ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গোবিন্দগঞ্জ ও নাসিরনগরের ঘটনার ওপর নির্মূল কমিটির সরেজমিন প্রতিবেদন

আইনের সীমাবদ্ধতায় ন্যায়বিচার পাচ্ছে না নির্যাতিত সংখ্যালঘুরা

প্রকাশিত: ০৬:১৮, ১২ ডিসেম্বর ২০১৬

আইনের সীমাবদ্ধতায় ন্যায়বিচার পাচ্ছে না নির্যাতিত সংখ্যালঘুরা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের ওপর হামলার ঘটনায় স্থানীয় সংসদ সদস্য ও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জড়িত বলে তথ্য পেয়েছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির তদন্ত দল। আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে আওয়ামী লীগ নেতাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে কাজে লাগিয়ে বিএনপি, জামায়াত, হেফাজত ও মৌলবাদী গোষ্ঠী হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির ও বাড়িঘর ভাঙচুর-লুটপাট করে সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় বলে তারা মনে করছে। রবিবার দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে ‘নাসিরনগর ও গোবিন্দগঞ্জের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীজনিত নিরাপত্তা সঙ্কট’ সম্পর্কিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জামায়াতের উপস্থিতি ও প্রচলিত আইনের সীমাবদ্ধতার কারণে সহিংসতার সঙ্গে জড়িতদের বিচার হচ্ছে না। ন্যায়বিচার পাচ্ছে না নির্যাতিত সংখ্যালঘুরা। নাসিরনগরে হামলার ও গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের ওপর হামলার দুই ঘটনায় ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সরেজমিন একটি প্রতিবেদন তৈরি করে তা প্রকাশ করে। নির্মূল কমিটির সরেজমিন প্রতিবেদনে নাসিরনগরের এমপি মৎস্য ও প্রাণীসম্পদমন্ত্রী ছায়েদুল হকের সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপির বিরোধের বিষয়ও তুলে ধরা হয়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনায় একটিরও বিচার না হওয়ায় এ ধরনের ঘটনা বার বার ঘটছে বলেও মনে করে সংগঠনটি। শাহরিয়ার কবির আরও বলেন, আমরা ‘সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন’ প্রণয়নসহ জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন এবং আলাদা সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠনের দাবিতে আইনমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিয়েছি। কিন্তু কোন অগ্রগতি হয়নি। জামায়াত প্রভাবিত প্রশাসনের কারণে ২০১২ সালে রামুতে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা যায়নি। হামলাকারী যে দলেরই হোক না কেন, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি আমরা দাবি করেছিলাম। দাবি করেছিলাম তাদের সম্পত্তি যেন বাজেয়াফত করা হয়। কিন্তু কোনটাই তো হয়নি। বরং তারা পুলিশের দুর্বল চার্জশিটের কারণে সবাই জামিনে বেরিয়ে গেছে। হামলার শিকাররা মামলা প্রত্যাহারও করে নেয়। আমরা একই দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি নাসিরনগর ও গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে। তিনি বলেন, গোবিন্দগঞ্জে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও বিচারপতি শামসুল হুদার নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটি ও ১৮ সদস্যের জেলা কমিটি পাঠিয়েছিলাম। সেখানে গণশুনানি করেছি। হামলার শিকারদের নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান ও কম্বল বিতরণ করেছি। রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে শাহরিয়ার কবির বলেন, পাকি-জামায়াত মিলে রোহিঙ্গাদের ব্যবহারের চেষ্টা করছে। জামায়াত রোহিঙ্গাদের তালিকা করে জিহাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করছে। ইসলামী ব্যাংক এই জিহাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে উল্লেখ করে তিনি অবিলম্বে সরকারকে ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এটিকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক হিসেবে ঘোষণা দেয়ার দাবি জানান। ব্যাংকটিকে জামায়াতের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার দাবিও জানান তিনি। পাশাপাশি জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবিও জানান শাহরিয়ার কবির। রোহিঙ্গা সমস্যা সাম্প্রতিক বিশ্বের একটি বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় উল্লেখ করে শাহরিয়ার কবির বলেন, জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বুঝাতে হবে এটি বাংলাদেশের একার পক্ষে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা শুধু বাংলাদেশে আসছে না তারা ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। তিনি মনে করেন মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিকভাবে এবং ভারত-চীন থাইল্যান্ডের মতো প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে অর্থপূর্ণ আলোচনা করা প্রয়োজন। সাবেক বিচারপতি শামসুল হুদা বলেন, নাসিরনগর-গোবিন্দগঞ্জের ঘটনার নেপথ্য কারণ উদ্বেগজনক। গোবিন্দগঞ্জের হামলায় এমপি ও চেয়ারম্যানের জড়িত থাকার বিষয়টি ছিল স্পষ্ট। আবু হোসেন সরকারের আমলে যে চুক্তিতে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে- আখ চাষ না হলে সে জমির মালিকদের ফেরত দিতে হবে। কিন্তু দেয়া হচ্ছে না। বাগদা ফার্মের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা কি বাংলাদেশ-ইন্ডিয়ার বর্ডার, যে তারকাঁটা দিয়ে বেড়া দিতে হবে। এটা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান রেখে শামসুল হুদা আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে আমি ‘মা’ বলে সম্বোধন করি। তিনি আমার যেমন মা সাঁওতালদেরও মা। তাই তাদের রক্ষায় যা করণীয় তার ব্যবস্থা নেবেন। নির্মূল কমিটির সহসভাপতি সাবেক বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম বলেন, সাম্প্রদায়িক হামলা হলে সেটা ফৌজদারি অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয় না। এ জন্য পৃথক আইন দরকার। সংবাদ সম্মেলনে মানবাধিকার কর্মী এ্যারোমা দত্ত বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী চক্র এ ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলায় প্রথম সারিতে থাকে। আজকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল ক্ষমতায়; তাও এ ধরনের ঘটনা তারা ঘটাচ্ছে। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুলের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অন্যাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কলামিস্ট মাহবুবুর রশিদ ও ব্যারিস্টার নাদিয়া চৌধুরী।
×