ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ রফিকুল ইসলাম

আমরা তোমাদের ভুলব না

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬

আমরা তোমাদের ভুলব না

শৈশবে একদিন আমরা নেচেনেচে ছড়া কেটেছি- আউলা-ঝাউলা পাকিস্তান, দেশে আইলো ইরিধান; ইরিধানের গন্ধে, নয়াভাবি কান্দে। সে সময়ে কাচারিঘরে লোকজন নিয়ে আমার কাকু শুনছেন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। কিছুদিন পর একজন দৌড়ে এসে জানাল, ‘স্যার, বড়রাস্তা দিয়া পিঁপড়ার মতো মিলিটারি যাইতাছে বিরিশিরির দিকে।’ কাকু পুকুরপাড়ে দৌড়ে গিয়ে সে দৃশ্য দেখলেন। একদিন আমার দাদিকে সালাম করে চলে গেলেন কর্মস্থল নেত্রকোনা মহাবিদ্যালয়ে। অনেকদিন পর নবাগত বারোজন সঙ্গী নিয়ে ফিরে এলেন বাড়িতে। তাদের বিভিন্ন ছদ্মবেশ ধারণ করার অনুশীলন করতে দেখি। দু’একদিন বাদে দু’গ্রুপে ভাগ হয়ে তারা ভারতের পথে রওনা হলেন। পড়শি বাড়িতে এক কন্যাশিশুর জন্ম হলো, কাকু নাম রাখলেন ‘রাষ্ট্রন্নেসা’। আরেকদিন জব্বার ভাই, ওয়াজেদ ভাই এবং কার্তিকদাকে নিয়ে গেলেন ভারতের বাঘমারায়, ফিরলেন একা। পরে আবার চলে গেলেন নেত্রকোনায়। আমার এক ভাইয়ের জন্ম হলো। চিঠিতে নাম পাঠালেন ‘মুজিব’। একদিন আমরা বাড়িঘর ছেড়ে পালাচ্ছি। পথের মধ্যেই খবর পেলাম, বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। দূরগ্রামেই খবর পেলাম, কাকুকে নেত্রকোনায় এ্যারেস্ট করা হয়েছে। অতঃপর তাঁকে নিয়ে এলো বাড়ির কাছে বিরিশিরির পাকি সেনাক্যাম্পে। রাজাকার পরিবেষ্টিত মেজর সুলতান তাঁকে জানায়, ‘প্রফেসর, আপনি খুবই জনপ্রিয়, বহু ছাত্র-যুবাকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছেন, মুজিবের নেতৃত্বে আপনি নতুন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেন; অতএব আপনার শাস্তি মৃত্যুদ-। কিন্তু, আপনার ছাত্র ও ভক্তদের নিয়ে যদি আমাদের পক্ষে আসেন, পাকিস্তানের বশ্যতা স্বীকার করেন, তাহলে আপনি হবেন মুক্ত; এ এলাকার নেতৃত্ব থাকবে আপনারই হাতে।’ কাকু বললেন, ‘এ প্রস্তাব ঘৃণা করি, এর চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়!’ ১৬ আগস্ট কাকুকে হত্যা করা হয়। একসাগর রক্তের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বরে বিজয়ের স্বাদ গ্রহণ করল স্বাধীন বাংলাদেশ। চারদিকে স্বজন-হারানো পাঁজরভাঙ্গা কান্না, শ্মশানখলার মতো বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি, তবুও বিজয়ের মাসে আর জীবনমুখী স্বপ্নে ক্রমান্বয়ে প্রাণবন্ত হচ্ছে গ্রাম-গঞ্জ-শহর। কিন্তু, যেসব মৃত্যুঞ্জয়ীরা ছিল পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্পদ, তাঁদের মর্মন্তুদ বিয়োগব্যথা জাতি কোনভাবেই ভুলতে পারছে না, আদর্শ হিসেবে মনের মণিকোঠায় চিরভাস্বর করে গেঁথে রাখছে। তাঁদেরই একজন আমার কাকু, শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক আরজ আলী। নেত্রকোনার মানুষ তাঁকে নিয়ে রচনা করে বিজয়গাথা বাউলগান। যে গান তাদের কাঁদায়, গর্বিত করে ও দেশাত্মবোধ শেখায়। হাট-বাজারে-স্টেশনে, রেলগাড়িতে, গ্রামীণ আসরে অবিরাম একতারা-দোতারায় সুর তুলছে সে গান- কই গেলা ভাই আরজ আলী? তোমার জন্য কান্দিতেছে শত শত বাঙালী। করলেন তিনি প্রফেসারি, দেশ-বিদেশে নামজারি; পাগল হয়ে পুরুষ-নারী দিতো কত পুষ্পাঞ্জলি। আরেক কথা মনে উঠে, কইতে কলিজা ফাটে; পাকিস্তানের পাল্লায় উঠে- এই দেশের শয়তানগুলো- যুক্তি করে এই কয়জনা, দেশে যোগ্য লোক রাখব না; এই সাহেবকে মারল নিয়া করে রাইফেলের গুলি। মৃত্যুকালে সাহেব বলে, ওগো আল্লাহ, তুমি স্বাধীন করিও সোনার বাংলা; জপতে জপতে ইল্লাল্লাহ, স্বর্গপুরে গেলেন চলি। এদেশের দশের কথা, ভুলতে নারি উনার কথা; হাসরের দিন বিধাতা, দেখাইও তাঁর রূপাঞ্জলি। (সংক্ষেপিত) দুর্গাপুর, নেত্রকোনা থেকে
×