ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ব্যয়বহুল এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালাতে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা

প্রতিবন্ধী শিশুদের বাধা জয়ের অনন্য প্রতিষ্ঠান ‘প্রয়াস’

প্রকাশিত: ০৬:১৮, ১২ ডিসেম্বর ২০১৬

প্রতিবন্ধী শিশুদের বাধা জয়ের অনন্য প্রতিষ্ঠান ‘প্রয়াস’

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু-কিশোরদের জন্য ‘প্রয়াস’। ‘বিশেষ শিশু, বিশেষ অধিকার’-এই সেøাগান সামনে নিয়ে পরিচালিত প্রয়াস একটি বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেনা সহায়ক প্রতিষ্ঠানটি যেন একটি পরিবার। আর এ পরিবারে রয়েছে সাড়ে ৪শ’র বেশি সদস্য। সদস্যদের বিভিন্নভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পরম মমতা আর আদর দিয়ে গড়ে তুলছেন দুই শতাধিক শিক্ষক। তারা পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও সমাজের কাছে বোঝা হয়ে যাওয়া শিশুদের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। একই সঙ্গে বিশেষ শিশুদের জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও অঙ্গীকারাবদ্ধ। সেনাবাহিনী প্রয়াসকে চালিয়ে নিতে বড় অংকের টাকা সহযোগিতা করে আসছে। সরকারী অনুদান খুবই সামান্য। ওই টাকা দিয়ে এ বিশেষ প্রতিষ্ঠানটি চলে না। সমাজের বিত্তবানরাও এ প্রতিষ্ঠানে অনুদান দিয়ে আসছেন। রবিবার প্রয়াসের কার্যক্রম সম্পর্কে সংবাদকর্মীদের বিস্তারিত জানালেন নির্বাহী পরিচালক ও অধ্যক্ষ কর্নেল মোঃ শহীদুল আলম। অধ্যক্ষ কর্নেল শহীদুল আলম বলেন, প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য প্রতিষ্ঠিত প্রয়াস গত কয়েক বছরে বিশ্বমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালের অধীনে প্রয়াস পরিচালিত হয়। প্রতিষ্ঠানটি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত। এটি এখনও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। তবে আমাদের পক্ষ থেকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কিছু সুপারিশ পাঠানো হয়েছে। এখানে শিক্ষকদের বেতন খুবই কম। একজন শিশু-কিশোরের জন্য মাসে ১৫ হাজার টাকার খরচ হয়। এখানে সাড়ে ৪শ’ ছাত্রছাত্রী রয়েছে। আরও ৫শ’ শিশু-কিশোর ভর্তির জন্য আবেদন দিয়ে রেখেছে। এখানে সেনা সদস্য পরিবারের ৩৫ শতাংশ আর বেসামরিকদের জন্য ৬৫ শতাংশ ছাত্র ভর্তির ব্যবস্থা রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানে মাস্টার্স পর্যন্ত পড়ানো হয়। রয়েছে কারিগরি শিক্ষাও। ব্যয়বহুল এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালাতে প্রয়োজন সরকারের সুদৃষ্টি। বিশেষ শিক্ষা, প্রশিক্ষণ আর উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ পেলে তারাও হয়ে উঠতে পারে সমাজের আর দশজন মানুষের মতোই সৃষ্টিশীল ও কর্মক্ষম। প্রয়াস প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোরদের বাধা জয়ের অনন্য একটি প্রতিষ্ঠান। সারাদেশে প্রয়াসের দশটি শাখা রয়েছে। ভবিষ্যতে আরও শাখা বাড়ানোর পরিকল্পনাও আছে। এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, বিশ্বের জনসংখ্যার ১০-১৫ ভাগ মানুষ কোন না কোনভাবে প্রতিবন্ধী হযে জন্ম নিচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের জরিপে বলা হয়েছে, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু-কিশোরদের মাত্র ৪ ভাগ শিশু স্কুলে পড়ার সুযোগ পায়। ইউনেস্কোর হিসাবমতে, শতকরা ৪ প্রতিবন্ধী শিশু স্কুলে যাওয়ার উপযোগী হলেও তাদের পক্ষে স্কুলে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ২০০৬ সালের ১৮ জুলাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় অটিস্টিক বা প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে ‘সেনা সহায়ক স্কুল’ নামে প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা করে। পরে স্কুলটির নাম পরিবর্তন করে প্রয়াস করা হয়। এ স্কুলে প্রাথমিক পর্যায়ে সেনা পরিবারের মাত্র ২২ শিশু-কিশোর নিয়ে একটি ভাড়াবাড়িতে শিক্ষা কার্যক্রম চালানো হতো। ২০০৮ সালের ২১ নবেম্বর ঢাকা সেনানিবাসে ৫ দশমিক ৪৪ একর জায়গায় প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ভবন নির্মাণ কাজ শুরু হয়। প্রতিষ্ঠানটি নিজস্ব অর্থায়নে মাস্টার প্ল্যানের অংশবিশেষ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়। ২০০৯ সাল থেকে প্রয়াসে বেসামরিক পরিবার থেকেও ছাত্রছাত্রী ভর্তির উদ্যোগ নেয়া হলে রাতারাতি স্কুলে আসন সংখ্যার চেয়ে বেশি ছাত্রছাত্রী আবেদন করে। বিপুলসংখ্যক বিশেষ শিশু শিক্ষাগ্রহণ করে সমাজের স্বাভাবিক ধারায় যুক্ত হচ্ছে। বিশেষায়িত এ প্রতিষ্ঠানটি সেবামূলক। সুন্দর ও মনোরম পরিবেশে প্রয়াস অটিস্টিক শিশুদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকা সেনানিবাসে প্রয়াসের কার্যক্রম চলছে। এছাড়া ঢাকার বাইরে রংপুর, চট্টগ্রাম, যশোর, কুমিল্লা, সাভার, ঘাটাইল, সিলেট, রাজশাহী, রামু ও বগুড়া সেনানিবাসে প্রয়াসের শাখা রয়েছে। বিশেষায়িত এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সাধারণ স্কুল থেকে অনেকটাই ভিন্ন। ৫টি বিশেষায়িত কার্যক্রমের মাধ্যমে স্কুলটি চলছে। বিশেষায়িত ইন্টারভেনশন ক্লিনিক। এ কার্যক্রমের অধীনে রয়েছে মেডিক্যাল এ্যাসেসমেন্ট এ্যান্ড কেয়ার। নিউরোলজি এ্যাসেসমেন্ট, অডিওলজি পরীক্ষা, মনোবৈজ্ঞানিক টেস্ট ও ইইজি পরীক্ষা। সহায়ক থেরাপি সেবার আওতায় রয়েছেÑ স্পিচ ও ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি, সেনসরি ইন্ট্রিগেশন থেরাপি, ফিজিও থেরাপি, সুইমিং ও হাইড্রোথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি, আউটডোর, কাউন্সেলিং, বিহেভিয়ার থেরাপি ও ইয়োগা। প্রয়াসের প্রধান কার্যক্রম হচ্ছে প্রাক-শৈশবকালীন বিকাশমূলক কার্যক্রম (ইসিডিপি), বয়স্ক শিক্ষা ও বিনোদনমূলক কার্যক্রম, অটিজম বিদ্যালয়, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়, শ্রবণ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় ও শারীরিক এবং বহুবিধ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়। এছাড়া রয়েছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের নিয়মিত বিদ্যালয় (বাংলা ও ইংরেজী মাধ্যম) প্রত্যয় ইনক্লুসিভ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল (প্লে গ্রুপ থেকে ও’ লেভেল পর্যন্ত) ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ বিদ্যালয়। প্রয়াস স্পেশাল এডুকেশন এ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটে দক্ষ থেরাপিস্ট ও বিশেষ শিক্ষক-শিক্ষিকা তৈরির জন্য বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের অধিভুক্তি নিয়ে চার বছর মেয়াদী অনার্স প্রোগ্রাম, মাস্টার্স পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ও সার্টিফিকেট কোর্স চালু রয়েছে। নির্বাহী পরিচালক ও অধ্যক্ষ কর্নেল শহীদুল আলম বলেন, প্রয়াস ইনস্টিটিউট অব স্পেশাল এডুকেশন এ্যান্ড রিসার্চে বেশ কয়েকটি নতুন কারিকুলাম চালু করা হয়েছে। এ কার্যক্রম আগে দেশে ছিল না। এই কার্যক্রম চালু অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে করতে হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য এই প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করে এ দেশের বিশেষ শিক্ষাক্ষেত্রের পেশাজীবীদের ঘাটতি পূরণ করা। অনেক শিক্ষার্থী মূলধারার প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়েছে কিন্তু ওই স্কুলগুলো অনেক সময় এসব শিক্ষার্থীকে মানিয়ে নিতে পারে না। আমরা চাই সাধারণ স্কুলগুলোর মধ্যেও সচেতনতা তৈরি হোক। বিশেষ শিশুদের সব ধরনের সেবাই দেয়া হচ্ছে। প্রয়াসে ভর্তি প্রক্রিয়ায় ইন্টারভেনশন ক্লিনিকে মাল্টিডিসিপ্লিনারি টিমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের এ্যাসেসমেন্ট করা হয়। শিশুদের প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণের প্রয়োজনীয় সকল ধরনের পেশাজীবী শিশু বিশেষজ্ঞ ও নিউরোলজিস্ট, মনোবিজ্ঞানী, সাইক্রিয়াটিস্ট, অকুপেশনাল ও ফিজিও থেরাপিস্ট, স্পিচ ও ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্টসহ বিশেষ শিক্ষকের সমন্বিত টিম শিক্ষার্থীর সক্ষমতা ও দুর্বলতা এবং চাহিদাগুলো নির্ণয় করেন। এজন্য উপযোগী চিকিৎসা ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। শিশুটির জন্য চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম নির্ধারণ করা হয়। কিছুদিন নিবিড় পর্যবেক্ষণের পর ‘একক শিক্ষা পরিকল্পনা’ (আইইপি) তৈরি করে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে স্কুল কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বিদ্যালয় কার্যক্রমে রয়েছে ফাংশনাল একাডেমিক দৈনন্দিন কার্যক্রম প্রশিক্ষণ ও পাশাপাশি নিয়মিতভাবে সহশিক্ষা কার্যক্রমÑ গান, নাচ, ছবি আঁকা, সাঁতার। বর্তমানে প্রয়াসে ছাত্রছাত্রী রয়েছে ৪৯১। আর থেরাপিস্ট, ডাক্তার ও শিক্ষকসহ মোট স্টাফ ২৮৫। এখানে দুই থেকে ২২ বছর বয়সী যেকোন ধরনের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে স্বাস্থ্যসেবা, কর্মমুখী শিক্ষা এবং বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের কার্যক্রম। উপাধ্যক্ষ কাজী আফরোজা সুলতানা বলেন, এখানে শিক্ষার্থীদের জন্য মাথাপিছু খরচ হয় ১৫ হাজার টাকার মতো। এছাড়া সরকারের কাছ থেকে যে সহায়তা পাওয়া যায় তা দিয়ে প্রয়াসের শিক্ষকদের বেতনের আংশিক ব্যয় মেটানো সম্ভব হয়। শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। তিনি দেশের বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রয়াসের জন্য দীর্ঘমেয়াদী সহায়তার। যে কোন অনুদানের শতভাগ ব্যবহার এখানে নিশ্চিত করা হয়েছে। দেশের অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে দেশের অগ্রযাত্রার উন্নয়নে এগিয়ে নিতে সব মানুষের সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। একজন বিশেষ শিশুকে সামগ্রিক সেবা দিতে হলে প্রয়োজন বহুমুখী আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম। এগুলোর সংযোজনে প্রয়োজন আর্থিক সচ্ছলতা। প্রয়াসে রয়েছে সাংস্কৃতিক কর্মকা- ও খেলাধুলা। প্রয়াসের শিক্ষার্থীরা ইতোমধ্যে দেশ-বিদেশে সুনাম অর্জন করেছে। ২০০৭ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত স্পেশাল অলিম্পিকসে অংশ নিয়ে প্রয়াসের শিক্ষার্থীরা ২৬ স্বর্ণ, ১৫ রৌপ্য ও ৪ ব্রোঞ্জপদক অর্জন করে বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। জাতীয় সব ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে নিয়মিত অংশ নিয়ে আসছে প্রয়াসের শিক্ষার্থীরা। প্রয়াসে কর্মরত শিক্ষকদের কাজের দক্ষতা উন্নয়নে নিয়মিত দেশ ও বিদেশের প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের সম্পর্কে জানার জন্য দেশ-বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ বিভিন্ন সময় প্রয়াস পরিদর্শন করে গেছেন।
×