ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই শুকিয়ে জেগেছে চর

মরে যাচ্ছে উত্তরাঞ্চলের নদ-নদী

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ১১ ডিসেম্বর ২০১৬

মরে যাচ্ছে উত্তরাঞ্চলের নদ-নদী

সমুদ্র হক ॥ শুকনো মৌসুমের শুরুতেই উত্তরাঞ্চলের সব নদনদীর পানির প্রবাহ অস্বাভাবিক কমে গেছে । নাব্য কমে গিয়ে একের পর এক চর পড়ছে। রুদ্ধ হয়ে পড়েছে নৌ যোগাযোগ। অনেকস্থানে খেয়াঘাট (খেয়া পারাপার) বন্ধ হয়ে চরাঞ্চলের মানুষের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগে যারপরনাই বিড়ম্বনা ও দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনায় চর পড়ছে বেশি। দিনে দিনে মরাগাঙে পরিণত হচ্ছে নদীগুলো। অন্তত ৬৫টি নদীর অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার পথে। ছোট নদী, শাখা নদী ও উপনদীগুলো দেখে মনে হবে নদীরও অসহায়ত্ব আছে। কোন স্থানে শুকনো ভূমির ওপর দৃশ্যমান কংক্রিটের একটি সেতুর মুখে কোন একটি নদীর নাম লেখা দেখে মনে হবে একদা সেখানে একটি নদী ছিল। উত্তরাঞ্চলের নদীগুলোতে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদী সংস্কার করার কথা। এক সূত্র জানায়, নদী শাসনের কারণে অনেক নদীর নাব্য হ্রাস পেয়েছে। তার পুনরুদ্ধারে ড্রেজিং করা হয়। ড্রেজিং হচ্ছেও। তবে তা বিচ্ছিন্নভাবে। সার ও জ্বালানি তেল পরিবহন স্বাভাবিক রাখতে নারায়ণগঞ্জ থেকে বাঘাবাড়ী পর্যন্ত নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে ড্রেজিং করা হয়। এই ড্রেজিং নিয়েও কথা থেকে যায়। নাব্য ঠিক রাখতে ড্রেজিংয়ের বালি নদীর মধ্যেই ফেলা হয়। এতে দেখা যায় নৌ চলাচলের চ্যানেলের গভীরতাটুকুই ঠিক থাকছে। কাছেই নাব্য যা ছিল তা আরও খানিকটা বেড়ে যায়। আরেকদিকে সংস্কার না হওয়ার কারণে অব্যাহত পলি জমে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নদী তীরের জনপদ হাটবাজার, ব্যবসাবাণিজ্য নদী কেন্দ্রিক আর থাকছে না। প্রবীণরা বলেন, একটা সময় ব্যবসাবাণিজ্যের পণ্য পরিবহনে নৌপথের যোগাযোগ ছিল উপযুক্ত এবং সাশ্রয়ের। বর্তমানে তা আর নেই। নৌবন্দর কেন্দ্রিক হাটবাজারও কমে গেছে। যমুনা ও বাঙালী তীরবর্তী বগুড়ার সারিয়াকান্দি এলাকার চরগ্রাম ও নদীতীরে লক্ষাধিক মানুষের বাস। চরগ্রামের সঙ্গে উপজেলার যোগাযোগের খেয়াঘাটগুলো রুদ্ধ হয়ে গেছে। উল্লেখ্য, এই উপজেলার ১২ ইউনিয়নের মধ্যে অর্ধেকই চরগ্রাম। সারিয়াকান্দি ও একটি চর থেকে আরকেটি চরের দূরত্ব নদীপথে ৫ থেকে ২০ কিলোমিটারের মধ্যে। বেশ কয়েকটি খেয়াঘাট আছে চরাঞ্চলের যোগাযোগে। ডিসেম্বরের শুরুতেই চরগ্রামের অন্তত ৬ টি খেয়াঘাট রুদ্ধ হয়ে গেছে। যে হারে নাব্য হ্রাস পেয়ে নদীর প্রবাহ কমে চর বাড়ছে তাতে শীঘ্রই আরও ৭/৮ টি খেয়া পারাপার বন্ধ হয়ে যাবে। খেয়া পারাপার বন্ধ হলে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয় চর জনপদের হাজারো মানুষের। তাদের চরের বালির ওপর দিয়ে অনেকটা পথ হেঁটে দুর্ভোগের যন্ত্রণা সইতে হয়। সারিয়াকান্দি সদর থেকে কালীতলা খেয়াঘাট হয়ে যে চরগুলোতে নৌ চলাচল ছিল তা আছে তবে একাধিক চরে ট্রানজিট করে হেঁটে পরের চরের খেয়া পারাপারে যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছতে হয়। এ পর্যন্ত যে তিনটি রুটের ৬টি খেয়াঘাট বন্ধ হয়েছে সেগুলো হলো- কালীতলা-মানিকদাইড়, হাসনারপাড়া-দীঘাপাড়া, কাজলা-বেনীপুর। পণ্য পরিবহনের নৌযানগুলো সারিয়াকান্দি সদর থেকে প্রায় সাড়ে ৫ কিলোমিটার ভাটিতে মথুরাপাড়ায় অথবা প্রায় ১১ কিলোমিটার দূরে চন্দনবাইশা ঘাটে নোঙর করে পণ্য খালাসের পর তা নির্দিষ্টস্থানে পৌঁছাতে আরেক বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। কোথাও অল্প পানিতে ডিঙি নৌকা চলে কোথাও তাও চলে না। এ পর্যন্ত উত্তরাঞ্চলের ছোট নদীগুলোর অন্তত ৬৫ টি শুকিয়ে গেছে। যার মধ্যে আছে ধরলা, খোলসডাঙ্গা, মহানন্দা, আত্রাই, বড়াল, তেঁতুলিয়া, ইছামতি, নারদ, নাগর, হুরাসাগর, গুমানী, কাঁকন, কাঁকেশ্বরী, চিকনি, রূপনাই, বাঙালী, নদীশুখা, মাথাভাঙ্গা করতোয়া। যমুনা নদীকে দেখে মনে হয় না এই সেই যমুনা। বগুড়া শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া করতোয়া নদী এতটাই শুকিয়েছে যে মরাগাঙও বলা যায় না। মনে হবে শুকনো ছোট খাল। প্রবীণরা বলেন, এই করতোয়া নদী একদা এতটাই প্রমত্তা ছিল যে শহরের ফতেহ আলী বাজারের ঘাটে দূর-দূরান্ত থেকে পণ্য নিয়ে বড় নৌকা, বজরানৌকা ভিড়ত। একজন পানি প্রকৌশলী বললেন, বর্ষায় উজান থেকে পানির বিপুল প্রবাহ আসে। শুকনো মৌসুমে সেই প্রবাহ আর থাকে না। ছোট নদীতেও বর্ষায় গড় পানি প্রবাহ থাকে ২০ হাজার কিউসেকের বেশি। শুকনো মৌসুমে তা কখনও ২শ’ কিউসেকেরও নিচে নেমে আসে। আরেক সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত রাজশাহীর চারঘাট থেকে বাঘাবাড়ী পর্যন্ত চর পড়েছে ২শ’টিরও বেশি। কুড়িগ্রাম থেকে ঢালারচর পর্যন্ত চর পড়েছে ৫শ’টিরও বেশি পয়েন্টে। বর্তমানে নদী থেকে চর জেগে ওঠার পরিমাণ প্রায় আড়াই হাজার বর্গকিলোমিটার; যা মূল ভূখ-ের ১ দশমিক ৭৮ শতাংশ। আরেক সূত্রের মতে, যমুনায় চর পড়েছে ১২শ’ বর্গকিলোমিটার। গঙ্গা এবং পদ্মা মিলে ৭শ’ বর্গকিলোমিটার এবং মেঘনার উত্তর ও দক্ষিণ অববাহিকায় ৪শ’ বর্গ কিলোমিটার। বগুড়ার যমুনায় নদীর নাব্য ফিরে আনতে সারিয়াকান্দির কর্নিবাড়ি এলাকায় ৫শ’ মিটার নদী খননের একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এতে ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয় ৭ কোটি টাকা। গত বছরের একনেক বৈঠকে প্রকল্পটি নদীতীর সংরক্ষণ প্রকল্পের সঙ্গে একীভূত করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রের খবর, যমুনার গতিপথ ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন হয়। কোন্ স্থানে ড্রেজিং করলে কোন সমস্যা হবে না তা দেখে ড্রেজিংয়ের উদ্যোগ নেয়া হবে।
×