ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

১০ মেগা প্রকল্পে অর্থায়ন

রিজার্ভের অর্থে সভরেন ওয়েলথ ফান্ড গঠন করা হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৬

রিজার্ভের অর্থে সভরেন ওয়েলথ ফান্ড গঠন করা হচ্ছে

এম শাহজাহান ॥ দশ মেগা প্রকল্পের অর্থায়নে রিজার্ভের টাকায় সভরেন ওয়েলথ ফান্ড গঠন করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই ফান্ড কিনে আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে পদ্মা সেতুসহ বড় প্রকল্পের জন্য অর্থ সংগ্রহ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইএফসি) পূর্বের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসায় আপাতত বন্ড ছেড়ে অর্থ সংগ্রহের কোন পরিকল্পনা করছে না সরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিদেশী মুদ্রার ভান্ডার অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে এখন সমৃদ্ধ ও শক্ত অবস্থানে রয়েছে। আর তাই প্রায় ৩৩ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভের এই অর্থ দিয়ে দেশে প্রথমবারের মতো সভরেন ফান্ড বা রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ তহবিল গঠন করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সভরেন ওয়েলথ ফান্ড গঠনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর এস কে সুরের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি কমিটি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে। দেশের অতিরিক্ত রিজার্ভ ব্যবহার করে কীভাবে অবকাঠামো সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা যায় তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে এই কমিটি। ওই কমিটি তহবিল গঠনের সম্ভাব্যতা, তহবিলের কার্যপ্রণালি এবং আন্তর্জাতিক মানদ-ে এর উত্তম ব্যবস্থাপনার নীতিগত ও কারিগরি দিকগুলো পর্যালোচনা করে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করছে। এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সভরেন ওয়েলথ ফান্ড বা তহবিল গঠনও পরিচালিত হবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, পদ্মা সেতুসহ মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে বড় অঙ্কের অর্থ প্রয়োজন। এই অর্থ সংগ্রহের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু রিজার্ভ দিয়ে সভরেন ওয়েলথ ফান্ড গঠন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে দেশের রিজার্ভ এখন বেশি সমৃদ্ধ ও পরিপক্ব। তাই সভরেন ওয়েলথ ফান্ড গঠন করে তা কিনে নিবে সরকার। আগামী অর্থবছরেই মেগা প্রকল্পগুলোতে এই অর্থ ব্যবহার করার চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এ ফান্ড গঠনের ব্যাপারে গঠিত কমিটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। তবে আইএফসির সিদ্ধান্তহীনতার কারণে টাকা বন্ড ছেড়ে অর্থ সংগ্রহের বিষয়টি থেকে আপাতত সরে আসা হয়েছে। তবে বন্ড ছাড়ার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক এ সংস্থাটির ইতিবাচক সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে সরকার। দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে টাকা বন্ড ছেড়ে অর্থ সংগ্রহ করার উদ্যোগটিও ভাল সিদ্ধান্ত। এদিকে সভরেন ওয়েলথ ফান্ড বা তহবিল হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ তহবিল। কোন দেশের বৈদেশিক লেনদেনে আয়ের চেয়ে ব্যয় কম হলে উদ্বৃত্ত রিজার্ভ দিয়ে এ ধরনের তহবিল গঠন করা হয়। সভরেন বা সার্বভৌম সম্পদ তহবিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক গঠন করতে পারে। এ ধরনের তহবিলের সামষ্টিক বা বাজেটীয় গুরুত্ব রয়েছে। আর এ তহবিল থেকে স্টক, বন্ড, ভূমি, মূল্যবান ধাতুর মতো খাঁটি ও আর্থিক সম্পদে বিনিয়োগ করা হয়। সাধারণত এ তহবিল বিনিয়োগ হয় আন্তর্জাতিক পরিম-লে। তবে বাংলাদেশে এ তহবিল মূলত ফাস্ট ট্র্যাক খ্যাত দশ মেগা প্রকল্পে ব্যবহারের জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার গত ২০১২ সালে সার্বভৌম বা সভরেন বন্ড ছাড়ার একটি উদ্যোগ নিয়েছিল। এছাড়া ২০১১ সালে স্বল্পোন্নত ৪৮টি দেশের অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবেলায় দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা আরও বৃদ্ধির পাশাপাশি একটি সার্বভৌম সম্পদ তহবিল গঠনের তাগিদ দিয়েছিল জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আঙ্কটাড)। এক্ষেত্রে অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থা ভাল বলে আঙ্কটাডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল। তখন এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল বেসরকারী সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ। তবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো এখন পর্যন্ত এ ধরনের তহবিল গঠন করতে না পারলেও বর্তমানে বিশ্বের প্রায় অর্ধশত দেশে এ ধরনের তহবিল রয়েছে। তবে চীনের তহবিলই সবচেয়ে বড়, যার আকার প্রায় ১ লাখ ৪৬ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। এ তহবিলের জন্য চীন এখন বিশ্বের ধনী দেশগুলোর অন্যতম। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তহবিল আছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের, যার পরিমাণ ১ লাখ ৭ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। এছাড়া নরওয়ে, সৌদি আরব, কুয়েত, সিঙ্গাপুর, হংকং, কানাডা, কাতার, রাশিয়া, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া ও ফ্রান্সসহ আরও অনেক দেশের এই তহবিল রয়েছে। সমৃদ্ধ বাংলাদেশের রিজার্ভ ॥ দেশের রিজার্ভ পরিস্থিতি এতটা সমৃদ্ধ যে, সভরেন ওয়েলথ ফান্ড গঠন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। রিজার্ভ পরিস্থিতি ভাল হলে যে কোন দেশ এ ধরনের তহবিল গঠন করতে পারে। বিদ্যুত, জ্বালানি, বন্দর, রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামো উন্নয়নে সরকার যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তা বাস্তবায়নে বড় অঙ্কের অর্থ ও বিনিয়োগ প্রয়োজন। এই অর্থ আসবে সভরেন ওয়েলথ ফান্ডের মাধ্যমে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশী মুদ্রার ভান্ডার আরও সমৃদ্ধ হয়ে ৩ হাজার ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। প্রতি মাসে সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার আমদানি খরচ হিসাবে এই রিজার্ভ দিয়ে নয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে রিজার্ভ। শুধু তাই নয়, গত ১৬ বছরে ৩২ গুণ বেড়ে রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। গত ফেব্রুয়ারিতে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ খোয়ানোর পর নানা ধরনের সমালোচনার মধ্যে রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলার ছাড়ানোকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। জানা গেছে, সরকারের দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনায় থাকা পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন চলছে। এছাড়া জাপানী উন্নয়ন সংস্থা জাইকার অর্থায়নে মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজও শুরু হয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়-বিভাগের অধীনে এডিপির আওতায় অবকাঠামো খাতের ফাস্ট ট্র্যাক হিসেবে চিহ্নিত ১০টি প্রকল্পের মধ্যে আটটি প্রকল্পের (এলএনজি ও সোনাদিয়া ব্যতীত) মোট প্রাক্কলিত ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা। এছাড়া প্রস্তাবিত বাজেটেই এই দশ প্রকল্পের জন্য এডিপিতে মোট ১৮ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা মোট এডিপির প্রায় ১৭ শতাংশ। আগামী বাজেটে এই বরাদ্দ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। মেগা প্রকল্পের মধ্যে পদ্মা সেতুর কাজ দ্রুত এগিয়ে চললেও রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুত প্রকল্প, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর ও পায়রা সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ চলছে ধীরগতিতে। ফাস্ট ট্র্যাক হিসেবে এসব প্রকল্পকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। প্রথম পর্যায় মেগা ৬টি প্রকল্পকে ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। পরবর্তী সময়ে যুক্ত করা হয় মাতারবাড়ি বিদ্যুত কেন্দ্রও পায়রা সমুদ্রবন্দর প্রকল্প। এসব প্রকল্পের প্রত্যেকটিতেই ভারত, চীন, জাপান ও রাশিয়ার অর্থায়নের প্রস্তাব রয়েছে সরকারের কাছে। কোন কোন প্রকল্পে একাধিক চীন-ভারত অথবা চীন-জাপান উভয়ই বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে।
×