ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্বামীর ভিটে আঁকড়ে রয়েছেন ফরিদা

১৫ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি মেলেনি

প্রকাশিত: ০৬:৪৫, ১০ ডিসেম্বর ২০১৬

১৫ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি মেলেনি

মনিরামপুুরের শহীদ ১৫ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি মেলেনি আজও। তাদের স্মৃতি রক্ষায় জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ স্মৃতিফলক উন্মোচন করেছিলেন। তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ উপজেলা কমান্ডের ডেপুটি কমান্ডার ১৫ শহীদের খবর জানেন না। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের ৪/৫ দিন আগে রাজাকাররা কপালিয়া ব্রিজ সংলগ্ন খেয়াঘাটে বীর সেনাদের ১২ জনকে একযোগে গুলি করে হত্যা করে। শহীদ ১২ মুক্তিসেনা হলেন কপালিয়া ঘোষবাড়ী এলাকার ইকবাল হোসেন, নূর মোহম্মদ গাজী, চিত্তরঞ্জন সরকার, লক্ষ্মীকান্ত (কেরো), রাজেশ্বর নাথ, কপালিয়া সরদারপাড়ার গোলজার হোসেন সরদার, ফজনুর রহমান সরদার, আব্দুস ছামাদ সরদার, মোল্লাপাড়ার আনছার মোল্লা, অজেদ আলী মোল্লা, জোনাব আলী মোল্লা ও কপালিয়া কালিতলার মনোরঞ্জন ম-ল। প্রায় একই সময়ে রাজাকাররা ওই এলাকার ফুটকলি, কালিদাস বিশ্বাস ও বনমালী ম-লকেও হত্যা করে। রাজাকারদের হাতে শহীদ ১৫ জনের বয়স তখন ২২/২৫ বছর। বৃদ্ধ বাবা-মাসহ কারও কারও ঘরে ছিল নববিবাহিত স্ত্রী ও সন্তান। গত ৪৫ বছরে শুধু স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে। কিন্তু শহীদ মুক্তিসেনাদের পরিবার পরিজনের ভাগ্যে কিছুই জোটেনি। ফলে অনেকের স্ত্রী স্বামীর ভিটে ছেড়ে অন্যত্র সংসার পেতেছেন। আবার কেউ কেউ কোলের সন্তানকে জড়িয়ে স্বামীর ভিটে আঁকড়ে পড়ে রয়েছেন আজও। এমন এক বিধবা ফরিদা বেগম। তিনি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা গোলজারের স্ত্রী। ১৯৭১ সালের তরুণী ফরিদা এখন বৃদ্ধা। বলেন, বিয়ের দুই বছর পর স্বামী যুদ্ধে যায়। স্বামীকে যখন ওরা মেরে ফেলে তখন কোলে আমার দুই মাসের ছেলে আবদুল গণি। সেই থেকে ছেলেকে কোলে করে স্বামীর ভিটেয় পড়ে আছি। ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়েছি। এরপর ছেলে পাশের মাদ্রাসায় গণিতের শিক্ষক পদে চাকরি পায়। বিয়ে করে দুই মেয়ের বাবাও হয়। পরে ছেলে আবদুল গণির কিডনির সমস্যা দেখা দিলে এলাকাবাসীর কাছ থেকে সাহায্য তুলে তাকে ঢাকা ও ভারতে চিকিৎসা করাই। কিন্তু বাঁচাতে পারিনি। দুই বছর আগে সে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। ভাগ্যহীনা বৃদ্ধা বলেন, ছেলে মারা যাওয়ার পর বউমা (আবদুল গনির স্ত্রী) দুই মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ি গিয়ে উঠেছে। এখন আমি একাই স্বামীর ভিটে আঁকড়ে পড়ে আছি। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা গোলজারের স্ত্রী আরও বলেন, ছেলের যখন অসুখ হয়, তখন মুক্তিযোদ্ধা সনদের জন্য কত হাঁটাহাঁটি করলাম। কিন্তু হয়নি। সরকার কত মুক্তিযোদ্ধাকে কত রকম সুবিধা দিয়েছে। আমাদের ভাগ্যে কিছু জোটেনি। আমার স্বামী দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। কিন্তু তাকে স্বীকৃতি দিল না সরকার। শহীদ বীর সেনার স্ত্রী ফরিদাকে এখন দশ টাকার চালের কার্ড নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। কপালিয়া গ্রামের ১৫ মুক্তিসেনাকে গুলি করে হত্যার ঘটনা বর্ণনা করছিলেন শহীদ গোলজারের বড়ভাই বজলুর রহমান। তিনিও দেড় মাস দেশের জন্য লড়েছেন। তিনি বলেন, আমরা শতাধিক যুবক-মধ্যবয়সী মিলে স্থানীয়ভাবে কপালিয়া, মনোহরপুর, কুমারঘাটা ও চেঁচুড়িয়াসহ আশপাশে যুদ্ধ করেছি। আমাদের সঙ্গে উপরের যোগাযোগ ছিল না। অস্ত্রপাতিও ছিল কম। ওই সময় পাশের কাছারিবাড়ি রাজাকার ক্যাম্পের এয়াকুব, নিছার, মেহের ও শরিয়তউল্যারা আমাদের আত্মসমর্পণ করতে বলে। রাজাকাররা বলেছিল আমরা যদি তাদের কাছে ধরা দিই, তাহলে তারা আমাদের মারবে না। শরিয়তউল্যা আমাদের কোন ক্ষতি করবে না বলে মসজিদ ছুঁয়ে কসমও করেছিল। এদিকে আমরা দেখলাম অস্ত্রপাতিও আর নেই, যুদ্ধ চালানো সম্ভব না। তাই রাজাকারদের কাছে আমাদের ১২ জন আত্মসমর্পণ করে। বাকিরা অবশ্য রাজাকারদের বিশ্বাস করেনি। তাই সবাই সরে ছিলাম। তিনি বলেন, রাজাকারদের হাতে যারা ধরা দিয়েছিল তার মধ্যে আমার আপন ভাই গোলজার ও চাচাত ভাই ফজনুর ছিল। রাজাকাররা শুক্রবার দুপুরের দিকে তাদের ধরে কাছারিবাড়ি ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তিন দিন আটকে রেখে রাত ১২টার দিকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে কপালিয়া বাজারে এনে গুলি করে হত্যা করে। এর দুই একদিন পর তারা ফুটকলি, কালিদাস ও বনমালীকে গুলি করে হত্যা করে। এদের হত্যার তিনদিন পর দেশ স্বাধীন হয়। এক প্রশ্নের জবাবে বজলুর রহমান বলেন, মুজিব বেঁচে থাকতে একবার কোর্ট থেকে তালিকা চেয়েছিল। তখন কোর্টে গিয়ে তালিকা দিয়ে আসি। তাতে কাজ হয়নি বলে পরে আর যোগাযোগ করিনি। তাছাড়া আমাদের এই কপালিয়া এলাকাটি তখন ছিল দুর্গম। যাতায়াত ব্যবস্থা ভাল ছিল না। তাই বাড়ির কাজ ফেলে আর যোগাযোগ করা হয়নি। শুধু গোলজারের স্ত্রী ফরিদা নয়, একই পরিণতি হয়েছে শহীদ বাকি ১৪ মুক্তিযোদ্ধার বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানদের। এদের অনেকের সন্তান এখন অন্যের বাড়িতে কাজ করে। শহীদ সেনাদের স্বীকৃতি না মেলায় তাদের স্বজনরা হতাশ। Ñসাজেদ রহমান, যশোর থেকে
×