ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধের শুরুতে ২১ দিন মুক্ত ছিল বগুড়া

প্রকাশিত: ০৬:৪৭, ১০ ডিসেম্বর ২০১৬

যুদ্ধের শুরুতে ২১ দিন মুক্ত ছিল বগুড়া

২৫ মার্চ ১৯৭১ মধ্যরাত। বগুড়া সুনসান নয়। অস্থিরতা ভর করে আছে শহরবাসীর মধ্যে। রাস্তায় মানুষজন চলাচল আছে। তবে কম। পথচারী পরিচিত-অপরিচিত প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে ‘ভাই কোন খবর’। পাল্টা প্রশ্ন- আপনার কাছে কোন খবর আছে! এরই মধ্যে থানা রোড থেকে কয়েকজন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে কোরাসের মতো করে বলল ‘জাগো বাঙালী জাগো, কে কোথায় আছো। রাস্তা বন্ধ করে দাও। পাকিস্তানী মিলিটারি ঢুুকছে...’। এরপর অবিশ্বাস্য ঘটনা। কয়েক মুহূর্ত। শহরের মানুষ জেগে গেল। ঘর থেকে বের হয়ে পথে নামল। রাস্তায় হাজার মানুষের ঢল। ততক্ষণে চারদিকে প্রচার হয়ে গেছে পাকিস্তানী মিলিটারি হানাদার হয়ে মানুষ হত্যা করছে। বগুড়ার দিকে মিলিটারি আসছে রংপুর থেকে। শহরের প্রতিটি পয়েন্টে গাছের গুঁড়ি ফেলে দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হলো পথ। মানুষের মনের শক্তি যে কত তা সেদিনই টের পাওয়া গেল। তখন রাত গভীর। এর মধ্যেই তরুণরা ছুটল উত্তর দিকে। ওই মহাসড়ক দিয়েই সেনাবাহিনী ঢুকবে শহরে। শহর থেকে গোকুলের দূরত্ব আট কিলোমিটার। মহাসড়কের পয়েন্টে পয়েন্টে বড় বড় গাছ কেটে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয়েছে। রেল স্টেশন থেকে কয়েকটি মালগাড়ি ঠেলে শহরের ভেতরে তিনটি রেলগেটে স্থির করা হলো। যাতে রাস্তা বন্ধ তাকে। ভোর ৪টার দিকে পাকিস্তানী মিলিটারির চারটি কনভয় ও দু’টি জীপ গোকুলে থেমে গেল। রাস্তা এমনভাবে বন্ধ করা হয়েছে তা অপসারণ না করলে কোনভাবেই যানবাহন ঢুকতে পারবে না। গোকুলের ঠেঙ্গামারা গ্রামের রিক্সাচালক তোতা মিয়া সকালে গাছ কেটে মহাসড়কের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন। যখন দেখেন মিলিটারি কনভয় থেকে নেমে দাঁড়িয়ে আছে, তখন হাতের কুড়াল নিয়ে ছুটে কোপ দেয়ার আগেই গুলি ছুড়ল হানাদার পাক সেনারা। তারা বুঝতেই পারেনি এভাবে কোন বাঙালী অসীম সাহসের সঙ্গে দৌড়ে এসে আঘাত করতে পারে। বগুড়ার মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শহীদ তোতা মিয়া। মিলিটারিরা ভয় পেয়ে এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে শুরু করেছে। গুলিবিদ্ধ হলেন রমজান আলী। প্রতিরোধ শুরু হয়ে গেল। শহরের ভেতরে ও মহাসড়কের দিকের বিভিন্ন পয়েন্টে তরুণরা বন্দুক লাঠিসোটা, দা-কুড়াল যে যা পেরেছে তাই নিয়ে অবস্থান নিয়েছে। পাকিস্তানী সেনাদের বেপরোয়া গুলিতে শহীদ হলেন আজাদ। তিনি কটন মিল গেস্ট হাউসের ছাদে অবস্থান নিয়ে বন্দুকের গুলি ছুঁড়ছিলেন। ঝাউতলায় তৎকালীন ইউনাইটেড ব্যাংকের দোতলায় অবস্থান নিয়ে টিটু গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হলেন। বেলা ৩টার দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে টিকতে না পেয়ে পিছু হটল পাকিস্তানী সেনারা। তারা অবস্থান নিল উত্তরে মজিবর রহমান মহিলা কলেজের ভেতরে। পরদিন ২৭ মার্চ সকালে পুলিশ, তৎকালীন ইপিআর ও সাধারণ মানুষ একতাবদ্ধ হয়ে সুবিল ব্রিজের কাছে শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসল। পাকিস্তানী সেনাদের ফায়ারিংয়ের জবার দিল পুলিশ ইপিআর তাদের রাইফেলের গুলি ছুঁড়ে। তবে তা ছিল অত্যন্ত কৌশলী। যাতে সেনারা বুঝতে পারে, একেবারে খালি হাতে লড়তে আসেনি বাঙালী। তরুণরা বন্দুকের গুলি ছুঁড়ে আক্রমণ চালাল। হানাদার পাকিস্তানী সেনারা এবার মর্টারশেল, রকেট লাঞ্চার ব্যবহার করে। পরের দু’দিন বিচ্ছিন্নভাবে হামলা চালায় পাক সেনারা। পাল্টা উত্তর দেয় জনতা পুলিশ ইপিআর। ২৯ মার্চ পাক সেনাদের চারদিক থেকে ঘিরে আক্রমণ চালায় তিন দিনে গড়ে ওঠা সম্মিলিত শক্তিতে। পরদিন পাক সেনারা বিমান হামলা চালায়। এ সময় সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করে মুক্তিযোদ্ধারা। জয়পুরহাট পাঁচবিবি থেকে সাঁওতালরা আসে। তারা তীর-ধনুক নিয়ে অবস্থান নেয় সুবিলের পাড়ে। চারদিক থেকে ঘেরাও হয়ে পাক সেনারা ৩১ মার্চ পিছু হটে ফিরে যায় রংপুরের দিকে। এপ্রিলের প্রথম দিন বগুড়া হয় হানাদারমুক্ত। ১ এপ্রিল থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত বগুড়া ছিল হানাদারমুক্ত। শহরের প্রতিটি স্থানে উড্ডীন থাকে বাংলাদেশের পতাকা। সিভিল প্রশাসন বাংলাদেশের হয়ে কাজ করে। ওই সময় বগুড়ার ডিসি ছিলেন খানে আলম খান। তাঁর বাংলো ও অফিসে ওড়ে বাংলাদেশের পতাকা। বাংলাদেশের প্রথম পতাকা ছিল গাঢ় সবুজের মধ্যে লালসূর্য। তার মধ্যে বাংলাদেশের মানচিত্র। এই ২১ দিন বগুড়ার প্রশাসন ছিল বাংলাদেশের। ট্রেন চলে সীমিত। মুক্ত অবস্থার মধ্যে ২২ এপ্রিল হানাদার পাকিস্তানী সেনার একটি দল দক্ষিণের বাঘাবাড়ি থেকে এবং আরেকটি দল উত্তরের রংপুর থেকে বিপুল শক্তি নিয়ে আঘাত করে। রকেট লঞ্চার মর্টার নিক্ষেপ করতে করতে শহরের ভেতরে ঢোকে হানাদার। পাকিস্তান বিমানবাহিনীর দুটি জেট বিমান থেকে বোমা ফেলে পদাতিক সেনাদের এগোতে সাহায্য করা হয়। মুক্তিযোদ্ধারা ২১ দিন বগুড়া মুক্ত রাখার পর ফের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে পাড়ি দেয় ভারত। -সমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×