ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আকিল জামান ইনু

মোস্তফা মনোয়ার ॥ বেস্ট পারফরমার ইন এশিয়া

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬

মোস্তফা মনোয়ার ॥ বেস্ট পারফরমার ইন এশিয়া

গত ৪ ডিসেম্বর শেষ হয়েছে সিঙ্গাপুর ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। উৎসবে ‘সিলভার স্ক্রিন এ্যাওয়ার্ডে’র জন্য মূল প্রতিযোগিতায় মনোনীত হয় তরুণ পরিচালক আবদুল্লাহ মোঃ সাদের সাদাকালোয় নির্মিত ছবি ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা। সেরা ছবি, সেরা পরিচালক আর বেস্ট পারফর্মেন্স ক্যাটাগরিতে তালিকায় আসে ছবিটি। শেষ পর্যন্ত বিজয় ছিনিয়ে নেয় সেরা পরিচালক ও বেস্ট পারফরমার ক্যাটাগরিতে, আবদুল্লাহ মোঃ সাদ ও মোস্তফা মনোয়ার। আমাদের অভিনন্দন। আর বেস্ট পারফর্মেন্স এ্যাওয়ার্ড জয়ী মনোয়ারকে বিশেষ ধন্যবাদ, এজন্য যে গত অক্টোবরে জনকণ্ঠের সঙ্গে সাক্ষাতকার শেষে তিনি কথা দিয়েছিলেন বেস্ট পারফরমার নির্বাচিত হলে প্রথম কথা বলবেন জনকণ্ঠের সঙ্গে। কথা রাখায় ধন্যবাদ। মোস্তফা মনোয়ার। জন্ম ঢাকার সেন্ট্রাল রোডে। শৈশব কেটেছে লিবিয়া, রাজশাহী হয়ে এই ঢাকাতেই। কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ভর্তি হন কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। অভিনয় ভালবেসে জড়িয়ে পড়েন বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্রামা ক্লাবে। আর সেখান থেকেই মূল্য দেয়া শুরু ভালবাসার। কম্পিউটার সায়েন্সে পড়াশোনার চাপে অভিনয়ে সময় দিতে পারছিলেন না। তাই বিভাগ পরিবর্তন করে বিবিএ। অভিনয় প্রেম তার কাছ থেকে মূল্য আদায় করেছে পরবর্তীতেও। পড়াশোনা চলাকালীন যোগ দেন বিজ্ঞাপনী সংস্থা ‘এডকমে’। আবারও সেই অভিনয়ে সময়ের সঙ্কট কাজের চাপে। ছেড়ে দেন নিশ্চিত চাকরি অভিনয় করবেন বলে। তার সে সময়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন এভাবে। তখন মাথায় অভিনয়ের পোকা। স্বপ্ন দেখা বেঁচে থাকা অভিনয়কে ঘিরে। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে দেখেন কোথাও মিলছে না প্রত্যাশার সঙ্গে। কোথাও আটকে যাচ্ছে তার ভাবনা। তখন থেকেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ কাজ যদি করতেই হয় তো নিজের পছন্দ হলে তবেই তা করবেন। এদিকে উদরে উনুন জ্বলে। অতঃপর আবারও চাকরি এবার বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিকে ২০০৭ এ। এখনও সেখানেই আছে গ্রুপ ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর পদে। তারপর থেকে চাকরির পাশাপাশি অভিনয় করেছেন। তবে প্রথম বড় ব্রেকটি এলো সাদের ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’তে, কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় এবং প্রথমবারেই বাজিমাত। এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ ও মর্যাদাবাহী সিঙ্গাপুর ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এশিয়া সেরা সব অভিনেতাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ তিনি। ছবির সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া ও অভিনয়ের জন্য তার প্রস্তুতির গল্প আমরা আগেই বলেছি। এবারে জানতে চাইলাম উৎসবের গল্প। ২৭তম সিঙ্গাপুর ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তার সবচেয়ে ভাল অভিজ্ঞতা ব্যান্ডিট কুইন খ্যাত সীমা বিশ্বাসের সঙ্গে পরিচয়। অবাক হয়েছেন তার বাংলা শুনে। এছাড়া প্রতিদিনই আড্ডা হয়েছে এশিয়া সেরা পরিচালকদের সঙ্গে। এই মতবিনিময় তাকে সমৃদ্ধ করেছে বলেই তার ধারণা। সেরা ছবি নির্বাচিত হয়েছে ‘ইয়েলো সান’। নিজেদের ছবি নিয়ে বললেন মজার ঘটনা। দেশে বসে তার আস্থা ছিল ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’ সেরা ছবি হবে আর সাদ ভাবতেন বিপরীত, কিন্তু ফেস্টিভ্যালে সব ছবি দেখে তার মনে হয় তারা জিতবেন না আর সাদ বিশ্বাস করা শুরু করেন তার ছবি পুরস্কার পাবে! এশিয়ার অন্য ছবির সঙ্গে তুলনায় আমাদের চলচ্চিত্রের অবস্থান কোথায়? মনোয়ার দৃঢ়স্বরে বলেন, আমাদের পক্ষে সম্ভব তাদের টপকে যাওয়া। এমনকি প্রযুক্তির অভাবও অতিক্রম করা সম্ভব। তার ধারণা আমাদের সঙ্কটের জায়গাটা আসলে চিন্তা, আন্তরিকতা আর ঝুঁকি নেয়ার অনীহা। ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নাটককে টেনে আনলেন। তার মতে একটু লক্ষ্য করলে দেখবেন আমাদের অনেক নাটকের গল্প নিয়েই চমৎকার ছবি হতে পারে। আর কিছু পরিচালক সেখানে কাজ করেন অনেক দরদ নিয়ে; সহজেই নতুন ভাবনা প্রয়োগ করেন। কিন্তু চলচ্চিত্রের বেলায় অবস্থাটা বিপরীত। তার ভাষায় এখানে সবাই সনাতন ধারায় আটকে আছেন। নিজের প্রয়োগ করা সীমাবদ্ধতাই বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় সঙ্কট বলে তার ধারণা। এক কথায় এখানে সবাই ‘সেফ’ খেলতে চায়। খুব মজার কথা বলেন মনোয়ার; ‘ভাবতে তো টাকা পয়সা লাগে না!’ আমাদের চলচ্চিত্র ভাবনার জায়গাটা সবচেয়ে দুর্বল। মোস্তফা মনোয়ার প্রচলিত ধারার নায়ক নন। নিজেকে অভিনেতা ভাবেন। ফরমাল নন মোটেও। পুরস্কারপ্রাপ্তির পর তার অনুভূতি জানাতে গিয়ে বলেন, ‘আমার মাথায় তখন একটাই ভাবনা এসেছে। অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে দেশে থাকতেই জানানো হয়েছিল ফরমাল পোশাক নিয়ে যেতে হবে। সব জোগাড় হওয়ার পরে দেখি জুতো নেই। আমি বাবার বাসায় গিয়ে তার কাছে জুতো চাই। চাওয়াতে তিনি বলেন, একটু বস। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে বেডরুমে গিয়ে দেখি বাবা নিজেই ব্রাশ দিয়ে জুতো কালি করছেন। আমাকে দেবেন বলে। দশ মিনিট ধরে আমার চোখের সামনে বাবার জুতো ব্রাশ করার দৃশ্যটি ভেসেছে! আর আমার পুরো টিমের কথা। তারপর ঢেউয়ের মতো এসেছে অভিনয়ের জন্য করা সংগ্রামের দিনগুলোর কথা। বাংলায় তার প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ আর আল মাহমুদ। মনোয়ারের লেখাপড়ার বৃত্তটি অনেক বড় স্বীকার করতেই হয়। বাংলার তরুণতম লেখক থেকে শুরু করে প্রাচীন সাহিত্য নিয়ে রাখেন পরিষ্কার ধারণা। আর বিশ্বসাহিত্যে প্রিয় নাম বলতে গিয়ে দিশা হারিয়ে ফেলেন: প্রিয় তালিকায় আছেন, বোরেস, মার্কেজ, রুশদী, মুরাকামী, কোয়েক্স, বেনত্রি, ওরহাম পামুক। মনোয়ার বিশ্বাস করেন বাংলা ছবি অবশ্যই বিশ্ব দরবারে ঠাঁই করে নেবে। নিজে ছবি নির্মাণের কথা ভাবছেন। ২০১৮তে শুরু করতে চান তার স্বপ্নের ছবি। ৩৮ বছর বয়স্ক, ব্যাচেলর, প্রচারবিমুখ এই অভিনেতা সাক্ষাতকার শেষে নার্ভাস কণ্ঠে বলেন, ‘ভাইয়া হইছে কিছু?’ হ্যাঁ মনোয়ার আপনি যা অর্জন করেছেন আপাতত যথেষ্ট হয়েছে। তবে প্রত্যাশা বেড়ে গেছে।
×