ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ধ্রুব হাসান

ব্যান্ডসঙ্গীতে মুক্তিযুদ্ধ

প্রকাশিত: ০৩:৫৮, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬

ব্যান্ডসঙ্গীতে মুক্তিযুদ্ধ

‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে এই জনতা’ কিংবা ‘আমাদের সংগ্রাম চলবেই চলবে জনতার সংগ্রাম চলবে।’ সেই জাগরণের গান গাইতে গাইতে আযম খান যোগ দেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। একদিকে রাইফেল হাতে শত্রুর মুখোমুখি অন্যদিকে ক্যাম্পে ক্যাম্পে গণসঙ্গীত গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেন। তারপর স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে পাশ্চাত্য সুরের সঙ্গে দেশজ সুরের মেলবন্ধন ঘটিয়ে এই জনপদে সঙ্গীতের নতুন এক ধারার সূচনা করেন। যার শিরোনাম হয় পপ সঙ্গীত। এই পপ সঙ্গীত আমাদের মুক্তি যুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা রাখে। পপ সঙ্গীতের সমকালীন আধুনিকতা, আজম খানের ব্যতিক্রম পরিবেশনা সবাইকে মুগ্ধ করে। বিশেষ করে তরুণ শ্রেণী তার গানকে লুফে নেয়। মুখে মুখে ফিরতে থাকে আজম খানের গান। আর আজম খানকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। যেমন তারই হাত ধরে এই দেশে পপ সঙ্গীতের আবির্ভাব ঘটে, তেমনই তারই পথ ধরে এ দেশে প্রবর্তন হয় ব্যান্ড সঙ্গীতের। সঙ্গত কারণেই ব্যান্ড শিল্পীরা আজও তাকে পপ গুরু বলে জ্ঞান করেন। কেড়ে নিয়েছে ওই হায়েনার দল, ধর্ষিত মায়ের চোখের জলৃৃ’ আহ! কি অদ্ভুত, কি সুপার্ব স্টার্টিং! আশির দশকের অন্যতম জনপ্রিয় গান ‘রাজাকারের তালিকা চাই’; গেয়েছেন তৎকালীন জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘নোভা’-র দলনেতা আহমেদ ফজল। বাংলা ব্যান্ডের ইতিহাসে এটিই সর্বপ্রথম একটি গান যেখানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি প্রকাশ্যে আহ্বান করা হয়েছে। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে গানটি গাওয়া কিন্তু এত সহজ ব্যাপার ছিল না; অনেক সাহসী হলে তবেই এরকম একটা গান গাওয়া সম্ভব। ফজল সেই সাহস দেখিয়েছিল, যদিও এতে রাজাকারদের চুল বিন্দুমাত্র বাঁকা হয়নি সে সময়! রাজাকারদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা আমরা আজও পাইনি, কখনও যে পাব সে সম্ভাবনাও শূন্য। বাস্তবতা হচ্ছে, রাজনৈতিক পরিক্রমায় অনেক রাজাকারই আজকে পরিণত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধায়! সেই বাইশ-তেইশ বছর আগে একজন আহমেদ ফজল যে দাবি জানিয়েছিল তার সঙ্গে শাসকগোষ্ঠী এবং শিক্ষিত জনগণ যদি একাত্মতা ঘোষণা করত, হয়ত আমরা একটা পূর্ণাঙ্গ তালিকা পেলেও পেতে পারতাম! এ ধরনের একটা গানের শক্তি অপরিসীম, কিন্তু সে সময় সেই শক্তির সঠিক প্রয়োগে আমরা নিঃসন্দেহে ব্যর্থ হয়েছি। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আজম খান যে শুধু গান নিয়ে হাজির হয়েছিলেন সেটা বললে নিহায়ত কম বলা হবে। তিনি মূলত বেশ কিছু প্রশ্নের জবাবও দিয়েছিলেন সে সময়ে। বিশেষ করে বাংলা গানের রবীন্দ্রায়ন যে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়ে গানের জগতকে শাসন করছিল এবং সেইসঙ্গে শিল্পের পবিত্রতা বলে যেসব টেক্সট রবীন্দ্রবাদীরা হাজির করছিল সেসব প্রশ্নের উত্তরও তিনি হয়ত দিতে চেয়েছিলেন। যথারীতি আজম খানের পাশ্চাত্য ভাবধারার গানও তাদের মনে চাবুকের মতো করে আঘাত ‘হেনেছিল’। এখনকার ঢাকা ব্যান্ডের ভোকাল মাকসুদের ‘আমি বাংলাদেশের দালাল বলছি’ বইটিতে উঠে এসেছে এক যোদ্ধার লড়াইয়ের দলিল। ১৯৭৩-৭৪ সালে ফেরদৌস ওয়াহিদের গানের পাশাপাশি আজম খানের ‘রেলাইনের ঐ বস্তিতে’, ‘ওরে সালেকা ওরে মালেকা’, ‘আলাল ও দুলাল’; ফিরোজ সাঁইর ‘ইশকুল খুইলাছে রে মওলা’ এবং ফকির আলমগীরের ‘ও সখিনা’ গানগুলো সারা বাংলায় আলোড়ন তোলে। পরবর্তীকালে এ চার শিল্পীর সঙ্গে পিলু মমতাজ যোগ দেন এবং পাঁচপীর নাম নিয়ে উচ্চারণ ব্যান্ডের সঙ্গে তারা পারফর্ম করতে থাকেন। এরপরে আগমন ঘটে পপ রক ব্যান্ডগুলোর। সোলস [১৯৭৩], ফিডব্যাক টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি [১৯৭৬], বালার্ক [১৯৭৬], এ্যাবনরমাল থ্রি প্লাস [১৯৭৬], মাইলস [১৯৭৯]-এর মতো ব্যান্ডগুলো বাংলা গানে পাশ্চাত্যের ছোঁয়া নতুন রূপরেখা তৈরি করে। তারা প্রত্যেকেই তাদের এ্যালবামসমূহে মুক্তিযুদ্ধের গান যুক্ত করেছেন। বর্তমান সময়ে অবসকিওর যাদের যাত্রা সেই ১৯৮৫ সালের ১৫ মার্চ খুলনায় তাদের কথা হলো মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য এভাবেই হাসিমুখে প্রাণ বিলিয়ে দেন অগণিত বীর বাঙালী। যাদের সবার নাম আমাদের জানা নেই। তাই তার ঠিক করলেন তাদের প্রতিটি এ্যালবামে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ নিয়ে গান করবেন। সেই ধারাবাহিকতায় তাদের সর্বশেষ নিবেদন ‘ক্র্যাক প্লাটুন’। সম্প্রতি সাউন্ডটেক থেকে প্রকাশিত ‘ক্র্যাক প্লাটুন’ এ্যালবামে অবসকিউর আরও একবার মুক্তিযুদ্ধের দৃশ্যপট তুলে ধরেছে। সাত বীর শহীদ স্মরণে তৈরি করেছে এ্যালবামের শীর্ষ সঙ্গীত। এছাড়া সাহসী ভূমিকা রেখেছে মৌলবাদের বিরুদ্ধে গান করে। এর আগের এ্যালবামের ‘দেশ ছাড় রাজাকার’ গান নিয়েও অজ্ঞাত পরিচয়ের কয়েকজন মৃত্যুর ভয় দেখিয়েছে। তাই বলে তারা নীরব থাকেননি। তাদের কথা হলো কাউকে না কাউকে তো আওয়াজ তুলতেই হবে। অনেকের পক্ষে হয়ে অবসকিউর তাই সেই আওয়াজ তুলেছে। অবসকিওর মৌলবাদ ও রাজাকারের বিরুদ্ধে যেমন আওয়াজ তুলেছে, তেমনি দেশে ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গান করে শ্রোতাদের চেতনা জাগানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।
×