ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পলায়নপর ৩ পাকি সেনাকে আটক করি ॥ জানালেন বীর মুক্তিযোদ্ধা রব

বাটাজোরের সম্মুখযুদ্ধে ৭ পাকসেনাকে হত্যা করি আমরা

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ১২ ডিসেম্বর ২০১৬

বাটাজোরের সম্মুখযুদ্ধে ৭ পাকসেনাকে হত্যা করি আমরা

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ স্বাধীনতা যুদ্ধের উত্তাল মুহূর্তে ২১ অক্টোবর সন্ধ্যায় ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের গৌরনদীর বাটাজোর নামকস্থানে এ্যাম্বুশে থাকা পাক সেনাদের সঙ্গে ৯নং সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা নিজাম বাহিনীর সম্মুখযুদ্ধ শুরু হয়। ওই যুদ্ধে আমিসহ ৩২ মুক্তিযোদ্ধা নিজাম উদ্দিন আকনের নেতৃত্বে অংশগ্রহণ করি। সারারাতের যুদ্ধে পাকসেনারা পরাস্ত হওয়ার পর ভোরে পাকসেনাদের অবস্থান নেয়া জায়গায় গিয়ে দেখতে পাই সাতজন পাকসেনা গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা গেছে। ওই যুদ্ধে আমাদের তিন সহযোদ্ধাও শহীদ হন। পরবর্তী সময়ে স্থানীয় গভীর জঙ্গলের মধ্যদিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় অস্ত্রবিহীন তিন পাক সেনা সুবেদার শরীফ খান বেলুচী, সিপাহী নাসির খান পাঞ্জাবী ও সিপাহী ফিরোজ খান বিহারিকে আমি একাই আটক করি। পরে তাদের (পাক সেনাদের) স্বীকারোক্তি মতে, বাটাজোর সিএ্যান্ডবি রোডের কাছ থেকে তিনটি বেটাগান ও কিছু গুলি উদ্ধার করি। পরবর্তীতে আটক পাকসেনাদের আমাদের সাব সেক্টর কমান্ডার নিজাম উদ্দিনের কাছে সোপর্দ করি। ওই যুদ্ধে আমার সহকর্মী মুক্তিযোদ্ধা কাঞ্চন সিকদার একটি পা হারিয়ে গুরুতর আহত হয়ে আজও পঙ্গু অবস্থায় বেঁচে আছেন। কাঞ্চনের পা হারানোর ওই মুহূর্ত আমাকে আজও পীড়া দেয়। মহান বিজয়ের মাসে যুদ্ধদিনের কথা জনকণ্ঠের কাছে এভাবেই বর্ণনা করেন বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বার্থী ইউনিয়নের ধানডোবা গ্রামের মরহুম মিলন হাওলাদারের ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আনসার কমান্ডার এমএ রব। একান্ত আলাপে তিনি বলেন, আনসার বাহিনীর একজন দক্ষ কর্মী হিসেবে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে শেষপর্যন্ত আমি নয়টি স্থানে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। সর্বশেষ ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর জীবনবাজি রেখে সরকারী গৌরনদী কলেজের পাকবাহিনীর ক্যাম্পে ৯নং সেক্টরের গ্রুপ কমান্ডার নিজাম উদ্দিন আকন ও আমি প্রবেশ করে ক্যাম্পে অবস্থানরত ১৪৭ পাকসেনাকে আটক করে মিত্র বাহিনীর কাছে সোপর্দ করি। এমএ রবের বয়স বেড়ে যাওয়ায় নানারোগে আক্রান্ত হলেও আজও তার মনে রয়েছে কঠিন জোর। আনসার বাহিনীর একজন দক্ষ প্যারেড কমান্ডার হিসেবে তিনি এখনও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে আসছেন। বলেন, বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে দেশমাতৃকার টানে আনসার বাহিনীর একজন সদস্য হিসেবে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথমে আমি গৌরনদী কলেজ মাঠের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে অংশগ্রহণ করি। পরবর্তীতে অস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের পিপা ক্যাম্পে (পলাশীর আমতলা ক্যাম্প) যাই। সেখান থেকে মেজর এমএ জলিল আমাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য বিহার চাকুলিয়া স্টেশন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে একমাস বিভিন্ন অস্ত্রের প্রশিক্ষণ, কলাকৌশল গ্রহণের পর ৯নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর এমএ জলিল বেগুনদিয়া হেড কোয়ার্টার থেকে অস্ত্রসহ নিজাম উদ্দিনকে সাব সেক্টর কমান্ডার ও আবু তাহেরকে সহকারী কমান্ডার করে ওই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর আমাদের ৬৫ জনের একটি গ্রুপকে দেশে পাঠায়। আমরা গ্রুপসহকারে দেশে ফেরার পথে যশোরের আড়পাড়ায় পৌঁছলে পাকসেনাদের সঙ্গে প্রথম যুদ্ধ হয়। ওই যুদ্ধে অনেক পাকসেনা নিহত হয়। একপর্যায়ে পরাস্ত পাকসেনা ও তাদের দোসর এ দেশের রাজাকাররা পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে গৌরনদীর মাহিলাড়া ব্রিজের ওপর পাকবাহিনীর সঙ্গে আমাদের গ্রুপের সম্মুখ যুদ্ধে অনেক পাকসেনা হতাহতের পর ওই এলাকার পাক সেনাদের ব্যাংকার মুক্ত করি। হোসনাবাদ এলাকায় পাকবাহিনীর লঞ্চে হামলা চালিয়ে অসংখ্য পাকসেনাদের হত্যা করে তাদের অস্ত্র উদ্ধার করি। ওই বছরের ২১ অক্টোবর সন্ধ্যায় ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের গৌরনদীর বাটাজোর নামকস্থানে এ্যাম্বুসে থাকা পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা নিজাম উদ্দিন আকনের নেতৃত্বে কাঞ্চন সিকদার, আলাউদ্দিন, ফতে আহমেদ, লালচাঁন ফকির, আনোয়ার হোসেন, নুরুল হক, রশিদ হাওলাদার ও আমিসহ ৩২ জন যোদ্ধা অংশগ্রহণ করি। সারারাতের যুদ্ধে পাকসেনারা পরাস্থ হওয়ার পর ভোরে পাকসেনাদের অবস্থান নেয়া জায়গায় গিয়ে আমি দেখতে পাই সাতজন পাকসেনা গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা গেছে। ওই যুদ্ধে আমাদের তিন সহযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধাও শহীদ হয়। পরবর্তীতে ওইদিন ভোরে স্থানীয় গভীর জঙ্গলের মধ্যদিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় অস্ত্রবিহীন তিন পাকসেনা সুবেদার শরীফ খান বেলুচী, সিপাহী নাসির খান পাঞ্জাবী ও সিপাহী ফিরোজ খান বিহারিকে আমি একাই আটক করি। পরে তাদের (পাকসেনাদের) স্বীকারোক্তি মতে, বাটাজোর সিএ্যান্ডবি রোডের কাছ থেকে তিনটি বেটাগান ও কিছু গুলি উদ্ধার করি। পরবর্তীতে আটককৃত পাকসেনাদের সাব সেক্টর কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা নিজাম উদ্দিনের কাছে সোপর্দ করি। ওই যুদ্ধে আমার সহকর্মী মুক্তিযোদ্ধা কাঞ্চন সিকদার গুরুতর আহত হয়ে একটি পা হারিয়ে আজও পঙ্গু অবস্থায় বেঁচে আছেন। মুক্তিযোদ্ধা এমএ রব আরও বলেন, টরকী বন্দরের সাবেক ন্যাশনাল ব্যাংকে পাহারারত রাজাকার ও পুলিশ ক্যাম্পে আমরা একাধিক হ্যান্ড গ্রেনেড চার্জ করে ২১টি রাইফেল ও বিপুল পরিমাণ গুলি উদ্ধার করি। ওই বছরের ১৩ কার্তিক কসবা গো-হাট সংলগ্ন ব্রিজের ওপর ব্যাংকার করে পাহারারত পাক সেনাদের সঙ্গে আমাদের গ্রুপের তুমুল যুদ্ধ হয়। ওই যুদ্ধে আমি যেখানে এ্যাম্বুশে ছিলাম তার মাত্র পাঁচ হাত দূরত্বে থাকা আমাদের গ্রুপ কমান্ডার আব্দুস সাত্তার পাক সেনাদের একাধিক বুলেটে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। পরবর্তীতে বরিশালের সকল মুক্তিযোদ্ধা একত্রিত হয়ে বরিশাল ওয়াপদা স্থায়ী ক্যাম্প করা পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ করি। ওদিন ওয়াপদা ক্যাম্পের পাকসেনারা পরাস্ত হয়ে বরিশাল ছেড়ে পালিয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সারাদেশে বিজয় ঘোষণা করা হলেও সে সময়েও গৌরনদী কলেজে স্থায়ী ক্যাম্প করা পাক সেনারা আত্মসমর্পণ করেনি। আমরা (মুক্তিযোদ্ধা)সহ মুজিববাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েতবাহিনীর সদস্যরা কলেজের চারদিক থেকে ঘিরে পাকসেনাদের কলেজের ক্যাম্পে যৌথ আক্রমণ শুরু করি। তখনও যুদ্ধ চলতে থাকে। একপর্যায়ে ওই ক্যাম্পে অবস্থান নেয়া পাকসেনারা ২১ ডিসেম্বর হ্যান্ড মাইকের সাহায্যে আত্মসমর্পণের ঘোষণা করে। পরবর্তীতে ২২ ডিসেম্বর নিজের জীবন বাজি রেখে সরকারী গৌরনদী কলেজের পাকবাহিনীর ক্যাম্পে ৯নং সেক্টরের গ্রুপ কমান্ডার নিজাম উদ্দিন আকন ও আমি প্রবেশ করে ক্যাম্পে অবস্থানরত ১৪৭ পাকসেনাকে আটক করে মিত্র বাহিনীর কাছে সোর্পদ করি। ২৩ ডিসেম্বর আমরা বরিশালে কর্মরত প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে ২৫ ডিসেম্বর বরিশাল প্রতাপপুর ক্যাডেট কলেজে বরিশাল অঞ্চলের সকল মুক্তিযোদ্ধাবাহিনীর সদস্যরা একত্রিত হই। সেখানে বসে ক্যাপ্টেন সামসুদ্দিন খান আমাদের প্রত্যেককে ৫০ টাকা করে দিয়ে সবাইকে স্বস্ব থানার ন্যাশনাল মিলিশিয়া ক্যাম্পে যোগদানের জন্য পাঠিয়ে দেয়। পরবর্তীতে ন্যাশনাল মিলিশিয়া ক্যাম্পে যোগদান করে আমি ১৯৩ মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে গঠিত বি-কোম্পানির টু-আইসি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করি। ১০ জানুয়ারি স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরে তার ভাষণ শুনে আমি ঘরে ফিরে আসি। গৌরনদীর ইউএনওর দেয়া এক প্রত্যয়নপত্র থেকে জানা গেছে, বীর মুক্তিযোদ্ধা এমএ রব একজন দক্ষ আনসার কমান্ডার হিসেবে ৫ ফেব্রুয়ারির পরবর্তী সময়ে বিএনপি ও জামায়াতের নাশকতা প্রতিরোধে জননিরাপত্তায় বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের ৩নং ক্যাম্পের ইনচার্জের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ১০টি ক্যাম্পে তীক্ষè নজর রেখে ব্যাপক সফলতা ও সুনাম অর্জন করেছেন। তার এ সাহসী ও প্রশংসনীয় কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ আনসার বাহিনীর জেলা সমাবেশে তাকে (এম.এ রব) সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। এ দক্ষ সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আনসার কমান্ডারকে আজীবন সম্মাননা এবং তার পুনর্বাসনের জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসার সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্মকর্তাদের কাছে জোর সুপারিশও করেছেন।
×