ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

খোকন তালুকদার

এক বীরের ডায়েরি থেকে

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬

এক বীরের ডায়েরি থেকে

মোঃ আলাউদ্দিন মাস্টার। জন্ম ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর থানার গোহালাকান্দা গ্রামে। লেখাপড়া করেছেন গৌরীপুর কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পেশায় শিক্ষক। গাজীপুর সদর উপজেলায় পিরুজালী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন দীর্ঘ ১৮ বছর। তার শিক্ষকতার বয়স ৪১ বছর। শিক্ষকতা ছাড়াও তার বড় পরিচয় হচ্ছে তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধ করেছেন ১১ নং সেক্টরে। বিজয়ের মাসে তার স্মৃতিচারণ তুলে ধরার সামান্য প্রয়াস। ‘এটা ছিল আমাদের দ্বিতীয় অভিযান। উদ্দেশ্য একটাই তেলিগাঁথি নামক ক্যাম্পটা আমাদের অধীনে নিয়ে আসা। আমাদের দলে তখন ৬৪ জন। সঙ্গে যোগ দেয় মিত্র বাহিনী। এ অভিযানের নেতৃত্ব দেন ভারতের মেজর বাজিৎ সিং। কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধ করে ক্যাম্পটিকে আমরা প্রায় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসি। এ অভিযানে আমাদের দলের ২ জন, মিত্র বাহিনীর ২৩ জন যোদ্ধা শহীদ হয়। আর পাকিস্তান বাহিনীর দুই শতাধিকের সঙ্গে দুই বাঙালী মহিলাও নিহত হয় যারা ঐ ক্যাম্পে আগে থেকেই ছিল। অভিযান শেষে বাজিৎ সিং আমাদের একত্র করে বলেন, এখন আমাদের একটাই কাজ। তা হলো রাতের অন্ধকারে এই ক্যাম্পে বাংলাদেশের ঝা-া (পতাকা) উড়িয়ে দেয়া। তিনি ২০ জনের একটি নতুন দল ঘোষণা করলেন। যার মধ্যে বাজিৎ সিং নিজে ও আমি এবং আমার সহযোদ্ধা আবদুর রহিম ছিল। তিনি ব্যক্তিগতভাবে আমাকে খুব ভালবাসতেন। প্রতিটি যুদ্ধে তিনি আমার সঙ্গে অবস্থান নিতেন। ঝা-া উড়ানোর কাজটা খুব কঠিন ছিল। কারণ, তখন ওখানে কিছু পাক-বাহিনী থাকার আশঙ্কা ছিল। আবদুর রহিম যেতে অমত প্রকাশ করল। বাজিৎ সিং অনেক বোঝাল কিন্তু কাজ হলো না। এরপর আবদুর রহিম আমাকে ডেকে বলল, আমি যেতে পারি তবে একটা শর্তে। আমাকে পেট ভরে ভাত খাওয়াতে হবে আগে। আমি অনেক দিন পেট ভরে ভাত খাই না। বাজিৎ সিংকে একথা জানালে তিনি আবদুর রহিমের জন্য ভাতের ব্যবস্থা করেন। এরপর আমরা রাতের অন্ধকারে ঝা-া উড়ানোর জন্য বেরিয়ে যাই। আস্তে আস্তে আমরা ক্যাম্পের খুব কাছে চলে যাই। সবার সামনে পতাকা বহনকারী তার পিছনে আবদুর রহিম আর আবদুর রহিমের পিছনে আমি। আমার পিছনে বাকিরা। এমন সময় আমাদের ওপর আতর্কিত আক্রমণ করা হলো। আবদুর রহিম পড়ে গিয়ে কাতরাচ্ছে। আমি তাঁর শরীরে হাত দিলাম কিন্তু রক্ত পেলাম না। যখন পিঠে হাত দিলাম আমার হাত রক্তে ভিজে গেল। আবদুর রহিম শুধু গোঙানোর শব্দ ছাড়া আর কোন কথা বলতে পারল না। দলের সবাই আবদুর রহিমের লাশ নিয়ে পিছনে চলে এলো। অনেকটা দূরে এসে আমরা থামলাম। এমন সময় কোম্পানি কমান্ডার আবুল হোসেন আমাকে বলল, আবদুর রহিমের রাইফেলটা রয়ে গেছে তুমি গিয়ে নিয়ে এসো। আমি রাইফেল আনার জন্য আবার ক্যাম্পের দিকে হাঁটতে থাকলাম। রাইফেলটা জায়গা মতই পেয়ে যাই আমি। কিন্তু পিছনে এসে আমার সাথীদের আর দেখা পেলাম না। কিছুক্ষণ পরেই অন্ধকারে আমি পথ হারিয়ে ফেলি। হাঁটতে হাঁটতে মানুষের শব্দ শুনতে পাই। আমার দলের লোকজন ভেবে তাদের দিকে এগিয়ে যাই। কাছে আসতেই মিত্র বাহিনীর দল আমাকে হোল্ড হতে বলে। আমিও হাত ওপরে তুলে দাঁড়িয়ে যাই। ওরা ভাবে যে আমি হয়ত যুদ্ধ থেকে পালিয়ে যাচ্ছি। যা ছিল ওদের কাছে গুরুতর অপরাধ। ওরা আমাকে সামনের দিকে অগ্রসর হতে না দিয়ে আবার ক্যাম্পের দিকে পাঠিয়ে দেয়। আমি মহা বিপদে পড়ে যাই। কোন দিকে যাব ভেবে না পেয়ে আমি ডান দিক ধরে অন্ধকারের মধ্যে হাঁটতে থাকি। এরপর হাঁটতে হাঁটতে একটি টিলায় এসে দাঁড়াই, বুকে ও দুই জানুর মধ্যে দুটি অস্ত্র জড়িয়ে সাবধানে নিচে নামি। আর অপেক্ষা করতে থাকি সকালের জন্য। ভোরে সূর্যের আভা দেখা মাত্রই আমি পূর্ব দিকে হাঁটতে থাকি। এরপর এক মধ্যবয়সী লোকের সাহায্যে আমি আমার ক্যাম্পে চলে আসি। এসে দেখি ততক্ষণে আবদুর রহিমের জানাজা শেষ, দাফনও সম্পন্ন। আবদুর রহিমের মুখটি শেষ বারের মতো আমার আর দেখা হলো না।’ পিরুজালী ইউনিয়ন, গাজীপুর থেকে
×