ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রিজার্ভ চুরির বিষয়ে সিআইডির তথ্য

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ডিজিসহ অনেক কর্মকর্তা জড়িত

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১১ ডিসেম্বর ২০১৬

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ডিজিসহ অনেক কর্মকর্তা জড়িত

গাফফার খান চৌধুরী ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির সঙ্গে ২৭ জন বিদেশীর জড়িত থাকার তথ্য মিলেছে। জড়িত বিদেশীদের মধ্যে ২৩ জন মাঠপর্যায়ে থেকে চুরি করা টাকা একত্রিত করে। তাদের শনাক্ত করা হয়েছে। এরপর তা তুলে দেয় চুরির মূলহোতা হিসেবে প্রাথমিকভাবে শনাক্ত হওয়া চার বিদেশীর হাতে। এই চার বিদেশীকে শনাক্ত করা সম্ভব হলেই মামলাটির তদন্ত প্রক্রিয়া অনেকটাই শেষ হয়ে যাবে। জড়িত ২৭ জন বিদেশী এবং মামলাটির বহু আলামত বিশ্বের ১১টি দেশে রয়েছে। সেসব দেশকে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। দেশগুলো বাংলাদেশকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছে। এছাড়া রিজার্ভ চুরির সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রযুক্তি বিভাগের একজন ডেপুটি গবর্নরসহ বিভাগটির অনেক কর্মকর্তাও জড়িত। বাংলাদেশ ব্যাংকের যারা জড়িত, তাদের একটি তালিকা তদন্তকারী সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকে দিয়েছে। সেই সঙ্গে যেসব প্রযুক্তিগত দুর্বলতার কারণে রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি ঘটেছে, তাও জানানো হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যেই প্রযুক্তিগতভাবে সুরক্ষিত হয়েছে। রির্ভাজ চুরির ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। প্রসঙ্গত, চলতি বছরের গত ১৫ মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের জমা রাখা টাকার মধ্যে ৮শ’ কোটি টাকা চুরির ঘটনায় মতিঝিল থানায় একটি মামলা দায়ের হয়। মামলার এজাহারে কাউকে অভিযুক্ত করা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব ও বাজেট বিভাগের যুগ্মপরিচালক জোবায়ের বিন হুদা মামলাটি দায়ের করেন। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে মামলাটি দায়ের করা হয়। মামলাটির তদন্ত করছে সিআইডি। এ ব্যাপারে মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা সিআইডির সংঘবদ্ধ অপরাধ বিভাগের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক শাহ আলম জনকণ্ঠকে বলেন, ১৯৯৯ থেকে ২০১৫ সালের এপ্রিলের প্রথম দিক পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রযুক্তিগত দিক খুবই শক্তিশালী ছিল। তখন কাটআউট পদ্ধতিতে রিজার্ভ মেইনটেইন করা হতো। অর্থাৎ রিজার্ভ সার্ভারের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর কোন সার্ভার যুক্ত ছিল না। অন্যকোন সার্ভার থেকে রিজার্ভ সার্ভারে প্রবেশের কোন পথ ছিল না। শুধুমাত্র রিজার্ভ সার্ভারটি সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে যুক্ত থাকত। এতে রিজার্ভ অনেক নিরাপদ ছিল। কারণ বাংলাদেশের রিজার্ভ সংক্রান্ত কোন তথ্য ফেডারেল ব্যাংকের অন্যকোন বিভাগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যকোন বিভাগের জানার সুযোগ ছিল না। কিন্তু ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময় সুইফটের তরফ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি বিভাগকে আরও উন্নত করতে কাজ করে। ওই সময় ব্যাংকের প্রায় পাঁচ হাজার কম্পিউটার একটি সিস্টেমের মধ্যে নিয়ে আসা হয়। আর তাতেই অর্থ চুরির পথ সহজ হয়। ওই সময় সুইফটের তরফ থেকে একটি বিশেষ চিপও দেয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংককে। চিপটি ব্যাংকের ভল্টে রাখার নিয়ম। যখন কাজ করবে, তখন চিপ লাগিয়ে কাজ করবে। এরপর খুলে তা ভল্টে জমা করে রাখার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি বিভাগ চিপটি সব সময়ই লাগিয়ে রাখত। এতে হ্যাকাররা ম্যানুয়াল ও ম্যাসেজ পাঠিয়ে রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরি করে। অর্থ চুরির আগে মাত্র ৫শ’ ডলার দিয়ে রিজাল ব্যাংকে এ্যাকাউন্ট খুলে হ্যাকররা। তারা স্বল্প সময়ের মধ্যেই এ্যাকাউন্টে বড় অঙ্কের টাকা জমা হচ্ছে বলে ফিলিপিন্সের রিজাল ব্যাংকের ম্যানেজার মায়া দেগুইতিকে জানায়। এই কর্মকর্তা আরও জানান, হ্যাকাররা বাংলাদেশ থেকে অর্থ চুরি করে রিজাল ব্যাংকে জমা করার জন্য এ্যাকাউন্ট খুলেছিল, এমন কোন প্রমাণ মেলেনি। তারা বিশ্বের বিভিন্ন ব্যাংককে টার্গেট করেছিল। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার সিস্টেম দুর্বল পেয়ে তারা সুযোগটি কাজে লাগায়। অর্থ চুরির সঙ্গে এখন পর্যন্ত ২৩ জন বিদেশী শনাক্ত হয়েছে, যারা মাঠপর্যায় থেকে অর্থগুলো ক্যাসিনো থেকে একত্রিত করে মূল হ্যাকারদের কাছে পৌঁছে দেয়। মূল হ্যাকার হিসেবে প্রাথমিক তদন্তে সন্দেহভাজন হিসেবে চার বিদেশীকে শনাক্ত করা হয়েছে। তবে তাদের সর্ম্পকে এখনও শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যায়নি। অর্থ চুরির ঘটনা প্রমাণের বিভিন্ন আলামত ও এরসঙ্গে জড়িত বিদেশীরা বিশ্বের ১১টি দেশে রয়েছে। সেসব দেশকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। দেশগুলো বাংলাদেশকে সব ধরনের সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছে। মাঠপর্যায় থেকে অর্থ সংগ্রহ করা ২৩ জন সর্ম্পকে যাবতীয় তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারলেই আসল হোতাদের সর্ম্পকে তথ্য পাওয়া যাবে। জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আসল হোতাদের সর্ম্পকে বিস্তারিত জানতে পারলেই তদন্তের কাজ প্রায় শেষ বলা চলে। এখন তদন্ত শেষ ধাপে এসে দাঁড়িয়েছে। এই কর্মকর্তা বলছেন, তদন্তের স্বার্থে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের ৬৬টি কম্পিউটারের যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। সেসব তথ্যের চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এমনকি কম্পিউটারগুলোর ফরেনসিক পরীক্ষাও হয়েছে। তদন্তে রিজার্ভ চুরির সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের উর্ধতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে অনেকেরই জড়িত থাকার তথ্য মিলেছে। প্রযুক্তিগত পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি ঘটেছে। এর সঙ্গে ইচ্ছাকৃতভাবে কোন কর্মকর্তার জড়িত থাকার প্রমাণ মেলেনি। আসলে রিজার্ভ বিভাগে কর্মরতরা প্রযুক্তি সর্ম্পকে যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন না বলে তদন্তে ধরা পড়েছে। যেসব দুর্বলতার কারণে রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি ঘটেছে, তা বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যেই ব্যাংকটির বহু কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। অনেক বিদেশীকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংককে কাদের প্রযুক্তিগত জ্ঞানের দুর্বলতার সুযোগে এমন ঘটনা ঘটেছে, তাদের একটি নামীয় তালিকাও দেয়া হয়েছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবেÑ সেটি ব্যাংক কর্তৃপক্ষের বিষয়। এ ব্যাপারে তারা কোন সাজেশন দিতে পারেন না। তবে ভবিষ্যতে আর রিজার্ভ চুরির সম্ভাবনা নেই। কারণ ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের প্রযুক্তিগত দুর্বলতা কাটিয়ে উঠেছে। সিআইডির একজন উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি বিভাগের ডেপুটি গবর্নরের গাফিলতির কারণেই রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি ঘটে। ওই ডেপুটি গবর্নর নিয়মিত রিজার্ভ মনিটরিং করতেন না। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যাংকে টাকা রাখলেও তা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে মনিটরিং করার ব্যবস্থা আছে। চব্বিশ ঘণ্টাই ফেডারেল ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। এমন যোগাযোগ রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বিশেষ সার্ভার স্টেশন রয়েছে। সেই স্টেশনে বসেই বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রযুক্তিবিদরা অনায়াসে টাকার লেনদেন থেকে শুরু করে সার্বিক বিষয়ের ওপর নজর রাখতে পারে। সেই সার্ভার স্টেশনটি চব্বিশ ঘণ্টা মনিটরিং করতে বাংলাদেশ ব্যাংকেই ২২ জন আইটি বিশেষজ্ঞ রয়েছেন।
×