ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মনের জীবনের সন্ধান কর

প্রকাশিত: ০৬:৫১, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৬

মনের জীবনের সন্ধান কর

তরুণরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মধ্য দিয়ে যে দক্ষতা ও মূল্যবোধ অর্জন করে তার ফলে তারা আস্থার সঙ্গে ভবিষ্যতকে মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়ে ওঠে। তার অর্থ তারা অনিশ্চিত এ প্রায়শ বিভ্রান্তিকর এক জগতে সত্যের সন্ধান চালিয়ে মেতে পরিপূর্ণ সক্ষমতা অর্জন করে। সত্যের নানা ডাইমেনশন বা মাত্রা আছে। এ নিয়ে আলোচনা করতে যাওয়া অনেক সময় ঝকমারি হয়ে উঠতে পারে। সত্য অনেক সময় এক ভোঁতা হাতিয়ার আবার অনেক সময় বিপজ্জনক অস্ত্র হতে পারে। কোন কোন দেশে এমনকি আমাদের এ যুগেও ক্ষমতার অপব্যবহারের সাক্ষী হওয়ার কারণে সত্যোচ্চারণকারীর স্থান হতে পারে কারাগারে কিংবা তার চেয়েও ভয়াবহ কোন স্থানে। কোন একটা কিছু সত্য এবং একই সময় সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা এই মর্মে পরিপূর্ণভাবে নিশ্চিত হওয়া- এটাও সম্ভব। আমাদের আজকের বিশ্বে এমন মানুষও আছে যারা সেই কথিত সত্যের জন্য মৃত্যুবরণ করতে কিংবা হত্যা করতে প্রস্তুত যে সত্যের ভিত্তির বাস্তব বৈধতা নেই। ইতিহাস থেকে আমরা আরও জেনেছি যে শাশ্বত সত্য বলে যা ধরে নেয়া হয় তা পরে অপ্রচলিত বা সেকেলে হয়ে যায়। পৃথিবী সমতল, সূর্য একটা সোনালি রথ, ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্র আছে, প্লুটো একটা গ্রহ, নারীরা দুর্বল লিঙ্গ ইত্যাদি ইত্যাদি। কাজেই সত্য একটা জটিল বিষয়। কিন্তু শিক্ষিত মানুষের কাছে সত্য হলো এক অনস্বীকার্য অন্বেষা। কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মধ্য দিয়ে মনের জীবনের সন্ধানের কথা বলা হয়। কিন্তু যা মিথ্যা তা থেকে সত্যকে পৃথক করার চেষ্টা না করে সে কাজটা করা যায় না। তবে এই মিশনের শুরু হয় এক গুরুত্বপূর্ণ সূত্র দিয়ে এবং তা হলো যা কিছু জানার আছে তার সবকিছু আমরা আগে থেকে জানি না। সে কথাটা স্বীকার করা আমাদের অনেকের জন্য কঠিন হতে পারে। আমরা যা জানি বলে ভাবি সেটা পাশে সরিয়ে রাখা নয় বরং সেই জ্ঞানকে আরও কিছু শেখার প্লাটফর্ম হিসেবে কাজে লাগানোই হলো পরবর্তী শিক্ষার চাবিকাঠি। তার অর্থ আমাদের ভাবনাগুলোকে আলোচনা শেষ করে দেয়া নয় বরং আলোচনা শুরু করার জন্য কাজে লাগানো উচিত। আমরা আগে কখনও ভেবে দেখিনি এমন আইডিয়াগুলোর জন্য নিজেদের মস্তিষ্ক সামান্য কিছু জায়গা আমাদের সর্বদাই ছেড়ে দেয়া উচিত। তার অর্থ হলো আমাদের কখনই পুরোপুরি পরিতৃপ্ত থাকা উচিত নয়। না শিখতে পারলে বেঁচে থাকা হয় না। কলেজে থাকাকালীন ও কলেজ পরবর্তী সময়টাই হলো জীবনের নতুন দিকগুলো অনুসন্ধান করে দেখার আদর্শ সময়। আলোড়িত হওয়ার মতো ব্যাপার হলো এই যে আমাদের যুগে এই অনুসন্ধানের সুযোগগুলো বহুগুণে বেড়ে গেছে। আগে বই থেকে কোন তথ্য বের করতে হলে লাইব্রেরি ঝেঁটে বের করতে হতো। তারপর গোটা বিষয়টা হাতে লিখে টুকে নিতে হতো। সংবাদপত্রের কোন নিবন্ধ পেতে চাইতে পত্রিকার লাইব্রেরিতে মাসওয়ারি ও বছরওয়ারি সংরক্ষণ করে রাখা পুরনো হলদেটে হয়ে যাওয়া কাগজের স্তূপ থেকে তা বের করতে হতো। গবেষণার কাজটা ছিল বেশ পরিশ্রমসাধ্য। তবে একমাত্র সেটাই যে আমাদের জ্ঞানার্জনের প্রয়াসকে মন্থর করে দিত তা নয়। এখন জ্ঞানার্জনের নতুন নতুন পথ খুলে গেছে। বিশ্বের এত বেশি দেশ ও প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠী যেখানে অতীত নিয়ে এখনও ক্রুব্ধ সেখানে আমাদের নেতারা শান্তিময় ভবিষ্যত কিভাবে গড়ে তুলতে পারবে। মারণাস্ত্রগুলো সন্ত্রাসী ও আগ্রাসী শক্তির হাতে না পড়তে দেয়ার জন্য আমরা কি করতে পারি? আমাদের নিজেদের অস্বীকৃতির সুদৃঢ় প্রাচীর কি করে ভেদ করে দেয়া যায়। মানুষের জন্য সমৃদ্ধির ভবিষ্যত কিভাবে নির্মাণ করা সম্ভব? যাদের শিক্ষা ও দক্ষতার মান গড়পরতামাত্র তাদের অবস্থান কোথায় হবে? ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান আরও না বাড়িয়ে উদ্ভাবন ও উৎকর্ষতার শক্তিশালী প্রেরণা কিভাবে বজায় রাখা যেতে পারে? এ ধরনের হাজারো প্রশ্নে আংশিক তালিকা থেকেও আমরা বুঝতে পারি যে ভবিষ্যতের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো এককভাবে কোন একটি দেশ বা ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর পক্ষে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন এক নতুন যুগের সহযোগিতার যা বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে প্রসারিত হবে। এই সহযোগিতার নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার দায়িত্ব এককভাবে সরকারের নয়। কর্পোরেশন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, সুশীল সমাজ ও নাগরিকবৃন্দসহ প্রত্যেককেই এই অভিন্ন সমস্যার সমাধানে অংশ নিতে হবে। এ জাতীয় সমন ঘোষণা করা সহজ। কিন্তু সত্যের প্রতি সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গি ব্যতিরেকে এর জবাব দেয়া সম্ভব নয়। কারণ প্রত্যেককেই যদি বাস্তবতার প্রতি নিজ নিজ সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি আঁকড়ে থাকে তাহলে সে ধরনের সহযোগিতা আমাদের দরকার তা আমরা পাব না। আমার কাছে এটাই হলো আজকের বিশ্বের বিরাট বিভাজন। সেই বিভাজন উদারপন্থী ও রক্ষণশীলের মধ্যে নয়, ধনী-দরিদ্রের মধ্যে নয় কিংবা এক জাতি বা গোত্রের সঙ্গে অন্য সব জাতি বা গোত্রের মধ্যে নয়। সেই বিবাজন হলো শুনবার মতো সাহস আছে এমন মানুষ এবং যারা ইতোমধ্যে সবকিছু জেনে বসে আছে বলে স্থির নিশ্চিত সেই সব মানুষের মধ্যে বিভাজন।
×