ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সেলিম রেজা

মাটির পাত্রই উত্তম॥

প্রকাশিত: ০৭:০৬, ১২ ডিসেম্বর ২০১৬

মাটির পাত্রই উত্তম॥

সময়ের পরিবর্তন ও আধুনিকায়নে অংশগ্রহণ করাই মানুষের একমাত্র কাজ। আমরা জেনে শুনে অথবা অজান্তে এই একটি কাজই করে নিয়োমিত। প্রত্যেকের প্রতিটি কর্মের মূল উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক, পারিবারিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, এমনকি নৈতিক পরিবর্তনসহ জীবনের অন্যান্য শাখায় পরিবর্তন আনা। যে পরিবর্তনের ছোয়ায় ব্যক্তি থেকে পরিবার, পরিবার থেকে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্র এভাবে ক্রমান্বয়ে পৃথিবীই পরিবর্তিত হয়। এই পরিবর্তনে পৃথিবীর সমস্ত মানুষেরই অবদান সক্রিয়। যার ফলে গুহা থেকে বাড়ি, বাড়ি থেকে পাড়া, গ্রাম, মফস্বল, শহর ইত্যাদির সমন্বয়ে দুনিয়া ভেঙে দেশ। তেমনি গাছের ছাল ছেড়ে তৈরি পোশাক, শুধু ফলের পরিবর্তে রকমারি খাবার, প্রাকৃতিক শক্তি থেকে উৎপাদিত কেমিক্যাল, মাটি বাদে প্লাস্টিক বা অন্যান্য ধাতুর ব্যবহার। তবে এই পরিবর্তনের প্রাপ্তির আড়ালে ঢেকে যাচ্ছে পুরনো সংস্কার, ঐতিহ্য, রীতিনীতি, অভ্যাস। পরিবর্তনের সঙ্গে থাকতে গিয়ে সামান্য প্রপ্তির জন্য অথবা জীবনযাপনে যান্ত্রিকতার শর্ত বজায় রাখতে মানুষ তার মঙ্গলকর অনেক কিছু ফেলে ক্ষতিকর, নেতিবাচক এমনকি ভয়ঙ্কর অনেক কিছুর সঙ্গে অভ্যস্ত হচ্ছে দৈনন্দিন জীবনে। এক শতাব্দী আগেও এ উপমহাদেশের লোকেরা তাদের দৈনন্দিন ব্যবহারের বাসন-কোসন বা অন্যান্য আসবাব হিসেবে মাটির তৈরি বাসন-কোসন বা আসবাব ব্যবহার করত। কয়েক বছর আগেও মাটির হাঁড়ি, পাতিল, কলস, কুজো, সোরা, মালশা, জগ ইত্যাদি মাটির তৈরি অনেক কিছুর ব্যবহার দেখা যেত গ্রামে-গঞ্জে, এমনকি মফস্বলগুলোতেও মাঝে মাঝে এসবের ব্যবহার দেখা যেত। দ্রুত গতিতে বাণিজ্যের প্রসারে বিভিন্ন ধাতু বা প্লাস্টিক পণ্যের বিজ্ঞাপনসমূহ উপকারী জিনিসের চেয়ে চাকচিক্য ও টেকসই বস্তুর প্রতি মানুষের আগ্রহ সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছে। যার ফলে এক শতাব্দীর ব্যবধানে সেসব আসবাবপত্র, বাসন-কোসনে মাটির পরিবর্তে তামা, প্লাস্টিক, দস্তা, লোহা, স্টিলসহ বিভিন্ন ধাতু স্থান পেয়েছে। বর্তমান মাটির তৈরি বাসন-কোসন ব্যবহারের প্রচলন সংহার প্রায়। অথচ মাটির পাত্র ব্যবহার করা মানব দেহের জন্য ব্যাপক স্বাস্থ্যবর্ধক। বিশেষ করে মাটির তৈরি পাত্রে খাবার রান্না করা ও খাওয়া এবং মাটির তৈরি পানির পাত্রে পানি রাখা ও পান করা অন্য সকল ধাতুর পাত্রের অপেক্ষা মানব দেহের জন্য উৎকৃষ্ট। মাটির তৈরি বাসন-কোসন বা আসবাবের ব্যবহার এ অঞ্চলের গণ-মানুষের ঐতিহ্যও বটে। মাটির পাত্র শতভাগ প্রাকৃতিক এবং বিষমুক্ত। অন্যদিকে স্টিলে তৈরি হয় অনেক ধরনের ধাতু যেমন আয়রন, নিকেল, ক্রোমিয়াম, কার্বন ইত্যাদির মিশ্রণে। এসবের সামান্য পরিমাণ উপস্থিতিতে বিষদ পরিমাণ বিষ থাকে। যা কিডনি রোগ, লো-পেসার, পেশিকম্পন, ক্যান্সার ও ত্বকের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। মেটাল, সিরামিক পাত্র বা কড়াইতে রান্না করলে বা খাবার রাখলে ক্রোমিয়াম, নিকেল, টাইটেনিয়াম, এ্যালুমেনিয়াম, ক্যাডমিয়াম অথবা রাসায়নিক ও সিসার মতো ধাতু খাবারে মিশে যায়। আর প্লাস্টিক তো পৃথিবীর অস্তিত্বের জন্য হুমকি। মাটির পাত্র তাপে নিষ্ক্রিয় থাকায় খাবারের খনিজ ও পুষ্টিগুণ অক্ষুণœ থাকে। খাবারের সঙ্গে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, পটাসিয়াম, সোডিয়াম ইত্যাদি খনিজ পদার্থ থাকে যা আমাদের শরীরের জন্য অপরিহার্য, মাটির পাত্রে রান্না করলে খাবারের এসব খনিজসমূহ অপরিবর্তিত থাকে। কিন্তু ধাতুর পাত্রে রান্না করার সময় তাপের বিশেষ মাত্রায় খাদ্য ও জল দ্রবনীয় পুষ্টির মূল অংশ স্থির না থেকে বাষ্পের সঙ্গে উড়ে যায়। অধিক তাপে ধাতু প্রতিত্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। সুতরাং রান্নার সময়ও তাপের একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় খাবারে থাকা খনিজ পদার্থের সঙ্গে প্রতিক্রিয়ার ফলে খাবারের গুণগত মান ক্ষুণœ হয় এবং আয়রন উৎপাদিত হয়। যা আমাদের শরীরে জমে থেকে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করে। বিশেষজ্ঞদের মতে এ্যালুমিনিয়াম (দস্তা) ও আলজেইমের রোগের মধ্যে একটি শক্তিশালী সম্পর্ক আছে। মাটির পাত্র সেদিক দিয়ে পুরোপুরি দ্বিধামুক্ত। মাটির পাত্রে রান্না একটি আঁটসাঁট রান্নার পরিবেশ তৈরি করে। যে কারণে খাবারের ভিটামিন ও পুষ্টিগুণ বজায় থাকে। মাটির পাত্রে রান্না হলে খাদ্যের ভেতরে যে তৈল বা পানি থাকে তার বাহিরে অতিরিক্ত তৈল বা পানির প্রয়োজন হয় না। যে কারণে কম তেলে রান্না হয়। তাতে খাবারের স্বাদ ও পুষ্টিগত মান বজায় থাকে এবং খাবারে ফ্যাট কমায়। মাটির পাত্র প্রচুর আর্দ্রতা প্রদান করে এবং রান্নার সময় বাষ্প নিসরণ হয়। মাটির এসব প্রাকৃতিক শক্তি মানব দেহের জন্য নিঃসন্দেহে উপকারী। মাটির পাত্র প্রাকৃতিকভাবে ক্ষারযুক্ত, যা অম্লতা বা এসিডিটির সঙ্গে মিতষ্ক্রিয়া করে অম্লতা বা এসিডিটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। যখন এসিডিক বা অম্লিক খাবার যেমন দুধ, ডিম, মাংস এসব মাটির পাত্রে রান্না হয় তখন মাটির ক্ষার অম্ল/এসিডিটিকে প্রতিরোধ করে। সুতরাং মাটির পাত্রের পানি ও খাবার এসিডিটি নিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। এবং গ্যাসট্রোনোমিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয়। মাটির পাত্রে পানি রাখা বা পানি পান করা অন্য অন্য ধাতু বা প্লাস্টিক পাত্রের চেয়ে উৎকৃষ্ট। মাটির পাত্রে পানি রাখলে পানি ঠা-া থাকে। পুরনো দিনে ভ্রমণ শেষে বা ক্লান্তি শেষে মানুষকে ফ্রিজ নয় মাটির পাত্র থেকে পানি ঢেলে দেয়া হতো। বিজ্ঞানে বলে পানি রাখার সর্ব উত্তম উপায় হচ্ছে মাটির পাত্র। মাটির পাত্রে পানি রাখায় শুধুমাত্র পানি ঠা-া থাকে তা নয়, রোগমুক্তি বা নিরাময় উপাদান হিসেবেও গণ্য হয়। মাটির পাত্রে পানি জলবায়ুর উপর ভিত্তি করে শীতলতা হস্তান্তর করে। যে কারণে মাটির পাত্র অপ্রতিম এবং এই মানের অন্য কোন পানি বা খাবারের ধারক হতে পারে না। মাটির পাত্র সচ্ছিদ্রযুক্ত, যে কারণে যখন মাটির পাত্রে পানি রাখা হয় তখন বাষ্পিভবন ঘটে। এ প্রক্রিয়ার কারণে পানি ঠা-া থাকে, এবং উষ্ণতা থেকে শক্তি নিয়ে উষ্ণতাকে গ্যাসে রূপান্তর করে বাতাসের সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। মাটির পাত্রে রান্না করা খাবার খেলে এবং মাটির পাত্রে পানি পান করলে সেই খাবার ও পানি মানবদেহের সজীব উৎপাদনের রসায়নকে সতেজ রাখে। যা আমাদের ত্বক ও যৌবনশক্তি অক্ষুণœ রাখতে সহায়তা করে। মাটির পাত্রের দামও তুলনামূলক অনেক কম। এমনকি মাটির পাত্রসমূহ দেখতেও অন্য ধাতুর তৈরি পাত্রের চেয়ে কম সুন্দর নয়। সুতরাং বাড়িতে নিজের খাবারের বা পানির পাত্রটা মাটির হলে সবদিক দিয়ে ফলপ্রদ হয়। আমরা চাইলে সচেতনভাবেই মাটির তৈরি বাসন-কোসন বা আসবাব ব্যবহারে অভ্যস্ত হতে পারি। তাতে করে আমাদের খাবারটা স্বাস্থ্যকর তো হবেই, অর্থনৈতিকভাবেও সাশ্রয় হবে। এছাড়া মাটির তৈরি আসবাব তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত বাংলাদেশের কুমার সম্প্রদায়ও টিকে যাবে তাদের নিজস্ব পেশা ও সংস্কৃতিতে।
×