ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মৃত্যুর আগে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে চেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা মান্নান

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ১১ ডিসেম্বর ২০১৬

মৃত্যুর আগে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে চেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা মান্নান

সাজেদ রহমান, যশোর অফিস ॥ তখন যৌবন। ১৯৭১ সাল। মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। অকুতোভয় লড়াকু সেই আব্দুল মান্নান মোল্লা এখন স্থানীয়দের হাসি-ঠাট্টার পাত্র। রাস্তা দিয়ে হেঁটে বাজারে যাওয়ার সময় দুষ্টু লোকজন তাকে পায়ে ল্যাং মেরে ফেলে দেয়। পাকসেনাদের সঙ্গে ভয়াবহ বন্দুকযুদ্ধে দুই চোখ হারানো এই মহান মুক্তিযোদ্ধাকে স্থানীয়রা ‘কানা মান্নান’ বলে সম্বোধন করে। এত কিছুর পর আজও এই মানুষটি পাননি মুক্তিযোদ্ধার সম্মান। তালিকাভুক্ত করা হয়নি তাঁকে। জীবনের এই শেষ সময়ে এসে এখন তার চাওয়া, বঙ্গবন্ধুকন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেন মৃত্যুর আগে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় তার নামটি অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি মরতে চান মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, সসম্মানে। আব্দুল মান্নানের বাড়ি যশোর সদরের মুন্সেফপুর গ্রামের পশ্চিমপাড়ায়। ৬ ভাই বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ১৯ বছরের টগবগে যুবক। জন্ম ১৯৫২ সালের ১ জানুয়ারি। লেখাপড়া খুব একটা জানেন না, কিন্তু স্মরণশক্তি প্রখর। বাবা চাকরি করতেন খুলনার ইস্টার্ন জুটমিলে, শ্রমিক হিসেবে। সে কারণে বাবা-মায়ের সঙ্গে মিলের পাশেই থাকতেন। ১৯৭১ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ বাড়িছাড়া হয়ে যান। ঘনিষ্ঠ বন্ধু যশোর সদরের মথুরাপুরের মোশাররফকে নরেন্দ্রপুর এলাকার জল্লাদ আফসার নামে রাজাকার বন্দুকের বাঁট দিয়ে আঘাত করে মারে। শাসায়, মুক্তিবাহিনীতে গেলে মেরে ফেলবে। এই ঘটনাটি তার মনে দাগ কাটে। তবুও মা-বাবা কিংবা বন্ধু মোশাররফকে না জানিয়ে তিনি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। দখলদারদের হাত থেকে মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে। মান্নান চলে আসেন প্রশিক্ষক মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল ওহাব মিন্টুর কাছে। সদরের একডালা-বটতলা এলাকায় তিনি তরুণ যোদ্ধা রেজা কাজী, ফরিদ, শান্তি, আব্দুল মান্নানসহ ১৫-১৬ জনকে রাইফেল চালনা থেকে শুরু করে ক্রলিং, সেফটিনেট, গ্রেনেড নিক্ষেপ প্রভৃতি যুদ্ধকৌশল প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে মান্নান সোজা ভারতে চলে যান। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁর চাপাবাড়িয়া ট্রেনিংক্যাম্পে অস্ত্রের ওপর প্রশিক্ষণ নেন। মান্নান বলেন, ট্রেনিং শেষে দেশে ফিরি। আব্বা বললেন, এখানে খুব খারাপ অবস্থা, তুই চলে যা। ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজ নামে এক আত্মীয়ের মাধ্যমে ফের ভারতে গিয়ে আরেক দফা প্রশিক্ষণ নেই। সেখানে আমির আলী পাঠান নামে একজন প্রশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে দু-আড়াই মাস ট্রেনিং নিই। নবেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে কমান্ডার আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে আমাদের ১১ জনের দলকে দেশে পাঠানো হয়। নবেম্বরের শেষের দিকে সকালে কোটচাঁদপুর এলাকার শুভদি’র মাঠে তারা এ্যাম্বুশ করেন। পাকিস্তানী সেনারা খুলনা থেকে দর্শনার দিকে ট্রেনে যাবে- এমন সংবাদ আসে সোর্সের মাধ্যমে। ইতোমধ্যে সেখানকার ব্রিজের আশপাশ রেকিও করা হয়েছে। মান্নানদের উদ্দেশ্য ছিল, ব্রিজটাকে ট্রেনসহ উড়িয়ে দেয়া। তারা দুজন বসে আছেন কাটিম চার্জ করার জন্যে। মূল দায়িত্ব ছিল মহেশপুর উপজেলার চোরকোল এলাকার এক মুক্তিযোদ্ধার (নাম স্মরণ করতে পারেননি)। কিন্তু ট্রেনটি বেশ কাছাকাছি এলেও তিনি ঠিকমতো তারে সংযোগ দিতে পারছিলেন না। মান্নান বলেন, তাকে সরিয়ে দিয়ে আমি তারের নেগেটিভ-পজেটিভ সংযোগ করতে সমর্থ হই। ঠিক সেই মুহূর্তে ট্রেনটি ব্রিজের ওপরে ছিল। সেদিন ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। কিন্তু পাকিস্তানী সেনারা খুবই সাহসী। বেঁচে থাকা কয়েকজন পাশে আখক্ষেতে পজিশন নেয়। আমরাও তাদের বাইরে থেকে ঘিরে ফেলি। সেদিনের কথা স্মরণ করে মান্নান বলেন, নারকেলবাড়িয়ার মুসাভাই আর আমি আখক্ষেতের মধ্যে গুলিতে আহত এক পাকিস্তানী সেনাকে ঘিরে ফেলি। চুয়াডাঙ্গার উথলিতে এক শালবাগান। বিকেল ৫টার দিকে পাকিস্তানীদের সঙ্গে গুলিবিনিময় শুরু হয়। সে প্রচ- এক যুদ্ধ। এই লড়াইয়ে তাদের কারোরই বঁচে থাকার কথা ছিল না। কমান্ডার আনোয়ারের কাছ থেকে তার দূরত্ব ছিল ৫০ গজের মতো। হঠাৎ পাকিস্তানীদের একটি গ্রেনেডের আঘাতে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন কমান্ডার আনোয়ার। আর সেই সময়ই কী যেন লাগে মান্নানের মুখম-লে। তিনি বলেন, কী যে একটা এসে লাগলো কপালে, মুখের নিচে এবং দুই চোখে। খুব জ্বালা-যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেল। এরপর আর কিছু মনে নেই। পরে জানতে পারি দর্শনার গোপন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আমাকে ভর্তি করা হয়েছে। এরপর থেকে দুই চোখে আর কিছুই দেখতে পাই না। ততদিনে দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। এর মাসখানেক পর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজ (তিনিও তালিকাভুক্ত হননি, মারা গেছেন সম্প্রতি) আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দেন।
×