ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রুশো তাহের

রূপপুর নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক এবং...

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ১১ ডিসেম্বর ২০১৬

রূপপুর নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক এবং...

২৫ নবেম্বর বিকেল ৪ টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র ও আগামী দিনের বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন ও গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে স্টারট্রেক ড্রিম। প্রবন্ধটি আমি উপস্থাপন করেছিলাম। ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ইমেরিটাস অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী। বিশেষ অতিথি ও সভাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন যথাক্রমে প্রধান তথ্য অফিসার এ কে এম শামীম চৌধুরী ও বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মোজাম্মেল হক। উল্লেখ্য, সভাপতিত্ব করার কথা ছিল স্থপতি ও কবি রবিউল হুসাইনের। তিনি হঠাৎ অসুস্থ হওয়ায় শ্রদ্ধেয় মোজাম্মেল হক বৈঠকে সভাপতিত্ব করেছিলেন। উপস্থাপিত প্রবন্ধের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন বিভাগের নবীন ও প্রবীণ অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, পরিবেশবিদ এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞসহ অনেকে। বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদনের চিত্র, বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব অফুরন্ত এই শক্তি উৎস থেকে বিদ্যুত উৎপাদনের অনিবার্যতা, পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচার যে অজ্ঞতাপ্রসূত, তা তুলে ধরেন আলোচকরা। থ্রি-মাইল আইল্যান্ড, চেরনোবিল ও ফুকুশিমা দাইচির পারমাণবিক দুর্ঘটনা যে রূপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনে অন্তরায় হতে পারে না, তা-ও আলোচনায় উঠে আসে। বাদ যায়নি রূপপুর থেকে রাশিয়ায়-স্পেন্ট নিউক্লিয়ার ফুয়েল ফেরত নিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গও। বাংলাদেশ যে ১৯৮৬ সাল থেকে রিসার্চ রিএ্যাক্টর পরিচালনা করে আসছে, এই তথ্যও আলোচনায় উঠে আসে। সমালোচনাকে ইতিবাচক হিসেবে নিয়ে জনসচেতনতায় এ ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের জবাব দেন ড. মোঃ কবীর হোসেন ও প্রকৌশলী সাঈদ জুবায়ের। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন বিরোধিতায় হরহামেশা প্রচার করা হয় উন্নত বিশ্ব বিশেষত, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড ও ইতালি নিউক্লিয়ার অপশন পরিত্যাগ করছে। কিন্তু সম্প্রতি এক গণভোটে সুইসরা পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র বহাল রাখার পক্ষে রায় দিয়েছেন। উল্লেখ্য, গত ২৭ নবেম্বর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রগুলো আগাম বন্ধ করে দেয়া হবে কি-না, তা নির্ধারণে সুইজারল্যান্ডে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। এতে ৫৪ দশমিক ২ শতাংশ ভোটার পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রগুলো চালু রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। গণভোটে পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র বন্ধ করার পক্ষ দল জয়ী হলে সুইজারল্যান্ডের পাঁচটি পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের মধ্যে তিনটি আগামী বছরই বন্ধ হয়ে যেত। বাকি দুটি বন্ধ করতে হতো ২০২৯ সালের মধ্যে। উল্লেখ্য, ২০১১ সালে জাপানের ফুকুশিমা দাইচিতে পারমাণবিক দুর্ঘটনার পর সুইস সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, যতদিন নিরাপদ থাকবে ততদিন এই পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রগুলো চালানো হবে। কিন্তু পরিবেশবাদী রাজনৈতিক দল গ্রিন পার্টি এটা না মেনে চার বছর আগে গণভোট আয়োজনের জন্য ১ লাখেরও বেশি স্বাক্ষর সংগ্রহ করে। শেষ পর্যন্ত এই গণভোটেই ভরাডুবি ঘটে পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র বিরোধীদের। ৬ ডিসেম্বর ২০১৬ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেকে) অনুমোদন পেল দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ব্যয়ের প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯ কোটি টাকা। যার ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা বা ১১ দশমিক ৩৮ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে রাশিয়া। বাকি ২২ হাজার ৫৩ কোটি টাকার যোগান দেবে বাংলাদেশ সরকার। উল্লেখ্য, গত ২৬ জুলাই রাশিয়ার অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) মধ্যে ১১ দশমিক ৩৮ মিলিয়ন ডলারের স্টেট এক্সপোর্ট ক্রেডিট চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ৬ ডিসেম্বর ২০১৬ একটি দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ শিরোনাম ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে?’ সংবাদে উল্লেখ আছে, ‘আগে প্রকাশিত সরকারী তথ্য হচ্ছে রাশিয়ার সঙ্গে সাধারণ চুক্তি অনুযায়ী রূপপুর প্রকল্পের মোট ১ লাখ ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ধরা হয়েছিল। যার সঙ্গে প্রকল্পের সমীক্ষা ব্যয় যোগ করলে দাঁড়ায় ১ লাখ ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। কিন্তু একনেকে বিবেচনার জন্য প্রকল্পের যে সারসংক্ষেপ তৈরি করা হয়েছে তাতে মোট ব্যয় উল্লেখ করা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯৩ কোটি টাকা।’ হায়রে (!) সমালোচনা নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের পিছু ছাড়ছে না। না, এটি নিছক সমালোচনা নয় কিংবা গঠনমূলক সমালোচনা নয়। নামে-বেনামে এসব প্রতিবেদন প্রকাশের আড়ালে রয়েছে গভীর ষড়যন্ত্র। নীলনক্সা বাস্তবায়নের অপপ্রয়াস। কোন বিশেষ মহল, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হোক; তা চান না এমনকি বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, তাদের পেইড এজেন্টও হতে পারে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনবিরোধী প্রচারে নিয়োজিতরা। ২৭ নবেম্বর ওই দৈনিকে প্রকাশিত একটি সংবাদ শিরোনাম ‘স্পেন্ট ফুয়েল নেবে রাশিয়া, বর্জ্য নেয়া অনিশ্চিত।’ এক্ষেত্রে উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়েছে পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী আলী জুলকারনাইনের। তিনি নাকি বলেছেন, রাশিয়া স্পেন্ট ফুয়েল ফেরত নেবে। আর নিম্ন ও মধ্যম মাত্রার তেজস্ক্রিয় বর্জ্য প্রকল্পের আয়ুষ্কালজুড়ে সংরক্ষণের ব্যবস্থা রূপপুরেই থাকবে। এই তথ্য আবার ঝালাই করেছেন কথিত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জনৈক কর্মকর্তার সূত্র দিয়ে। এখানে পরিবেশন হয়েছে নতুন তথ্য, ‘স্পেন্ট ফুয়েল ফেরত নেয়া মানে নাকি অতিমাত্রায় তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ফেরত নেয়া নয়। আসল বিষয় হচ্ছে পারমাণবিক বর্জ্য ফেরত নেয়া। সেটা রাশিয়া ফেরত নেবে কি-না, তা এখনও অনিশ্চিত।’ আমার কাছে স্পষ্ট নয় যে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্র কি নিউক্লিয়ার বিশেষজ্ঞ নাকি সূত্রের আড়ালে প্রতিবেদক নিজেই নিউক্লিয়ার বিশেষজ্ঞ সেজে সংবাদের নামে গল্প সাজিয়ে মিথ্যাচার ছড়াচ্ছেন। লেখক : বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক
×