ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাধীন বাংলার শিল্পীরা অবহেলিত ॥ অরূপরতন চৌধুরী

প্রকাশিত: ০৬:৫০, ১২ ডিসেম্বর ২০১৬

স্বাধীন বাংলার শিল্পীরা অবহেলিত ॥ অরূপরতন চৌধুরী

স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা কণ্ঠশিল্পী অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার জাদুকরী কণ্ঠ দিয়ে উজ্জীবিত করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের, সংগঠিত করেছিলেন লাখ লাখ শরণার্থীসহ সাধারণ মানুষদের। রবীন্দ্র সঙ্গীতের অমিয় ধারায় নিজেকে শক্ত করার পাশাপাশি চিকিৎসাসেবায় কাজ করে যাচ্ছেন নিয়ত। মাদকের বিরুদ্ধেও তার কণ্ঠ সোচ্চার। মুক্তিযুদ্ধ ও আজকের বাংলাদেশ নিয়ে গুণী এই শিল্পীর সঙ্গে কথা হয়। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিময় দিনগুলোর কথা বলুন.. অরূপরতন চৌধুরী ॥ আমার বয়স তখন ১৮ বছর। ঢাকা ডেন্টাল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। থাকতাম আজিমপুরের এক বাসায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় কিছু দুঃখ কিছু আনন্দ আমার স্মৃতিময়তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছে। ২৫ মার্চের রাতে পাক সেনাদের বর্বরতা শুরু হলে মা-বাবাকে না বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি। নীলক্ষেত থেকে একটি বাসে দাউদকান্দি ফেরিঘাটে পৌঁছে প্রথম স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করি পাক সেনাদের বর্বরতা। মুক্তিযোদ্ধাদের চোখ বেঁধে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে এবং ব্রাশ ফায়ার করে মেরে ফেলার দৃশ্য দেখে মনে হয়েছিল আমি বোধ হয় তাদের হাত থেকে আর রেহাই পাব না, কারণ সবাইকে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করে দেখে ধরে নিয়ে যাচ্ছে হত্যার জন্য। তাদের মধ্যে কেউ হয়ত ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাচ্ছে। আমিও সেই জায়গা থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া একজন। আমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। আমি অন্যকিছু না বুঝে সেখান থেকে এককভাবে পালিয়ে যাই। কিভাবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দেন? অরূপরতন চৌধুরী ॥ বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যদিয়ে কুমিল্লার আড়িখোলা গ্রামে পৌঁছে এক সেল্টার পাই। সেখানে থেকে আগরতলা বর্ডারের কাছে পৌঁছে যাই। দেখা হয় পরিচিত বেশ কয়েকজন ছাত্র নেতাদের সঙ্গে। সেখানের গ্রামবাসীদের সাহায্য সহানুভূতি দেখে মনে সাহস পেতে শুরু করি। পল্লিগীতির শিল্পী সরদার আলাউদ্দিনের নেতৃত্বে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন তৈরি হয়। ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের গান শুনিয়ে উজ্জীবিত করা এবং সাধারণ মানুষদের সাহস যোগানো ছিল আমাদের কাজ। পরে স্বাধীন বাংলা বেতারে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়ি। চলে যাই ধর্মনগর স্টেশনে, সেখান থেকে কলকাতা পৌঁছাই। পরে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও হাইকমিশনের তত্ত্বাবধানে আমাদের পাঠানো হয় কলকাতা ১৯’র ৫৭/৮ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে অবস্থিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। সেখানে দেখা হয় আপেল মাহমুদ, সমর দাস, রথীন্দ্রনাথ রায়সহ পরিচিত সবার সঙ্গে। সেখানে সবার সঙ্গে কোরাসে গান করতাম, প্রচার হতো বেতারে। শহীদুল ইসলাামের কথায়, হরলাল রায়ের সুরে ‘জ্বলছে জ্বলছে জ্বলছে প্রাণ আমার’ গানটি আমি ও নাসরীন আহম্মদ শীলু সারারাত ধরে রিহার্সাল করে ভোরে প্রচারের জন্য পাঠালাম। যখন স্বাধীন বাংলা বেতারে ঘোষণা হলো আমার ও আর শীলুর নাম তখন গর্বে বুক ভরে গেল। ‘বাংলাদেশ তরুণ শিল্পী গোষ্ঠী’ নামে কল্যাণী ঘোষের নেতৃত্বে একটি সংগঠনের হয়েও বিভিন্ন জায়গায় গান করতাম। আপনি কি মনে করেন স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পীদের যথাযথ মর্যাদা দেয়া হয়েছে? অরূপরতন চৌধুরী ॥ আমাদের বলা হয় স্বাধীন বাংলা বেতারের শব্দসৈনিক। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের সবাইকে সেভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু এক সময় আমাদের সবাইকে ডেকে বলেছিলেন, আমাদের সবার নাম ছবিসহ জাদুঘরে থাকবে কিন্তু এখনও পর্যন্ত রাখা হয়নি। আমি মনে করি স্বাধীনতা পদক ও একুশে পদক সবার আগে স্বাধীন বাংলা বেতারের সব শিল্পীদের দেয়া উচিত। তাহলে বুঝব কিছুটা হলেও তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। স্বাধীন বাংলার শিল্পীরা অবহেলিত। আমার পেশা ডাক্তারী, আমি হয়ত আর্থিকভাবে সচ্ছল আছি, কিন্তু অনেকে এখনও খুব কষ্টে আছে। আপনার বর্তমান ব্যস্ততার কথা বলুন.. অরূপরতন চৌধুরী ॥ গান আমার পেশা নয়, নেশা। আমার বেশ কয়েটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের এ্যালবাম বাজারে আছে। আগামী বছর আমি স্বাধীন বাংলা বেতারের সব গান নিয়ে একক একটি এ্যালবাম বের করব। এছাড়া রবীন্দ্রসঙ্গীতেরও একটি এ্যালবামের কাজ শুরু করব। গত বছর ‘স্বর্গ থেকে নরক’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছি। আগামী বছর ‘মাটির টানে’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করব। গৌতম পাণ্ডে
×