছে। শুধু শীতকালে ওগুলো ধানক্ষেত হয়েছে। এখন কাটা ধানের পরিত্যক্ত প্রান্তর সীমান্তের ডিমারকেশন পোস্টে লেখা আছে : ১০৮৫২ ওহফ-চধশ, দূরে মেঘালয়ের পাহাড়। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি। তাকিয়ে দেখি সামনে সীমান্ত চৌকি। এখন কী নীরব! শুধু মাঝে মাঝে ট্রাকগুলো বোল্ডার কিংবা কয়লা বোঝাই করে আসা-যাওয়া করছে। অথচ এক সময়ে কী প্রচ- শব্দে ভরপুর ছিল এই শান্ত-স্নিগ্ধ প্রান্তর! গাড়ি নিয়ে আমরা হাটে গেলাম। দু-একটা মুদির দোকান খোলা। বাকি চালাগুলো খালি। বিকেল তিনটা থেকে হাট জমে উঠবে। আমাদের দেখে গ্রামবাসী এগিয়ে এলো। কেউ কেউ যুদ্ধের সময়ের কথা মনে করে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। বলতে থাকল, ওই যে বটগাছটা দেখছেন, বিশাল বটগাছ। ওটার গায়ে এখনও গুলির চিহ্ন আছে। ওই যে দেখেন ঘরটা? যুদ্ধের সময়ে গুদাম ছিল। তাকিয়ে দেখেন, শেল পড়ে কেমন ঝাঁঝরা হয়ে আছে। ছাব্বিশ বছর ধরে এ অবস্থায় আছে। এই যে এখানে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ শহীদ হয়েছিলেন। ওপাশে দোকানের পেছনে শেলের আঘাতে কর্নেল তাহেরের পা বিধ্বস্ত হয়েছিল। যেদিনের যুদ্ধে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন শহীদ হয়েছিলেন সেদিন দু-তিন শ’ মুক্তিযোদ্ধাও শহীদ হয়েছিলেন। ধানুয়াতে ওদের গণকরব আছে। আবার কান্না চোখ মোছা। মনে হচ্ছিল আমরা যেন একটি রণক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আছি। আর শত শত মুক্তিযোদ্ধা তাদের গৌরবের দিনগুলোকে স্মরণ করছে। বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে জলপ্রপাতের মতো শব্দরাজি, যেন অচলায়তনের আড়াল সরে গেছে। বলতে ইচ্ছে করছে শত মুখে। ওরা যখন কথা বলছিল, তখন কামালপুর ধানুয়া হয়ে রৌমারীর দিকে ছুটে যাচ্ছিল গাড়ি। মনে পড়ছে ওইদিকে কোদালকাঠি চরে যুদ্ধ করেছিলেন। তারামন বীরপ্রতীক। ওখানে গেলেও এভাবে ছেঁকে ধরবে গ্রামবাসী। বলবে, আমরাও শত মুখে বলতে চাই গৌরবগাথা। মনে হলো আমরাই সেই নষ্ট মানুষ যারা ভান করি, মিথ্যাচার করি ফায়দা লোটার জন্য ব্যবহার করি মুক্তিযুদ্ধকে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য উড়িয়ে দিতে চাই গৌরবের দিনগুলোকে সাধারণ মানুষ তো ঠিকই আছে। বুকের ভেতর বারুদের মতো ঠেসে রেখেছে। সামান্য প্রেরণায় তা ছুটে বেরিয়ে আসে। সেদিন ওদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এখানে যে রাজাকাররা ছিল ওরা কোথায়? একজন বুড়ো কৃষক, ছোটখাটো, তীক্ষè কণ্ঠে বলল, রাজাকার বদরকার? সব সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে গেছে। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে বলি, বদরকার? অদ্ভুত তো এই বৃদ্ধ একটি নতুন শব্দ তৈরি করেছেন। কী প্রবল ঘৃণায় বদরকার শব্দটি উচ্চরণ করলেন। আমি নিজে তো আলবদরের প্রতিশব্দ বদরকার চিন্তা করতে পারিনি! রাজাকার-বদরকার! কামালপুরের যুদ্ধ করা মানুষের জীবন দিয়ে তৈরি করা শব্দ-একেই তো বলতে হয় নিরক্ষরতার ভেতর শিক্ষিত চৈতন্যের বোধ। আমরা চলে আসার আগে সেই বুড়ো কৃষক আবার এসে আমাদের পাশে দাঁড়ালেন বললেন, আমাদের এলাকার ছেলেয়েমেদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বদরকারদের আচার-আচরণ ওদের কাছে বলি। ওরা এসব মানুষকে চিনতে এবং ঘৃণা করতে শিখেছে। ফেরার পথে আমরা ভাবি, যারা ঘৃণা করার এই নতুন শব্দ তৈরি করেছে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যতটা চিন্তায় লালন করতে পারছে আমাদের শিক্ষিত সমাজ কি সেভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করতে পারছে? যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে ছয় জনের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। গণজাগরণ ঘটেছে তরুণ প্রজন্মের মাঝে। মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনার ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী আদর্শ নিয়ে আমাদের সামনে যেতে হবে বহু দূর। যার মধ্য দিয়ে শেষ হতে পারে এ দেশের মানুষের মুক্তির সংগ্রাম।
×