ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ইসলামে স্বাধীনতার গুরুত্ব

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ইসলামে স্বাধীনতার গুরুত্ব

স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, প্রতিটি মানব সন্তান জন্মগ্রহণ করে ফিতরতের ওপর। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : আল্লাহর প্রকৃতির অনুসরণ কর, যে প্রকৃতি (ফিতরত) অনুযায়ী তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। (সূরা রূম : আয়াত ৩০)। এই প্রকৃতি বা ফিতরতের মধ্যেই স্বাধীনতার মর্ম নিহিত রয়েছে। ইসলামে যে স্বাধীনতার গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে সেটা স্ব-অধীনতা অর্থে ব্যবহৃত হলেও তা স্বেচ্ছাচারিতা কিংবা স্বৈরতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করে দেয় এবং সে স্বাধীনতা ব্যক্তির স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে সমষ্টির স্বাধীনতা সুসংহত করে। পৃথিবীতে যুগে যুগে এক লাখ চব্বিশ হাজার মতান্তরে দুই লাখ চব্বিশ হাজার নবী-রসূল এসেছেন সত্য-সুন্দর পথের দিকে আহ্বান করার জন্য। তারা মানুষকে সৎপথের দিশা দিয়েছেন, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ্্ নেই- তওহীদের এই বাণী প্রচার করেছেন, আল্লাহর রবুবিয়ত প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন, দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের কথা বলেছেন, জীবনের পরতে পরতে মানুষ যাতে মনুষ্যত্বকে আত্মস্থ করতে পারে সে জন্য সঠিক পথ প্রদর্শন করেছেন, মানবিক মূল্যবোধ কোথায় কোথায় নিহিত রয়েছে তার বিবরণ তুলে ধরেছেন, বিশ্বজগতের স্রষ্টা আল্লাহ রব্বুল ‘আলামীনের প্রতি সামগ্রিকভাবে অনুগত থাকবার কথা বলেছেন, মানুষের প্রতি মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ জাগ্রত করছেন। আল্লাহ জাল্লা শানুহু মানুষের মর্যাদা সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন : ওয়া লাকাদ কাররামনা বানী আদাম- আমি তো আদম-সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি। (সূরা বনী ইসরাঈল : আয়াত ৭০)। আমরা ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই, সর্বশেষ নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামের পৃথিবীতে আগমনের প্রাক্কালের যে যুগটা চলছিল তাকে বলা হতো আইয়ামে জাহিলিয়াত বা অন্ধকার আর অজ্ঞতার যুগ। তখন মানবতা জিম্মি হয়ে গিয়েছিল গুটিকয়েক সমাজপতির হাতে। হানাহানি, কাটাকাটি, খুনোখুনী লেগেই থাকত কোন ব্যক্তি বা কোন গোষ্ঠীর আভিজাত্য ও প্রাধান্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য, যে কারণে বৃহৎ জনগোষ্ঠী বা সাধারণ জনগণ পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। মানুষ যে আল্লাহর সেরা সৃষ্টি-আশরাফুল মখ্্লুকাত- এই সত্যটির স্বীকৃতি ছিল না। স্বাধীনতা নামক প্রতিবেশের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। ইসলাম ঘোষণা করল সব মানুষের সমঅধিকারের কথা, প্রত্যেকের স্বাধীনতার কথা। পরাধীনতা ও দাসত্বের কবল থেকে ইসলাম মানবতাকে উদ্ধার করল। এর জন্য প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সঙ্গী-সাথীগণকে অকথ্য জুলুম-নির্যাতনের মোকাবেলা করতে হয়েছে, এমনকি প্রিয় জন্মভূমি মক্কা মুকাররমা থেকে হিজরত করে মক্কা থেকে ২৯৬ মাইল উত্তরে মদিনা মনওয়ারায় চলে যেতে হয়েছে। মক্কা ত্যাগকালে তিনি কাবা শরীফের দিকে তাকিয়ে মক্কা নগরীকে সম্বোধন করে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন; হে আমার জন্মভূমি মক্কা, আল্লাহর এই বিশাল পৃথিবীতে তুমিই আমার কাছে সবচেয়ে পবিত্র এবং প্রিয়। কিন্তু তোমার সন্তানেরা আমাকে তোমার কোলে থাকতে দিল না, তাই আমি তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি। কাঁদতে কাঁদতে বার বার তিনি চোখের পানি মুছছিলেন। এমন সময় আল্লাহর ওহী নাযিল হলো : (হে রসূল) বলুন : হে আমার রব, আমাকে প্রবেশ করান কল্যাণের সঙ্গে, আমাকে বের করান কল্যাণের সঙ্গে এবং আপনার নিকট হতে আমাকে দান করুন সাহায্যকারী শক্তি। (সুরা বনী ইসরাঈল : আয়াত ৮০)। প্রিয়নবী (সা) ১৫ দিন লোকচক্ষু এড়িয়ে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুকে সঙ্গে করে মদিনার উপকণ্ঠ কুবা নামক স্থানে উপস্থিত হলে প্রায় পাঁচ হাজার নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোরীর এক বিশাল জনতা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে তালাআল বাদরু আলায়না/মিন ছানিয়াতিল বিদাঈ/ওয়াজাবাশ শুকরু আলায়না/মাদাআ লিল্লাহি দা’ঈ- সুললিত সমবেত উচ্চারণে খোশ আমদেদ জানান। মূলত তদানীন্তন ইয়াসরীব যা প্রিয়নবী (সা)-এর আগমনের ফলে মদিনাতুন নবী বা মদিনা মনওয়ারা নামে পরিচিত হয় তা একটা দীর্ঘকালীন নৈরাজ্যজনক অবস্থা থেকে মুক্তি পেল। মদিনার মানুষ মদিনার দুই শক্তিশালী গোত্র বনু আউস এবং বনু খায়রাযের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে যে যুদ্ধ চলে আসছিল সেই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে অন্য গোত্রগুলোও এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল, যে কারণে এই যুদ্ধ ব্যাপক আকার ধারণ করার কারণে মদিনাবাসীর কয়েক নেতা মক্কা মুকাররমায় হজের মৌসুমে গিয়ে গোপনে আকাবা নামক স্থানে প্রিয়নবী (সা)-এর কাছে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মদিনায় যাবার জন্য তাকে দাওয়াত দেন। মদিনার বিবদমান বনু খায়রায ও বনু আউসের উভয় গোত্রের বিদগ্ধজনরা চাইছিলেন তাদের নগরীতে এমন এক মহান ব্যক্তির আগমন ঘটুক যিনি তাদের অঞ্চলে এসে সব দ্বন্দ্ব-কলহ ও অশান্তির অবসান ঘটাবেন। তারা প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের মধ্যে তাদের সেই কাক্সিক্ষত মহামানবের নিদর্শন দেখতে পেয়েছিলেন। প্রিয়নবী (সা) আল্লাহর নির্দেশ পেয়ে সেখানে হিজরত করেন। মদিনা মনওয়ারায় এসে এখানে তিনি একটি মসজিদ স্থাপন করেন যা মসজিদুন নববী নামে মশহুর হয় এবং এই মসজিদকেন্দ্রিক এক স্বাধীন নগররাষ্ট্রের পত্তন করেন যা কয়েক বছরের মধ্যে এক অনন্য কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে বিস্তৃত হয় ইয়ামন থেকে দামেস্ক পর্যন্ত। পরবর্তী এক শ’ বছরের মধ্যে তা দিল্লী থেকে গ্রানাডা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। প্রিয়নবী (সা) যে আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন তা পরিচালনার জন্য মদিনার ইয়াহুদীসহ অন্যান্য সম্প্রদায় ও গোত্রের নেতৃবৃন্দের সম্মতি নিয়ে তিনি একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করলেন- যাতে সবাই স্বাক্ষর করল। এটাই পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র। মদিনার সনদ বা চার্টার অব মদিনা নামে পরিচিত এই সনদকে বিশ্বমানব ইতিহাসে প্রথম লিখিত চার্টার অব লিবার্টি বা স্বাধীনতা সনদও বলা হয়। সকল মতাবলম্বীকে এই সনদে চিন্তার স্বাধীনতা, ধর্মের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা দেয়া হয়। এই সনদের মাধ্যমে একটি রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই সনদে বলা হয় : আল্লাহ প্রদত্ত নিরাপত্তা (যিম্মা) একক। প্রতিবেশীকে নিরাপত্তা (ইউজীর) প্রদান করা। সবার জন্য অবশ্য কর্তব্য।... ইয়াহুদীদের যে কেউ যতদিন কোনরূপ ক্ষতিসাধন অথবা শত্রুদের সাহায্য প্রদান করবে না ততদিন পর্যন্ত অব্যাহতভাবে সাহায্য ও সমর্থন পেতে থাকবে। এ সনদভুক্ত কেউ দুষ্কৃতকারীকে কোনরূপ সাহায্য করতে পারবে না কিংবা আশ্রয় দিতে পারবে না। যদি কেউ দুষ্কৃতকারীকে সাহায্য করে কিংবা আশ্রয় দান করে, তবে তার জন্য রয়েছে আল্লাহর গজব এবং রোজ হাশরে সে আল্লাহর আজাবে নিপতিত হবে। কোন প্রকার ক্ষতিপূরণ দ্বারা ওই অপরাধ খ-িত হবে না।... ইয়াহুদীদের জন্য তাদের ধর্ম, মুসলিমদের জন্য তাদের ধর্ম (দীন)।... ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবাই একই গোষ্ঠীভুক্ত বলে গণ্য হবে। কারও মধ্যে কোন মতানৈক্য হলে আল্লাহ এবং তার রসূল মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম সমীপে তা পেশ করতে হবে।... এই সনদের আওতাভুক্ত কোন ব্যক্তি বা গোত্র পরস্পরের বিরুদ্ধে নাশকতামূলক বা বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজে লিপ্ত হতে পারবে না, এই জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত কেউ হযরত মুহম্মদ (সা)-এর বিনা অনুমতিতে কোন যুদ্ধাভিযানে যেতে পারবে না।... এই সনদের আওতাভুক্ত সবার নিকট ইয়াসরিব (মদিনা) উপত্যকা অত্যন্ত পবিত্র স্থান।... এই সনদের অন্তর্ভুক্ত লোকদের মধ্যে যেসব বিবাদ-বিসংবাদ অথবা ঝগড়া-ফ্যাসাদ সাধারণভাবে মীমাংসা করা সম্ভব হবে না, তার মীমাংসার ভার আল্লাহ ও তার রসূল হযরত মুহম্মদ (সা)-এর ওপর ন্যস্ত করতে হবে।...কুরায়শ ও তাদের সাহায্যকারীকে আশ্রয় (তুজার) দেয়া যাবে না। ইয়াসরিব সহসা আক্রান্ত হলে এই সনদের আওতাভুক্ত সবাই শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হবে। মদিনার সনদে আরও বলা হয় : ইয়াসরিব শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে সনদভুক্ত সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে অর্থ ও শক্তি দিয়ে তা প্রতিহত করতে বাধ্য থাকবে। ৪৭ শর্তবিশিষ্ট এই সনদের আওতাভুক্ত ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে প্রিয়নবী (সা)-কে রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান, শাসনকর্তা, প্রধান বিচারক, সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে গ্রহণ করে। এই স্বাধীনতা সনদে শান্তির পরিপন্থী কার্যকলাপকে দ-নীয় অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই সনদে স্বাধীনতার প্রকৃত স্বরূপ বিভাসিত হয়ে উঠেছে এবং মানুষে মানুষে বিভাজনের বিরুদ্ধে এবং অন্যায়, অরাজকতা, সন্ত্রাস, বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে দেশে অশান্তি সৃষ্টি করার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াবার নির্দেশনা উদ্দীপ্ত হয়েছে। ইসলাম ব্যক্তির মত প্রকাশের স্বাধীনতাও দিয়েছে। ইসলামের ইতিহাসে এর ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত রয়েছে। লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরিফ উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা) সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×