ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মীম নোশিন নাওয়াল খান

বকের অতিথি

প্রকাশিত: ০৬:৫৫, ১০ ডিসেম্বর ২০১৬

বকের অতিথি

বাবা বকটা গাছের মাথায় বসে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিল। সকাল থেকে কম ধকল যায়নি তার। এই তো মাত্র তিনটা পুঁটি মাছ- তাই ধরতে সারা সকাল লেগে গেছে। এই সময়ে হন্তদন্ত হয়ে মা বক এসে হাজির। হাঁপাচ্ছে সে। বাবা বককে বিশ্রাম নিতে দেখে রেগে উঠে বলল, সারাদিন শুধু বসে থাকো! কোন খোঁজখবর রাখো না! ওদিকে কী হয়েছে জান? বাবা বক উদাস গলায় প্রশ্ন করল, কী হয়েছে? মা বক আরও রেগে উঠে বলল, তোমার যে কোন মাথাব্যথাই নেই দেখছি! বিলে কতগুলো নতুন পাখি এসেছে। এদেরকে আগে এখানে দেখিনি। চিনি না। কী মতলবে এসেছে কে জানে! এবার বাবা বকটা একটু চিন্তিত হলো। একা একাই বলল, নতুন পাখি এসেছে? এখানে আবার নতুন পাখি আসবে কোত্থেকে? মা বক উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, আমিও তো তাই ভাবছি, এরা কেন এসেছে এখানে। আমি খোকাকে বলে দিয়েছি বাসা থেকে না বেরুতে। সে বিলের পানিতে খেলা করছিল, আমি তাকে বাসায় নিয়ে এসেছি। ওই পাখিগুলো কেন এসেছে জানি না। কী যেন, যদি কোন ক্ষতি করে বসে! বাবা বক বলল, ঠিক বলেছ। ব্যাপারটা দেখতে হচ্ছে। সাদা ডানা দুটো মেলে দিয়ে উড়াল দিল সে। বিলের কাছাকাছি গিয়ে বাবা বক অবাক হলো খুব। সত্যিই বিলে অনেক নতুন পাখি এসেছে। এদেরকে সে আগে দেখেনি। কী করা যায় কিছুক্ষণ ভাবল সে। তারপর কাছাকাছি থাকা নেতা মতো একটা পাখির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কারা? এখানে কেন এসেছ? নেতা মতো পাখিটা বাবা বকের দিকে তাকাল। ইশ! তাকানোটাও কী ভয়ংকর! গম্ভীর কণ্ঠে বলল, আমরা চীনাহাঁস, অতিথি পাখি। রাশিয়া থেকে এসেছি। বাবা বক আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, রাশিয়া? সেটা আবার কোথায়? নেতা মতো পাখিটা হো হো করে হেসে উঠল। বলল, সেটা একটা দেশ। তোমাদের এখান থেকে অনেক দূরের দেশ। সেখানে অনেক শীত। এত শীত যে সেই শীত আমরা সহ্য করতে পারি না। তাই তোমাদের দেশে চলে এসেছি। বাবা বকের এবার খুব রাগ হলো। সে রেগে গিয়ে বলল, তোমাদের দেশে শীত থাকলে আমরা কী করব? সেজন্য তোমরা আমাদের দেশে এসেছ কেন? আমাদের তাড়িয়ে আমাদের জায়গা দখল করার মতলব, তাই না? চীনাহাঁস খুব অবাক হলো। বিস্মিত কণ্ঠে বলল, তোমাদের জায়গা দখল করব কেন? আমরা তো শুধু শীতকালটা থাকব। শীত কমে গেলেই আমরা চলে যাব। বাবা বক কিছু বলার আগেই মা বক উড়ে এলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, শুনছ! সর্বনাশ হয়ে গেছে। খোকাকে বাসায় রেখে এসেছিলাম, তাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না! বাবা বক আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল, খুঁজে পাচ্ছ না মানে? কোথায় যাবে সে? মা বক কাঁদতে কাঁদতে বলল, জানি না। তারপর সে চীনাহাঁসকে দেখিয়ে বলল, ওরা নিশ্চয়ই আমার খোকাকে ধরে নিয়ে গেছে। তার কোন ক্ষতি করবে। আমি শুরুতেই বুঝেছিলাম, ওরা কোন বদ মতলবে এসেছে। চীনাহাঁস বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলল, আমরা কেন তোমাদের খোকার ক্ষতি করতে যাব? আমরা তো তোমাদের এখানে অতিথি হয়ে এসেছি শুধু! বাবা বক, মা বক- কেউ তার কোন কথা শুনল না। দু’জন মিলে তাকে ইচ্ছেমতো কথা শোনাল, বকাঝকা করল। আরো অনেক চীনাহাঁস আর বক জমে গেল চারপাশে। বকরা সবাই একমত, চীনাহাঁসরাই খোকা বককে ধরে নিয়ে গেছে। তারা বলল, খোকা বককে ফিরিয়ে না দিলে চীনাহাঁসদের এক হাত দেখে নেবে তারা। আরও বলল, খোকা বককে ফিরিয়ে দিয়েই যেন চীনাহাঁসরা এই এলাকা ছেড়ে চলে যায়। চীনহাঁসরা পড়ল বড্ড বিপদে। তারা কিছুতেই কাউকে বিশ্বাস করাতে পারল না তারা খোকা বকের কোন ক্ষতি করেনি। সন্ধ্যা নেমে গেল। খোকা বককে এখনও পাওয়া যায়নি। বাবা বক মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে, মা বক কাঁদছে। অন্য বকরা তাদেরকে সান্ত¡না দিচ্ছে। চীনাহাঁসদের এখনও শাসানো হচ্ছে। ঠিক এমন সময় গোধূলির কমলা আলো মেখে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে উড়ে এলো খোকা বক। মা বক আর বাবা বক জড়িয়ে ধরল তাকে। মা বক বকা দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কোথায় গিয়েছিলে তুমি? খোকা বক স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিল, আমি তো খেলছিলাম! তার পিছু পিছু উড়ে আসা একটা বাচ্চা চীনাহাঁসকে দেখিয়ে বলল, দেখো মা, ও আমার নতুন বন্ধু। ও খুব ভাল। আজকে সারাদিন ও আমার সঙ্গে ছিল, অনেক কাজে ও আমাকে সাহায্য করেছে, আমার সঙ্গে খেলাধুলা করেছে। সবচেয়ে বড় কথা কী জান? একটা মানুষ এসেছিল। সে আমাদেরকে ধরতে এসেছিল। ও-ই তো বুদ্ধি করে সবাইকে বাঁচাল। ও না থাকলে আজকে মানুষটা আমাকে ধরেই ফেলত। মা বক ভয় পেয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল খোকা বককে। বাবা বক চুপ করে রইল। তারপর নেতা মতো চীনাহাঁসের ডানা ধরে বলল, আমরা তোমাদের ভুল বুঝেছি। তোমরা আমাদের বন্ধু, আমাদের অতিথি। আমাদের ক্ষমা করে দাও। তোমাদের যতদিন ইচ্ছে তোমরা আমাদের এখানে থাকবে, তোমাদের যতœ-আত্তির কোন ত্রুটি হবে না! এভাবে চীনাহাঁস আর বকেরা বন্ধু হয়ে গেল। তিন মাস কেটে গেল। শীতকাল পেরিয়ে গেছে। চীনাহাঁসেরা চলে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করেছে। কয়েকটা দল এর মধ্যে চলেও গেছে। ওরা চলে যাবে ভাবলেই বকেদের কেমন যেন মন খারাপ হয়। ওদের সঙ্গে দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। আজকে চীনাহাঁসের শেষ দলটা রাশিয়ায় ফিরে যাবে। এটা সেই নেতা মতো চীনাহাঁসের দল। বাবা বক, মা বক আর খোকা বক এসে বিলের কাছে দাঁড়াল। চীনাহাঁসরা উড়াল দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বকেরাও তাদের সঙ্গে সঙ্গে উড়তে শুরু করল। অনেকটা দূর উড়ে উড়ে তাদেরকে এগিয়ে দেয়ার পর বাবা বক বলল, এবার আমাদের ফিরতে হবে বন্ধু। তোমরা আগামী বছর আবার আসবে তো? নেতা মতো চীনাহাঁসটা বলল, শুধু তোমাদের জন্য হলেও আসব, বন্ধু! ভালো থেকো। বাবা বক পেছনের দিকে উড়তে শুরু করল। একবার ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখল, আস্তে আস্তে বিন্দুর মতো দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে চীনাহাঁসেরা। ভিকারুননিসা নুন স্কুল এ্যান্ড কলেজ ১০ম শ্রেণী (ইংরেজী ভার্সন) অলঙ্করণ : আইয়ুব আল আমিন
×