ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

৪৫ বছরে প্রবৃদ্ধি পাকিস্তানের চেয়ে দ্বিগুণ

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬

৪৫ বছরে প্রবৃদ্ধি পাকিস্তানের চেয়ে দ্বিগুণ

এম শাহজাহান ॥ বিজয়ের পঁয়তাল্লিশ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পাকিস্তানের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। রূপকল্প-’২১ সামনে রেখে ডবল ডিজিট প্রবৃদ্ধির স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। প্রবৃদ্ধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে রফতানি আয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এমনকি জনসংখ্যার অনুপাতে পাকিস্তানের চেয়ে জাতীয় বাজেটেও এগিয়ে বাংলাদেশ। পরাজিত শক্তি পাকিস্তানের চেয়ে সামাজিক খাতেও যথেষ্ট অগ্রগতি বাংলাদেশের। পাকিস্তানে কমলেও বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। এদিকে, অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতির কারণে সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছাড়িয়ে গেছে পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধিকে। কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের ওপর অবস্থান করছে। চলতি বাজেটে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। যদিও চলতি অর্থবছর জিডিপিতে ৭ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে প্রাথমিক ধারণা দিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। অন্যদিকে পাঁচ বছর ধরে পাকিস্তানের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ২ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। স্বাধীনতার আগে পশ্চিম পাকিস্তানীরা বাংলাদেশের কোন ব্যবসায়ীকে মাথা তুলে বাণিজ্য করার সুযোগ দেয়নি। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের সঙ্গে অর্থনৈতিক বৈষম্যও তখন বেড়ে যাচ্ছিল। যার ফলে পিছিয়ে পড়ে সেকালের পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশ। তবে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ দেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশের পথ রচনা করতে সক্ষম হয়েছে। আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ নিয়ে লন্ডনের জাতীয় দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান ইতোমধ্যে বলেছে, আগামী ২০৫০ সালে বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধির বিচারে পশ্চিমা দেশগুলোকেও ছাড়িয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, জেপি মরগান পাঁচটি অগ্রসরমান অর্থনীতির দেশের নাম উল্লেখ করেছে, যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের পূর্বাভাসে বলেছে, ২০৩০ সাল নাগাদ ‘নেক্সট ইলেভেন’ সম্মিলিতভাবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ২৭টি দেশকে ছাড়িয়ে যাবে বাংলাদেশ। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ জানিয়েছেন, মাথাপিছু কম জমি নিয়ে আর কোন দেশ বিশ্বে অর্থনৈতিক উন্নয়নে এমন ইতিহাস করেনি। আমাদের বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে ক্রমাগতভাবে বেশি করে সংযুক্ত হতে হবে। তিনি বলেন, ৪৫ বছরে রফতানি আয়ে বাংলাদেশের অর্জন সত্যিই বিস্ময়কর। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের মাত্র ৩৪ কোটি মার্কিন ডলারের রফতানি আয় গেল অর্থবছরে পৌঁছেছে প্রায় ৩৪ বিলিয়ন ডলারে। রূপকল্প ’২১ সামনে রেখে ইতোমধ্যে ৬০ বিলিয়ন ডলার রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। জানা গেছে, বাংলাদেশ বছরে ৩৪ বিলিয়ন ডলার রফতানি করলেও পাকিস্তান মাত্র ২৮ বিলিয়ন ডলার রফতানি করতে পারছে। চলতি বাজেটে দেশটির প্রবৃদ্ধি হার নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। যদিও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী দেশটি কখনও প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারেনি। রিজার্ভের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে পাকিস্তান। বাংলাদেশের রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেলেও পাকিস্তানের রিজার্ভ মাত্র ২৩ বিলিয়ন ডলার। এদিকে, স্বাধীনতার আগে পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদরা বলেছিলেন, বাংলাদেশের জন্য স্বাধীনতা অর্থনীতির দিক থেকে আত্মঘাতী হবে। তারা এমন একটি ধারণা দিয়েছিলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে সেই অর্থনীতি টিকে থাকতে পারবে না। তার সঙ্গে সঙ্গে আরও দুটি ধারণার সৃষ্টি করা হয়েছিল। বাংলাদেশের পক্ষে দ্রুত বর্ধমান জনসংখ্যা হ্রাস করা সম্ভব হবে না। ফলে জনসংখ্যার চাপে ক্ষুদ্র ভূখ-ে বাংলাদেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। স্বাধীনতার চার দশক পর সেই তথ্যটা বদলে গেছে। এখন পাকিস্তানসহ বিশ্বের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদরাই বলছেন, সত্যিই অর্থনৈতিক সাফল্যে বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেল। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চার দশকে অনেক চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে শূন্য থেকেও অনেক কিছু অর্জন করা যায়। আবার খাদ্য উৎপাদন পাকিস্তান আমলের ৯৬ হাজার টন থেকে বেড়ে ৪ কোটি টনে দাঁড়িয়েছে। ফলে খাদ্য আমদানি ব্যয়ও কমেছে। তাই রফতানি আয়ে পিছিয়ে থাকা পাকিস্তানের আমদানির পরিমাণও বাংলাদেশের চেয়ে বেশি হয়ে গেছে। অন্যান্য সূচকেও অনেক ক্ষেত্রেই পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে মাথাপিছু সঞ্চয়ের হার প্রায় ২৮ শতাংশ, সেখানে পাকিস্তানের মাত্র ১৫ শতাংশ। সঞ্চয় কমে গেলে স্বাভাবিকভাবেই একটি দেশের জাতীয় মূলধন বিনিয়োগও কমে যায়। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭০ বছরে উন্নীত হয়েছে, যেখানে পাকিস্তানে মানুষের গড় আয়ু ৬৫ বছর। পরিকল্পনা কমিশনের সার্ক উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা শীর্ষক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এক বছরের নিচে শিশুমৃত্যু হার রোধেও পাকিস্তানের চেয়ে ভাল অবস্থানে বাংলাদেশ। দেশে প্রতিহাজারে শিশুমৃত্যু হার (এক বছরের নিচে বয়স) ৩৭ জনের। অথচ পাকিস্তানে এ হার ৫৯। স্যানিটেশনেও পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশ অনেক ভাল অবস্থানে। এখন দেশে ৫৬ শতাংশ পরিবার সঠিকভাবে স্যানিটেশন সুবিধা পায়। অথচ পাকিস্তানে এই হার ৪৮ শতাংশ। আর্থ-সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ এখন এক সময়ের শাসক পাকিস্তানের জন্য দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রথম সহসভাপতি আবুল কাশেম আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় থাকায় উন্নয়নমূলক কর্মকা-গুলো দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। পদ্মা সেতুসহ বড় বড় অবকাঠামো দেশে এখন বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ার সঙ্গে অর্থনীতির সব সূচকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতা উত্তরকালে বাঙালী নিজেদের সৃজনশীলতা দেখিয়ে উন্নয়ন করছে, পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে সম্ভাবনা থাকার পরও পাকিস্তান কাজে লাগাতে পারছে না। জঙ্গীবাদের কাছে দেশটি হার মানছে।
×