ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চুরি যাওয়া রিজার্ভের আরও ২১০ কোটি টাকা ফেরত পাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৬

চুরি যাওয়া রিজার্ভের আরও ২১০ কোটি টাকা ফেরত পাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু

গাফফার খান চৌধুরী ॥ চুরি যাওয়া রিজার্ভের ৮শ’ কোটির মধ্যে আরও ২১০ কোটি টাকা ফেরত পাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। টাকাগুলো ফিলিপিন্সের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রয়েছে। এ ব্যাপারে ফিলিপিন্সের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ চলছে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশকে ওই টাকা ফেরত দেবে বলে আশ্বস্ত করেছে ফিলিপিন্স। এর আগে ১৬০ কোটি টাকা ফেরত পাওয়া গেছে। বাকি প্রায় ৪৩০ কোটি টাকাও ফেরত পেতে বাংলাদেশ ও ফিলিপিন্সের মধ্যে কূটনৈতিক তৎপরতা চলছে। কূটনৈতিক তৎপরতা চলমান থাকায় অর্থ ফেরত পেতে বাংলাদেশ ব্যাংক মামলা দায়ের না করার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে জমা থাকা বাংলাদেশের ২৬ বিলিয়ন ডলারই হ্যাকারদের টার্গেট ছিল। হ্যাকারদের নেপথ্যে রয়েছে এগারোটি দেশের একটি আন্তর্জাতিক মাফিয়া গোষ্ঠী। গোষ্ঠীটি হাতিয়ে নেয়া অর্থের সিংহভাগই ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ব্যয় করার টার্গেট নিয়েছিল। বেশকিছু অর্থ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ব্যয় করেছে মাফিয়া গোষ্ঠীটি। রিজার্ভ চুরির ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। চলতি বছরের গত ১৫ মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের জমা রাখা টাকার মধ্যে ৮শ’ কোটি টাকা চুরির ঘটনায় মতিঝিল থানায় একটি মামলা দায়ের হয়। মামলার এজাহারে কাউকে অভিযুক্ত করা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব ও বাজেট বিভাগের যুগ্ম-পরিচালক জোবায়ের বিন হুদা মামলাটি দায়ের করেন। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে মামলাটি দায়ের করা হয়। সিআইডি সূত্র বলছে, চলতি বছরের ৯ মে ফিলিপিন্সের ১৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে একটি মাফিয়া গোষ্ঠী তাদের প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ করার পরিকল্পনা করে। ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মাফিয়া গোষ্ঠীটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে জমা থাকা বাংলাদেশের টাকা হাতিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করে। ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযোগ সৃষ্টি হয় ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা সেবা দিয়ে থাকে সুইফট নামের আন্তর্জাতিক সংস্থা। ওই সময় সুইফটের তরফ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা শক্তিশালী করতে কাজ করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ দেখভাল করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বিশেষ প্রযুক্তিগত সেল রয়েছে। সুইফটের কারিগররা রিজার্ভ সেলটির কম্পিউটারগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যান্য কম্পিউটার যুক্ত করে দেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রায় পাঁচ হাজার কম্পিউটারের সার্ভার একটি নির্দিষ্ট প্রযুক্তির মধ্যে নিয়ে আসার ফলে রিজার্ভ চুরির পথ খুলে যায়। তখনই হ্যাকাররা ম্যানুয়াল ও মেসেজ পাঠিয়ে রিজার্ভ থেকে টাকা চুরি করা শুরু করে। ওই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমানে রিজার্ভ প্রায় ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। হ্যাকাররা পুরো ২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারই হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছিল। তারা ম্যানুয়াল ও বেজ মেসেজের মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে সফল হলেও বেজ মেসেজের মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নিতে তাড়াহুড়ার কারণে তারা ভুল করে। এজন্য ৮শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার পর বিষয়টি ধরা পড়ে। এর পরই পুরো প্রক্রিয়াটি প্রকাশ পেয়ে যায়। ওই সময় শ্রীলঙ্কার শালিকা ফাউন্ডেশন নামের একটি এনজিওর এ্যাকাউন্টে ২০ মিলিয়ন ডলার জমা হয়। ভৌতিক এমন টাকা জমা হওয়ার ঘটনাটি বাংলাদেশ ব্যাংককে জানায় শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এর পরই বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। পরবর্তীতে ওই অর্থ শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশকে ফেরত দেয়। সূত্র বলছে, অর্থ চুরির আগে মাত্র ৫শ’ ডলার দিয়ে ফিলিপিন্সের রিজাল ব্যাংকে পাঁচটি এ্যাকাউন্ট খোলা হয়। এ্যাকাউন্টের মালিকরা স্বল্প সময়ের মধ্যেই এ্যাকাউন্টে বড় অঙ্কের টাকা জমা হচ্ছে বলে ব্যাংকটির ম্যানেজার মায়া দেগুইতিকে বলেছিলেন। সত্যি সত্যিই বিপুল পরিমাণ অর্থ এ্যাকাউন্টগুলোতে জমা হয়। পরবর্তীতে তদন্তে বেরিয়ে আসে ভয়াবহ কাহিনী। পুরো অর্থ হাতিয়ে নেয়ার সঙ্গে একটি মাফিয়া গোষ্ঠী জড়িত। মাফিয়া গোষ্ঠীটির নেটওয়ার্ক বিশাল। বিশ্বের ১১টি দেশের এগারোজন মাফিয়া এর সঙ্গে জড়িত। ওই গোষ্ঠীটি ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাদের প্রার্থীকে জয়ী করতে বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ করার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা মোতাবেক তারা হ্যাকারদের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের ২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হাতিয়ে নেয়। অর্থ হাতিয়ে নেয়ার সঙ্গে ২৩ জন হ্যাকার চিহ্নিত হয়েছে। তাদের নাম-পরিচয় থেকে শুরু করে সবকিছুই পাওয়া গেছে। ওই হ্যাকারদের ক্যাসিনোতে ইচ্ছা করেই জুয়া খেলে বিপুল পরিমাণ অর্থ জিতিয়ে দেয়া হয়। ওই সব টাকাই পরবর্তীতে রিজাল ব্যাংকের ওই পাঁচটি এ্যাকাউন্টে জমা হয়। ফিলিপিন্সে ক্যাসিনো নামের জুয়ার আসর থেকে আয় করার অর্থের হিসাব দিতে সাধারণত এ্যাকাউন্টের মালিক সে দেশের সরকারের কাছে বাধ্য নয়, এমন সুযোগটিকেই তারা কাজে লাগিয়েছে। পুরো এই প্রক্রিয়াটির সঙ্গে ২৭ জন বিদেশীর যোগসূত্র থাকার তথ্য মিলেছে। রিজার্ভের চুরি যাওয়া অর্থ ফেরত পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির অর্গানাইজ ক্রাইম বিভাগের জ্যেষ্ঠ পুলিশ সুপার মীর্জা আব্দুল্লাহহেল বাকী জনকণ্ঠকে বলেন, চুরি যাওয়া অর্থের মধ্যে স্বল্প সময়ের মধ্যেই আরও ২১ মিলিয়ন অর্থাৎ ২১০ কোটি টাকা ফেরত পাওয়ার সম্ভবনা সৃষ্টি হয়েছে। টাকাগুলো ফিলিপিন্সের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা আছে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই ফিলিপিন্স টাকাগুলো ফেরত দেয়ার আশ্বাস দিয়েছে। বাকি টাকা ফেরত আনতে বিভিন্নভাবে চেষ্টা অব্যাহত আছে। তবে নানা প্রক্রিয়ার মধ্যে চুরি যাওয়া টাকা ফেরত আনতে হয়, এজন্য বাকি টাকা ফেরত আনা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। সিআইডির একজন উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, ২১০ কোটি টাকা ফেরত পাওয়ার পর আরও ৪৩০ কোটি ফেরত পেতে বাকি থাকবে। বাকি টাকা আদায়ের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সিআইডি প্রতিনিধিদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে অর্থ আদায়ে কোন প্রকার মামলা দায়ের না করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কারণ অর্থ চুরির ঘটনায় নেদারল্যান্ডসের হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করতে হলে মামলার ফিসহ আনুষঙ্গিক সবকিছু মিলিয়ে প্রথম ধাপেই ২০ মিলিয়ন অর্থ খরচ হবে। এরপর মামলা চালাতে লবিস্ট নিয়োগ থেকে শুরু করে মামলা শেষ করা পর্যন্ত ৪৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আদায় করতে প্রায় ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হবে। মামলার প্রক্রিয়াটি খুবই দীর্ঘ ও জটিল। উপরন্তু কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি হলে অর্থ ফেরত পাওয়ার আর তেমন কোন সম্ভবনাই থাকবে না। এজন্য অর্থ আদায়ের জন্য কোন প্রকার মামলা দায়ের করা হচ্ছে না। কূটনৈতিক চ্যানেলে এবং আন্তর্জাতিক মহলের মাধ্যমে তদবিরের মাধ্যমে অর্থ আদায়ের কৌশল নেয়া হয়েছে। তিনি আরও জানান, রিজার্ভ চুরির সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি বিভাগের ডেপুটি গবর্নরসহ আইটি বিভাগের গাফিলতি দায়ী বলে তদন্তে ধরা পড়েছে। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ মনিটরিং সেলটি পুরোপুরি আলাদা করে ফেলা হয়েছে। রিজার্ভ সেলের কম্পিউটারের সঙ্গে বর্তমানে ব্যাংকের অন্য বিভাগের কম্পিউটারের সব সংযোগ বিচ্ছিন্ন।
×