ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

একাত্তরের চলচ্চিত্র

প্রকাশিত: ০৩:৫৮, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬

একাত্তরের চলচ্চিত্র

১৯৭১ থেকে ২০১৬ স্বাধীনতা লাভের এই ৪৫ বছরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে পরিমাণ গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক বা শিল্পকর্ম সৃষ্টি হয়েছে, সে তুলনায় চলচ্চিত্রের সংখ্যা বলতে গেলে হাতেগোনা। স্বাধীনতা পরবর্তী এই সময়ে স্বল্পদৈর্ঘ্য এবং প্রামাণ্যচিত্রসহ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র মিলিয়ে ১০০টির বেশি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়নি। ৭১-এর ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার মুজিবনগরে শপথ নেয়। স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ওরা এগারোজন’ নির্মাণ করেন পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম। এটি কেবল প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রই ছিল না, স্বাধীন দেশে নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্রই ছিল ‘ওরা এগারোজন’। ছবির অধিকাংশ কলাকুশলীই ছিলেন সদ্য মুক্তিযুদ্ধ ফেরত বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে গঠিত গেরিলা দলের পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান এ ছবিতে তুলে ধরা হয়। এই এগারোজনের দশজনই বাস্তবের মুক্তিযোদ্ধা; যারা পেশাদার শিল্পী ছিলেন না। ছবিটির শুরুতেই পর পর ছয়টি কামানের গোলার শব্দ শোনা যায়। এ ছয়টি শব্দ হচ্ছে ছয়দফা দাবির প্রতীকী শব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। এই চলচ্চিত্রে যে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ব্যবহার হয়েছিল সবই ছিল সত্যিকারের। ১১ আগস্ট ১৯৭২ এ মুক্তি পায় এই চলচ্চিত্রটি। ১৯৭২, ১৯৭৩ এবং ১৯৭৪ সালে মোট দশটি মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র তৈরি হয়। সত্যিকার অর্থে মুক্তিযুদ্ধ নিয়েই বিকশিত বাংলাদেশের চলচ্চিত্র। ১৯৭২ সালের ৮ নবেম্বর মুক্তি পায় সুভাষ দত্তের পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’। কুসুমপুর গ্রামে পাকিস্তানী বাহিনীর নির্মম হত্যাকা-, নির্যাতন, নারী ধর্ষণ এবং প্রতিবাদে বাঙালীদের মুক্তি সংগ্রামকে কেন্দ্র করে এই চলচ্চিত্র নির্মিত। যুদ্ধ শিশুর মতো বিষয় বেশ গুরুত্বের সঙ্গে ফুটে উঠেছে এই চলচ্চিত্রে। ১৯৭৩ সালের তিনটি ছবি আলমগীর কবিরের ‘ধীরে বহে মেঘনা’ খান আতাউর রহমানের ‘আবার তোরা মানুষ হ’ এবং আলমগীর কুমকুমের ‘আমার জন্মভূমি’ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সফল চলচ্চিত্র। যুদ্ধোত্তর একটি সমস্যাকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দ্বিতীয় ছবি ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’র নায়ক একজন মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধে তিনি মারা যান। দ্বিতীয় নায়ক একজন চলচ্চিত্র অভিনেতা। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি সীমান্ত অতিক্রম করেন। যুদ্ধের আগে এক গ্রামে শূটিং করতে গিয়ে নায়িকার সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। যুদ্ধের পরে ফিরে এসে দ্বিতীয় নায়ক জানতে পারে, নায়িকা যুদ্ধের সময় ধর্ষিত হয়েছে এবং বর্তমানে পিতৃপরিচয়হীন এক সন্তানের জননী। শুধু নায়িকাই নয়, তার মতো আরও অনেক তরুণীর ভাগ্যে এই লাঞ্ছনা জুটেছে। চলচ্চিত্র অভিনেতা মরিয়া হয়ে ওঠেন। এই হতভাগ্য তরুণীর মতো অগণিত তরুণী এবং তাদের সন্তানদের সামাজিকভাবে গ্রহণ করার দাবি তুলে ধরা হয় এ চলচ্চিত্রে। যুদ্ধোত্তর সমস্যা নিয়ে খান আতাউর রহমানের আবার তোরা মানুষ হ ছবির চরিত্ররা প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেয় যুদ্ধে। যুদ্ধের পর দেখানো হচ্ছে- তারা লুটপাট নিয়ে ব্যস্ত। এসব দেখে খান আতা তাদের প্রতি আহ্বান জানান, তারা যেন ভাল হয়ে যায়, অস্ত্র ফিরিয়ে দেয়। এ ছাড়া মিতার আলোর মিছিল মুক্তি পায় ১৯৭৪ সালে। প্রয়াত নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ উপহার দেন ‘আগুনের পরশমণি’। ১৯৯৪ সালে মুক্তি পায় এই চলচ্চিত্রটি। উল্লেখ্য, এই চলচ্চিত্র দিয়েই হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে। শুধু তা-ই নয়, দেশে দীর্ঘ একযুগ পর মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ ১৯৯৫ সালে এটি নির্মাণ করেন। ১৯৯৭ সালে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের গল্প অবলম্বনে চাষী নজরুল ইসলাম নির্মাণ করেন ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’। মুক্তিযুদ্ধের সময় এক স্নেহময়ী মা মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ষা করতে গিয়ে তার প্রতিবন্ধী পুত্রকে তুলে দেন পাক সেনাদের হাতে। তারা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। মা নিজের পুত্রের চেয়েও দেশকে বড় করে দেখেছিলেন। এমন মর্মস্পর্শী ত্যাগের গল্পের এই চলচ্চিত্রটি। একই বছর খান আতাউর রহমান নির্মাণ করেন ‘এখনও অনেক রাত’। ১৯৯৮ সালে নির্মিত হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় ছবি ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’-এ মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ এসেছে। একাত্তরের এক স্বাধীনতা বিরোধীকে এ ছবিতে তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইতে দেখা যায়। তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ নির্মিত হয় ২০০২ সালে। এটাই বাংলাদেশের প্রথম অস্কারের জন্য মনোনীত কোন চলচ্চিত্র। এতে মুক্তিযুদ্ধ উঠে এসেছে ভিন্ন আঙ্গিকে। ২০০২ সালে মুক্তি পায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক তিনটি চলচ্চিত্র; হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্যামল ছায়া’, তৌকির আহমেদের ‘জয়যাত্রা’ এবং কথা সাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের উপন্যাস অবলম্বনে চাষী নজরুল ইসলাম তৈরি করেন ‘মেঘের পরে মেঘ’। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘নিষিদ্ধ লোবান’ অবলম্বনে ২০১১ সালে মুক্তি পায় নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর ‘গেরিলা’। ছবিটিতে অভিনয় করেছেন সহস্রাধিক শিল্পী। সরকারী অনুদানপ্রাপ্ত এ ছবিটি কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা ছবি হিসেবে পুরস্কৃত হয়। একই বছর সরকারী অনুদানে মুহম্মদ জাফর ইকবালের জনপ্রিয় একটি শিশুতোষ উপন্যাস অবলম্বনে ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ ছবিটি নির্মাণ করেছেন মোরশেদুল ইসলাম। ১৯৭১ সালে মফস্বল শহরের কয়েকজন কিশোর কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে, তারই কিছু চিত্র ফুটে উঠেছে গল্পে। গত দুই বছরে মুক্তি পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধভিক্তিক ছবি ’৭১ মা জননী’, জীবন ঢুলী ছবি দুটি। ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধের গল্পে নির্মিত ছবির সংখ্যা একটু বেশিই। ছবিগুলো হলো- ‘এইতো প্রেম’, ‘হরিযুপীয়া’, ’শোভনের স্বাধীনতা’, ’একাত্তরের ক্ষুদিরাম’, ‘বাপজানের বায়োস্কোপ’ ও ‘অনিল বাগচীর একদিন’। তবে মুক্তিযুদ্ধে বাস্তব দৃশ্যকাব্য বলতে যা বোঝায়, সেই খেতাব এসব ছবির কোনটাকেই দিতে পারেননি চলচ্চিত্র বিশ্লেষকরা।
×