ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬

 সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

পঞ্চম অধ্যায় পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুবের সাংবিধানিক একনায়কত্ব এবং আমার আমেরিকায় প্রথম ভ্রমণ (গত সোমবারের পর) ঠিক তেমনি গাছপালা বা পশুপাখির পার্কেও তেমন সময় কাটানো গেল না। সমন্বিত বাস, রেললাইন ও পাতাল রেলের ব্যবস্থাটিও নিউইয়র্ককে পরিব্রাজকদের জন্য একটি আনন্দময় মহানগর হিসেবে গড়ে তুলেছে। সর্বোপরি হলো নিউইয়র্কে খাবারের বৈচিত্র্য; দুনিয়ার যে কোন দেশের বা গোষ্ঠীর খাবার সেখানে আছে এবং মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব মিশ্রিত খাবারের ডিশও পাওয়া যায়। সব যোগ দিলে নিউইয়র্কে সেই ১৯৬৩ সাল থেকে শুরু করে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সময়ে আমি সম্ভবত বারো বছর কাটিয়েছি। তবে এক নাগাড়ে থাকা যৎসামান্য। হয়ত ছয় বছর, তবে আমার স্ত্রী সেখানে থাকেন সম্ভবত ৮/৯ বছর। নিউইয়র্কে বর্তমানে অনেক মসজিদ আছে। তবে ষাটের দশকে একমাত্র ওয়াশিংটনেই একটি মসজিদ ছিল এবং নিউইয়র্কে ঈদের জামাত হতো রুজভেল্ট হোটেলে। ১৯৬৩-৬৪ সালে আমি এক ঈদের নামাজ পড়ি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ক্লাস কক্ষে আর অন্যটি পড়ি রুজভেল্ট হোটেলে। ১৯৬৪ সালে হারভার্ড থেকে গচঅ ডিগ্রী পেলাম কিন্তু কনভোকেশনে থাকা হলো না। আমাদের নির্ধারিত প্রত্যাবর্তন পথে আমাদের কিছু প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল। আমরা প্রথমে গেলাম ওটাওয়া ও টরোন্টতে। ওটাওয়ার ভাষা মূলত ফরাসী কিন্তু টরোন্টর ভাষা ইংরেজী। কানাডার বিস্তৃত এলাকা শুধু বরফেই ঢাকা থাকে, জনবসতি যৎসামান্য। ওটাওয়াতে দেখলাম আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার জন্য প্রস্তুতি। নদীর বুকে আর সাগরের পাড়ে চলছে দারুণ নির্মাণ যজ্ঞ। কানাডার যে কটি নগরে জনবসতি আছে সেগুলো ভারি সুন্দর। এক সময়ে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় ভাবতাম যে কানাডায় পাড়ি দেব। ওটাওয়ার সুপ্রীমকোর্ট এবং সংসদ ভবনটিকে মনে হলো মনোরম। ২০১৩ সালের হিসাব মতো কানাডার জনসংখ্যা মাত্র ৩৩ মিলিয়ন অথচ এলাকায় হলো পৃথিবীর দ্বিতীয় দেশ (৩.৮ মিলিয়ন বর্গমাইল)। মাত্র ছয়টি মহানগরেই অর্ধেকের বেশি জনগণের বসতি। টরোন্টতে মোট ৫.৫ মিলিয়ন, মন্টিয়লে ৩.৮ মিলিয়ন, ভানকুভারে ২.৩ মিলিয়ন আর ওটাওয়া, কেলগেরি এবং এডমন্টনে ১.২ মিলিয়ন করে। মন্টিয়লে যাবার খুব ইচ্ছা ছিল কারণ পড়েছিলাম যে মহানগরটি ভারি সুন্দর। অবশেষে সেখানে যাই এই শতাব্দীর শুরুতে। টরোন্ট একটি দেশই বটে, এত লোক আর এত ফল ফসল। টরোন্ট মহানগরের সিংহভাগ হলো একটি হ্রদের দ্বীপ যাকে বলে সিত্তি। ওটাওয়া বা মন্টিয়ল বেশ ছিমছাম শহর কিন্তু টরোন্ট ব্যস্ত। সর্বত্র প্রচ- ভিড় এবং জীবনের দৌড় বড় দ্রুত। আমি যখন উত্তর আমেরিকায় তখন দেশে একটি কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটে। সহসা ১৯৬৪ সালে জানুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জ মিল এলাকায় একটি দাঙ্গা বাধে এবং দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার হুমকি আসে। বঙ্গবন্ধু তখন লন্ডনে গিয়েছিলেন দলীয় কাজে, দাঙ্গার খবর পেয়েই তিনি ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করে দাঙ্গা রোধে ব্রত হলেন। তাকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে ছিলেন সংবাদ জগতের নেতাকর্মীরা। প্রায় যাদুর চেরাগের প্রভাবে দাঙ্গা প্রশমিত হলো এবং দেশে শান্তি পুনর্প্রতিষ্ঠা পেল। সেই সময়ে দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি একটি ইশতেহার প্রচার করে; সেটি ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। প্রচারপত্রের শিরোনাম ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাড়াও।’ বঙ্গবন্ধু তার অব্যবহিত পরে ২৫ জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ দলকে পুনরুজ্জীবিত করলেন এবং জুলাই মাসে গড়ে তুললেন কপ (ঈড়সনরহবফ ঙঢ়ঢ়ড়ংরঃরড়হ চধৎঃু) বা সম্মিলিত বিরোধী দল। এই বছরেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হলো। স্মরণীয় বিষয় হলো ২৯ ডিসেম্বরে পাকিস্তানে সর্বপ্রথম টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু হলো। এই সম্প্রচার পর্ব শুরু হয় প্রথমেই ঢাকায়। পাকিস্তান নতুন কিছুর সূচনা সব সময় হয় পশ্চিম পাকিস্তানে এই একটি ক্ষেত্রেই দেশের প্রথম টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু হয় পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকায়। এই অধ্যায়ে আমি মোটামুটিভাবে ১৯৬২ এবং ১৯৬৩ সালের কাহিনী এবং ঘটনাবলী বিবৃত করেছি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ১৯৬২ সালে ওইসিডি (ঙঊঈউ) তুরস্কের ঋণ সমস্যা সমাধানের একটি ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে। এই ক্লাব ক্রমে ক্রমে নিয়মিতভাবে তুরস্ক অথবা গ্রীসের ঋণ সমস্যা নিয়ে দরবার করতে প্রায়ই বসতে থাকে। প্রথমে এটাকে লন্ডন ক্লাব বলা হতো। কিন্তু পরবর্তীকালে প্যারিস ক্লাব নামে বিখ্যাত হয়। অর্থাৎ প্রথমে যেসব ঋণ সমস্যা আলোচিত হতো সেখানে ব্রিটেনের বিষয়টি প্রধান ছিল। পরবর্তীকালে বিশেষ করে উত্তর আফ্রিকার ফরাসী উপনিবেশগুলোর সমস্যা প্রকট হতে থাকায় এইসব ক্লাবের অধিবেশন প্যারিসেই সচরাচর হতো। এই বছরের প্রথম দিকে ২০ ফেব্রুয়ারিতে জন গ্লেন জুনিওর (অংঃৎড়হধঁঃ ঔড়যহ এষবহহ ঔঁহরড়ৎ) মহাকাশে ভ্রমণকারী প্রথম মার্কিন ব্যক্তির সম্মান পান। তিনি পরবর্তীকালে আমেরিকায় একজন সিনেটর হন। ১৯৬৩ সালেই রাশিয়ার ভ্যালেন্টিনা তেরেস্কভা হলেন মহাকাশ ভ্রমণকারী প্রথম নারী। চলবে...
×