ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

একাত্তরের পোস্টার লিফলেট

অবরুদ্ধ সময়ের জোরালো ভাষা, মুক্তিযুদ্ধের অনন্য দলিল

প্রকাশিত: ০৬:১৮, ১২ ডিসেম্বর ২০১৬

অবরুদ্ধ সময়ের জোরালো ভাষা, মুক্তিযুদ্ধের অনন্য দলিল

মোরসালিন মিজান ॥ মুক্তিযুদ্ধের বিরাট ইতিহাস। বহু মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে। তবে পোস্টার-লিফলেট নিয়ে আলোচনা কমই হয়। অথচ অন্যসব আন্দোলন সংগ্রামের মতো একাত্তরেও দারুণ কার্যকরী ভূমিকা রেখেছিল অল্প কথার প্রচারপত্র। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রকাশনা বাঙালীর স্বাধীনতা দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরে। জনমত গঠনে রাখে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আর বর্তমানে এগুলো মুক্তিযুদ্ধের দলিল। অমূল্য স্মারক। জানা যায়, একাত্তর সালে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে জোরালো ভাষা পেয়েছিল লিফলেট পোস্টার। ব্যক্তিগতভাবে বা বিভিন্ন সংঘ সমিতির উদ্যোগে এগুলো প্রকাশ ও প্রচার করা হয়। তবে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল বাংলাদেশ সরারের তথ্য ও প্রচার দফতরের কাজগুলো। সরকারীভাবে প্রকাশিত পোস্টার লিফলেটের একটি উল্লেখযোগ্য সংগ্রহ এখন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। সংরক্ষণের পাশাপাশি এগুলো নতুন করে ছাপানো হচ্ছে। একাত্তর সালে এসব পোস্টার বিভিন্ন মাপে বিভিন্ন ধরনের কাগজে বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রকাশ ও প্রচার করা হয়। কখনও রঙ্গিন, কখনও সাদা-কালো ছাপা। মুক্তিযুদ্ধের সময় সারাদেশে এসব লিফলেট পোস্টার ছড়িয়ে দেয়া হয়। চলে যায় বহিঃবিশ্বেও। কলকাতা ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন শহরের দেয়ালে দেয়ালে, বাসের গায়ে লেপটে ছিল বাঙালীর প্রতিবাদ। মুক্তিযোদ্ধা, সংগঠক, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক সকেলই লিখিত বাণী বার্তা বহন করেছেন। জানা যায়, ভারতের কলকাতায় অবস্থিত দফতর থেকে বহু পোস্টার লিফলেট প্রকাশ ও প্রচারের উদ্যোগ নেয়া হয়। কলকাতায় পাড়ি জমানো শিল্পীরা এ কাজের পুরোভাগে ছিলেন। বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রচার বিভাগের প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন বরেণ্য শিল্পী কামরুল হাসান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, নিতুন কু-ু, জহির আহমদ প্রমুখ। সকলেই মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে পোস্টার আঁকার কাজ করেন। এসব পোস্টারে জরুরী বার্তা বাণী ছাড়াও ছিল ক্যারিকেচার। অগণিত লিফলেট পোস্টারের কিছু এখনও বিভিন্ন জায়গায় সংরক্ষিত আছে। স্বতন্ত্র ভাষায় সেগুলো তুলে ধরছে মুক্তিযুদ্ধ ও এর জানা অজানা অল্প জানা ইতিহাসকে। একাত্তর সালে প্রকাশিত পোস্টারগুলোর ভাষা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হচ্ছিল বাঙালীর মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। একাধিক পোস্টারে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। বজ্রবাণী। একটি খুব দেখা পোস্টারের পুরোটা জুড়ে মুজিবের প্রতিকৃতি। তর্জনী উঁচিয়ে বাঙালীর উদ্দেশে অবিসংবাদিত নেতা বলছেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম... রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেবো... ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো।’ ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে গুরুত্বপূর্ণ এসব নির্দেশনা দিয়েছিলেন শেখ মুজিব। তাঁর ভাষণ মুক্তিকামী মানুষকে আন্দোলিত করেছিল। সাহস যুগিয়েছিল। পোস্টারটি সে কথাকেই আবার সামনে আনে। স্মরণ করিয়ে দেয়, কার ডাকে নয় মাস সশস্ত্র সংগ্রাম করেছিল বাঙালী। কে ছিলেন স্বাধীনতার মহানায়ক। ‘জয় বাংলাদেশ জয় মুক্তিবাহিনী’ শিরোনামের একটি লিফলেটে বঙ্গবন্ধুর উদ্ধৃতি। সেখানে তিনি প্রচ- আত্মবিশ্বাস নিয়েই বলছেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তির অদম্য স্পৃহাকে কিছুতেই নিভিয়ে দেওয়া যাবে না। আমাদের ভবিষ্যত বংশধরেরা যাতে স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে সম্মানের সাথে স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারে তার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য আমরা সবাই প্রয়োজন হলে জীবন দিতে প্রস্তুত। যতদিন পর্যন্ত না আমরা আমাদের মুক্তির লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হচ্ছি ততদিন আমাদের সংগ্রাম চলতেই থাকবে।’ অন্য একটি পোস্টারের শিরোনাম ‘আমাদের লক্ষ্য।’ সেখানে বাঙালী নেতার বাণী তুলে ধরে বলা হয়, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় সংকল্পবদ্ধ মানুষের কাছে অত্যাচারী শক্তি পরাজিত ও পরাভূত হতে বাধ্য। বেশকিছু প্রচারপত্রে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বার্তা। ‘পাকিস্তান আজ মৃত’ শিরোনামে ছাপা পোস্টারে প্রধানমন্ত্রী বলছেন, পূর্বপরিকল্পিত হণহত্যার আশ্রয় নিয়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খান নিজ হাতে পাকিস্তানের কবর খুঁড়েছে, এ কথা তার বোঝা উচিত।’ যুদ্ধ জয়ের ব্যাপারে বাঙালীর আত্মবিশ্বাস কত প্রবল ছিল তাও বোঝা যায় প্রচারপত্র থেকে। ‘বিজয় আমাদেরই’ শিরোনামে ছাপানো প্রচারপত্রে বঙ্গবন্ধুর প্রতিধ্বনি করে তাজউদ্দীন বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ আজ একটি বাস্তব সত্য। পৃথিবীর কোন শক্তিই এই নতুন জাতিকে বিলোপ করতে পারবে না। দু’দিন আগেই হোক বা পরেই হোক পৃথিবীর ছোট বড় সকল শক্তিই বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিম-লে অবশ্যই স্থান দেবে। পোস্টারই বলে দেয় মুক্তিযুদ্ধ কেন অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। যুদ্ধ চলাকালীন প্রকাশিত তেমন একটি পোস্টারে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিমাদের বৈষম্যমূলক নীতি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়। পোস্টারের উপরের অংশে বড় করে লেখা ‘সোনার বাঙলা শ্মশান কেন।’ আর নিচে দেখানো হয় প্রতিটি খাতে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় কত কম বরাদ্দ পেয়ে আসছিল পূর্ব পাকিস্তান। বরাদ্দের অঙ্ক পাশাপাশি লিখে তুলনামূলক আলোচনার সূত্রপাত করা হয়। এভাবে পোস্টারটির দিকে কিছু সময় তাকাতেই স্পষ্ট হয়ে যায় কিভাবে শ্মশানে পরিণত হয়েছিল বাংলা। বেশকিছু পোস্টার পাকিস্তানী বাহিনীর নৃশংসতা সম্পর্কে ধারণা দেয়। খুব আলোচিত একটি পোস্টারে ইয়াহিয়া খানকে উপস্থাপন করা হয় নরপশুর চেহারায়। এই বর্বর জেনারেলের নির্দেশে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত হয়েছিল পৃথিবীর ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকা-। ইয়াহিয়ার দিকে তাকিয়ে তাই শিল্পী কামরুল হাসান মানুষের মুখ দেখেননি। জানোয়ার দেখেছিলেন। ইয়াহিয়ার ভয়ঙ্কর রূপ প্রকাশে তার দাঁত ও চোখ তিনি এঁকেছিলেন লাল রঙে। বাকি অংশে ব্যবহার করেছিলেন কালো রং। উপরে নিচে লিখেছিলেন, ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে।’ মাত্র দুই রঙে সহজ করে আঁকা ক্যারিকেচারটি পরে শুধু ইয়াহিয়ার নয়, পাকিস্তানের সকল জালিমের স্বরূপ হয়ে উঠেছিল। বিদেশী বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও উন্মাদ জেনারেলের সমালোচনা হয়। সেই সমালোচনার কথা জানায় একাত্তরের পোস্টার। ভেনিজুয়েলার ক্যাথলিক দৈনিক দি রিলিজিয়ন অব ক্যারাকাস’র বক্তব্য তুলে ধরে প্রকাশিত একটি পোস্টারের বক্তব্য এ রকমÑ ‘এই বীভৎস নিধনযজ্ঞ, এই নৃশংসতম হত্যাকা-ের সামনে অন্য সব নৃশংসতাই ম্লান হয়ে গেছে। গণহত্যা ও ধ্বংসলীলার কলঙ্কময় ইতিহাস খুঁজলে হিটলারের নিধন শিবির অথবা চেঙ্গিস খান বা তৈমুর লঙের নৃশংসতার কাহিনীতেও এরূপ হত্যাকা-ের মিল পাওয়া দুষ্কর হবে।’ বক্তব্যের সঙ্গে মিল রেখে পোস্টারে ইয়াহিয়ার ক্যারিকেচার করেন কামরুল হাসান। এতে দেখা যায় বাঙালীর অসংখ্য কঙ্কালের ওপর দাঁড়িয়ে আছে পাকিস্তানী জেনারেল। মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন আর সাহসের কথাও জানা যায় পোস্টার লিফলেট থেকে। শিল্পী নিতুন কু-ুর আঁকা একাধিক পোস্টারে মুক্তিযোদ্ধার মুখ। এই মুখ সাহসী। দেশ রক্ষার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত। শিল্পী তাই ছবির নিচে লিখে দেন, ‘সদাজাগ্রত বাংলার মুক্তিবাহিনী।’ এই বাহিনী কাদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল তা জানা যায় আরেকটি পোস্টার থেকে। সেখানে লেখা রয়েছে, ‘বাংলাদেশের কৃষক শ্রমিক ছাত্র যুবক সকলেই আজ মুক্তিযোদ্ধা।’ পতাকার লাল সবুজে লেখা অন্য একটি পোস্টারে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার আহ্বান জানিয়ে লেখা হয়, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করুন। এরা আপনাদেরই সন্তান।’ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ধর্ম থাকবে কি-না, থাকলে সেটি কী হবে তারও উল্লেখ পাওয়া যায় পোস্টারে। একটি পোস্টারে সকল ধর্মের উপাসনালয়ের ছবি পাশাপাশি আঁকা। তাতে ঘোষণা দিয়ে বলা হয়Ñ ‘বাংলার হিন্দু/বাংলার খ্রীস্টান/ বাংলার বৌদ্ধ/ বাংলার মুসলমান/ আমরা সবাই বাঙালী।’ এভাবে পোস্টার-লিফলেট-প্রচারপত্রগুলো স্বতন্ত্র ভাষায় মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরে। হয়ে ওঠে সময়ের অনন্য দলিল। পোস্টারগুলো বাঙালীকে অতীতে যেমন নিয়ে যায়, তেমনি দাঁড় করায় আজকের বাস্তবতার সামনে। পোস্টার লিফলেটের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডাঃ সারওয়ার আলী জনকণ্ঠকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নানা মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা হয়েছে। একই প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় পোস্টার লিফলেটে। যুদ্ধদিনের অনেক খুঁটিনাটি এ মাধ্যমে উঠে এসেছে। আজকের দিনে প্রকাশনাগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্মারক। আগামী প্রজন্মের কাছে পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বরতার ইতিহাস তুলে ধরতে এগুলো বিশেষ কাজে আসছে বলে জানান তিনি। একই প্রসঙ্গে বরেণ্য শিল্পী হাশেম খান বলেন, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী শিল্পীরা একাত্তরে নিজেদের করণীয় ঠিক করেছিলেন। সে অনুযায়ী লিফলেট পোস্টার ইত্যাদি আঁকার কাজ করেছিলেন তারা। শিল্পকর্মগুলো দেখার মধ্য দিয়ে সময়কে দেখা যায় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
×