ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তাফা জব্বার

একুশ শতক ॥ কেউ চাইলেই ভয়েস কল থাকবে না

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ১১ ডিসেম্বর ২০১৬

একুশ শতক ॥ কেউ চাইলেই ভয়েস কল থাকবে না

আপাতত এমন সম্ভাবনা নেই যে, ভাইবার, হুয়াটস এ্যাপ, ম্যাসেঞ্জার এসব বন্ধ হবে। এরই মাঝে আমরা জেনে গেছি যে, টেলিকম বিভাগ বা বিটিআরসি ইন্টারনেটভিত্তিক এ্যাপ হুয়াটস এ্যাপ, ভাইবার, ইমো ইত্যাদি বন্ধ করার কথা ভাবছে না। বিটিআরসির চেয়ারম্যান এসব প্রযুক্তি বন্ধ করার ঘোষণা দেয়ার পরপরই তীব্র প্রতিবাদের মুখে কেবল সেটি প্রত্যাহার করেননি, তার নিজের প্রতিমন্ত্রী কড়া ভাষায় প্রস্তাবনার বিরোধিতা করেন। প্রথমে টেলিকম প্রতিমন্ত্রী ও পরে বিটিআরসি প্রযুক্তি বন্ধ করার অপচেষ্টা থেকে সরে আসার সিদ্ধান্তের কথা জানান। উভয়কে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন এমন বোধোদয়ের জন্য। সারাদেশের মানুষের, বিশেষত নতুন প্রজন্মের মানুষ আপাতত হাফ ছেড়ে বাঁচল। কিন্তু কতদিনের জন্য? বিটিআরসির চেয়ারম্যান মহোদয় আবার কবে তার মত পাল্টাবেন? আবার নতুন কে এসে টেলকো অপারেটরদের রাজস্ব বাড়ানোর নামে পুরো ইন্টারনেটই না বন্ধ করে দেয়! অন্যদিকে আইনের দোহাই দিয়ে উবার এ্যাপটি নিষিদ্ধ করেছে বিআরটিএ। বেআইনী রেন্ট-এ কার সেবা বিআরটিএর নাকের ডগায় চললেও ইন্টারনেটনির্ভর উবার জন্ম নেয়ার আগেই নিষিদ্ধ হয়েছে। এটি ঠিক যে, আইন সবাইকেই মানতে হবে। কিন্তু শিল্প যুগের আইন যে ডিজিটাল যুগে অচল সেটি বুঝতে হবে। ২০১০ সালে প্রাগৈতিহাসিক ট্যাক্সি গাইডলাইন যে ডিজিটাল যুগে বদলাতে হবে সেটি বিআরটিএকে কে বোঝাবে? আমরা নিজেরা যে চল এ্যাপ তৈরি করে উবারের বিকল্প বানিয়ে ফেলেছি তার কি হবে সেটি কি কেউ ভেবেছেন? বিষয়টি যে আইনের চাইতে অজ্ঞতার জন্যই ঘটেছে সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। এমনটি দেশের নষ্ট কয়েকটি ট্যাক্সি কোম্পানির স্বার্থ রক্ষার জন্যও করা হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। আমার নিজের ধারণা বিআরটিএ হোক আর বিটিআরসি হোক প্রযুক্তির পরিবর্তনটা তারা বুঝতে পারেনি। ভয়টা এমন যা প্রায় আতঙ্কে পরিণত হয়েছে যে, সামনের দিনে পদে পদে বিটিআরসি আর বিআরটিএর নষ্ট পদক্ষেপ দেখতে হবে। এসব ভাবনা থেকেই কিছু কথা বলা দরকার যে, প্রযুক্তি বন্ধ করাটাই সমাধান নয়। জননেত্রী শেখ হাসিনা যে দেশের প্রধানমন্ত্রী, সেই ডিজিটাল বাংলাদেশে প্রযুক্তি বন্ধ করার উপায় যে সমাধান নয় সেটি সবাইকে বুঝতে হবে। আমাদের সকলেরই আস্থা ছিল যে, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন আর যাই হোক টেলিকম খাতের খবর রাখার পাশাপাশি দুনিয়ার ডিজিটাল যাত্রাকেও উপলব্ধি করে। এর সাবেক চেয়ারম্যান মঞ্জুর আলম বা জিয়া আহমদ শেলীকে আমি ব্যক্তিগতভাবে তেমন জ্ঞানী মানুষ হিসেবেই জানতাম। দেশের টেলিকম খাতের বিকাশে তারা অসাধারণ অবদান রেখে গেছেন। তাদের পরে সুনীল বাবু আসার পর এই সংস্থাটির সঙ্গে তেমন কোন যোগাযোগ রাখতে পারিনি। তিনি তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প খাতের চাইতে মোবাইল অপারেটরদের জন্য অনেক বেশি নিবেদিত ছিলেন। আমাদের সেভাবে ডাকতেনও না। তার সঙ্গে মাঝে মাঝে কোন অনুষ্ঠানে দেখা হতো। সচরাচর তিনি তথ্যপ্রযুক্তির কোন আয়োজন বা টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে আসতেন না। আমি বহুবার বিটিভির ডিজিটাল বাংলাদেশ অনুষ্ঠানে তাকে ডেকেছি। তিনি আসেননি। টেলিকম বিভাগের সচিব থাকাকালে বিটিআরসির হাত-পা ভাঙ্গার কাজটি তিনিই করে গিয়েছিলেন এবং তার খেসারতও তিনিই বিটিআরসির চেয়ারম্যান হওয়ার পর দিয়ে গেছেন। আমরা আশান্বিত হয়েছিলাম যখন প্রবাস জীবন থেকে ড. শাজাহান মাহমুদ বাংলাদেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ এই সংস্থার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আমি নিজে মনে মনে প্রধানমন্ত্রীকে এজন্য ধন্যবাদ দিয়েছি। তার সঙ্গে দু-একবার দেখা হয়েছে। একবার বেসিসের সভাপতি হিসেবে আনুষ্ঠানিক কথা হয়েছে। আমি সেদিন টেলকোদের অত্যাচার, ইন্টারনেটের গতি, দাম এবং টেলিকম সেবার মান নিয়ে কথা বলেছি। সেদিনই একটি সেমিনার আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়া হলে এখনও সেটি আমরা আয়োজন করতে পারিনি। ধারণা করি টেলকো বিষয়ক তেতো কথাগুলো শোনায় তার আগ্রহ কমে গেছে। তবে যেটুকু আলাপ হয়েছিল তাতে আমি আশাবাদী ছিলাম যে, তিনি সংস্থাটিকে সঠিক পথে সামনে নিতে পারবেন। দেশের মানুষের কথাগুলোও তিনি হয়ত শুনবেন ও ব্যবস্থা নেবেন। যদিও এর আগে ইন্টারনেট বন্ধ করা বা ফেসবুক বন্ধ করার দৃষ্টান্ত থেকে আমরা কিছুটা আতঙ্কিত ছিলাম, তবুও ভাবতে পারিনি যে, তার মুখ থেকে হোয়াটস এ্যাপ, ভাইবার বা স্কাইপের মতো এ্যাপ বন্ধ করে দেয়ার ইচ্ছার প্রকাশ ঘটতে পারে। টেলকোর ভয়েস কল কমার জন্য তিনি এসব এ্যাপকে দায়ী করতে পারেন সেটিও ভাবতে পারিনি। যে দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজে ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচীকে সামনে নিয়ে যাচ্ছেন এবং যিনি বাংলাদেশ সরকারের ২১০ কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়ে কম্পিউটারকে শুল্কমুক্ত করেছিলেন সেই দেশের বিটিআরসির চেয়ারম্যান ভয়েস কলের রাজস্ব হারানোর অজুহাতে এমন একটি বক্তব্য দিতে পারেন সেটি আমি কল্পনাও করতে পারিনি। তিনি যে এতটা পশ্চাৎপদ সেটাও আমি ধারণা করতে পারিনি। আমি অবাক হইনি যখন এই খবরের নিচে ফেসবুকে এক তরুণ মন্তব্য করেছেন, এমন একটি মূর্খ লোককে এই পদে বসানো কি ঠিক হলো? আমরা ইন্টারনেটে এই বিষয়ক একটি প্রতিবেদন পেয়েছি। সেটি এখানে তুলে ধরলাম, ‘শুধু অবৈধ ভিওআইপি নয়, ভাইবার, হোয়াটস এ্যাপ, ইমোর মতো স্মার্টফোন এ্যাপে ভয়েস কল সুবিধার কারণে আন্তর্জাতিক ফোন কলের ব্যবসায় বাংলাদেশ মার খাচ্ছে বলে জানিয়েছেন টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির প্রধান শাহজাহান মাহমুদ। শুক্রবার বিটিআরসি কার্যালয়ে ‘অবৈধ ভিওআইপি ও সমসাময়িক বিষয় নিয়ে’ এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা জানান। তিনি বলেন, মোবাইল ফোনে এ ধরনের ‘ওভার দ্য টপ’ এ্যাপ ব্যবহার করে ভয়েস কলের সুবিধা নিয়ে আগামী দু-এক মাসের মধ্যে একটি সিদ্ধান্তে আসতে চায় বিটিআরসি। বিটিআরসি চেয়ারম্যান জানান, আন্তর্জাতিক কল টার্মিনেশন রেট বাড়ানোর আগে বৈধ পথে গড়ে দিনে ১২ কোটি মিনিট ইনকামিং কল দেশে আসত। ২০১৫ সালের আগস্টে কল টার্মিনেশন রেট দেড় সেন্ট থেকে বাড়িয়ে দুই সেন্ট করার পর এখন তা দৈনিক গড়ে সাত কোটি মিনিটে নেমে এসেছে। তবে কল কমার জন্য দাম বাড়ানোকেই মূল কারণ বলে মনে করছেন না তিনি। তিনি বলেন, মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্কাইপ, ভাইবার, হোয়াটস এ্যাপের মতো ভিওআইপি এ্যাপের মাধ্যমে ভয়েস কলের সুবিধাও জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে বৈধ ভয়েস কলের ওপর। শাহজাহান মাহমুদ বলেন, এটি একটি বিরাট সমস্যা আমাদের সামনে। শুধু যে অবৈধ ভিওআইপি হচ্ছে তা নয়, অনেক কল ওটিটি ভাইবার, ইমো বা হোয়াটস এ্যাপের মাধ্যমে হচ্ছে। তবে এর পরিমাণ আমরা এখন বলতে পারছি না। এ বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ কি হবে সে বিষয়ে বিটিআরসি চেয়ারম্যান বলেন, এ ব্যাপারে কোন নীতিমালা এখনও প্রণয়ন করা হয়নি। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের উদাহরণ নেয়ার চেষ্টা করছি। কোন কোন দেশে এসব অবৈধ ঘোষণা করেছে, অনেক দেশ বলেছে শুধু ডেটা সরবরাহ করা যাবে, ভয়েস নয়।’ ২৬ নবেম্বর ১৬-এর গণমাধ্যম থেকে নেয়া। খবরটি প্রকাশের পরপরই ফেসবুকে আমি আরও কয়েকটি মন্তব্য দেখে সেটি আপনাদের সামনে পেশ না করার লোভ সামলাতে পারছি না। শহিদুল আলম রায়ান বলেছেন, ‘মেইল-এর জন্য পোস্ট অফিস-এর আয় কমেছে। তবে কি মেইলও বন্ধ করা হবে?’ তৌফিকুল করিম সুহƒদ বলেছেন, ‘এই জ্ঞান নিয়ে উনি বিটিআরসির চেয়ারম্যান? তিনি রেভিনিউ জেনারেট করতে মাথা খাটান, মাথা মোটা হলে রেভিনিউ আসাই বন্ধ হয়ে যাবে। মোবাইল অপারেটররা যদি ঠিকমতো ট্যাক্স দেয় তা হলে রেভিনিউ আসা বাড়তেই থাকবে। প্রযুক্তি ব্যবহারে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে দেশের উন্নতি বা ডিজিটালাইজেশন অসম্ভব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন ভিডিও কনফারেন্স করেন, তখন কি ভিওআইপি এ্যাপস ব্যবহার করা হয় না? আমরা আসলে এখনও কনফিউজড, আগাতে চাই নাকি আদিম যুগে যেতে চাই।’ কবির আহমদ মন্তব্য করেছেন, ‘কি অদ্ভুত ধারণা এটি ডিজিটাল বাংলাদেশ। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। জব্বার ভাই আপনি পুরো তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে ঐক্যবদ্ধ করুন।’ সাইফুল এ পলাশ একটি অনলাইন খবর তুলে ধরে লিখেছেন যে, কেবল টেলিটকেই ৮ কোটি মিনিট অবৈধ কল আসে। এসব মন্তব্য করা হয়েছে ফেসবুকে আমার মন্তব্যের প্রেক্ষিতে। আমি লিখেছি, মাথাব্যথার জন্য মাথা কাটার দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে নতুন নয়। ফেসবুকের অপরাধের জন্য ফেসবুক বন্ধ করা বা পুরা ইন্টারনেটই বন্ধ করার নজির আমাদের আছে। এখন শুনছি ভাইবার, হোয়াটস এ্যাপ, স্কাইপে বন্ধ হবে ভয়েস কল কমে যাওয়ার অজুহাতে। বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তরের এই শত্রুদের রুখতে হবে। আসুন ঐক্যবদ্ধ হই- আওয়াজ তুলি। আমার এই মন্তব্যের পর ফেসবুক প্রতিবাদের বন্যায় ভেসে যায়। হাজার হাজার লাইক ও শত শত শেয়ার হতে থাকে পোস্টটি। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়ও বিষয়টি ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। সাংবাদিকদের ফোনের পর ফোনে আমাকে পুরো দিনটাই ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়েছে। এরপর ২৮ নবেম্বর আমি ডিবিসি নিউজের টকশোতেও জাকারিয়া স্বপনের সঙ্গে লাইভ আলোচনা করেছি। নিজে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার একজন সাধারণ যোদ্ধা হিসেবে ডিজিটাল বাংলাদেশ সরকারের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির মুখ থেকে এমন প্রস্তাবনা শুনতে আমি মোটেই মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। ঢাকা, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৬ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক ॥ [email protected] w.bijoyekushe.net, ww w.bijoydigital.com
×