ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. শাহজাহান মণ্ডল

বঙ্গবন্ধু ও মানবাধিকার

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ১০ ডিসেম্বর ২০১৬

বঙ্গবন্ধু ও মানবাধিকার

‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু দেখেছি বঙ্গবন্ধুকে।’ সদ্য প্রয়াত কিউবান লিডার ফিদেল ক্যাস্ট্রোর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে মূল্যায়ন এটি। কেন এই প্রবাদসম মহামহীম মূল্যায়ন? কারণ আছে বৈকি। বাঙালী জাতি কোন্ ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অস্বীকার করবে? নাগরিক-রাজনৈতিক না-কি অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক? কোন ক্ষেত্রেই নয়। তেমনি এক মহান ক্ষেত্র মানবাধিকার। ১০ ডিসেম্বর বিশ^ মানবাধিকার দিবসে আমরা স্মরণ করছি বিশ^ মানবতাকে, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামী সকল মহামানবকে আর বাঙালীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মহানায়ক পথিকৃত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। জীবনটিই তাঁর পার হয়েছে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে। মানবাধিকার মানবের জন্ম থেকেই বিদ্যমান, সহজাত ও অহস্তান্তরযোগ্য অধিকার। অন্যান্য অধিকার সহজাত নয়, হস্তান্তর করা যায়। জন্মলাভ করার সঙ্গে সঙ্গে হাঁসের বাচ্চা সাঁতার কাটে। কে শেখায় তাকে সাঁতার কাটতে? কেউ না। এটি তার প্রকৃতিতে সহজাত। তেমনি মানবশিশু অটোমেটিক্যালি কী পারে? পারে কাঁদতে। এটি তার জন্য সহজাত। সে আবার তার এ কান্নার অধিকারটি অন্য কারও কাছে ট্রান্সফার করতে পারে না। কাজেই মানুষের কান্নার এই সহজাত ও অহস্তান্তরযোগ্য অধিকারই মানবাধিকার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব ও নির্দেশনায় প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে যে বাহাত্তরের সংবিধান আমরা পেয়েছি তাতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এই মানবাধিকার। পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ভার্জিনিয়ার অধিকার ঘোষণা, আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণা এবং সংবিধানে মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্তির পর ‘মানবাধিকার’ নামক একটি প্রত্যয় বিশ্বব্যাপী প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। ইংল্যান্ডে ১২১৫ সালের ম্যাগনা কার্টা, ১৬২৮ সালের পিটিশন অব রাইটস্, ১৬৮৯ সালের বিল অব্ রাইটস্, ১৭০১ সালের এ্যাক্ট অব সেটলমেন্ট এগুলো সবই মানুষের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার পথে একেকটি মহান সোপান। মূলত প্রথম মহাযুদ্ধের পর বিশ্বের বিভিন্ন সরকার ও রাষ্ট্র মানুষের মৌলিক মানবাধিকারসমূহকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং সংরক্ষণ-প্রতিশ্রুতি দেয়ার বিষয়ে দাবি তুলতে থাকে। ১৯২৮ সালে ঞযব ওহংঃরঃঁঃব ড়ভ ওহঃবৎহধঃরড়হধষ খধি নিউইয়র্ক অধিবেশনে ঘোষণা করেÑ“ঞযব লঁফরপরধষ পড়হংপরবহপব ড়ভ ঃযব পরারষরুবফ ড়িৎষফ ফবসধহফং ঃযব ৎবপড়মহরঃরড়হ ভড়ৎ ঃযব রহফরারফঁধষ ড়ভ ৎরমযঃং ঢ়ৎবংবৎাবফ ভৎড়স ধষষ রহভৎরহমবসবহঃ ড়হ ঃযব ঢ়ধৎঃ ড়ভ ঃযব ংঃধঃব.” উক্ত নিউইয়র্ক ঘোষণা আহ্বান জানিয়ে বলে, বিভিন্ন রাষ্ট্রের সংবিধানে মানুষের অধিকারসমূহ লিখিত হওয়া উচিত এবং তা শুধু ঐ বিশেষ রাষ্ট্রের নাগরিকের জন্য নয়, বরং ‘মানুষের’ জন্য প্রযোজ্য হওয়া উচিত। জাতিসংঘ সনদের ৬৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ (ঊঈঙঝঙঈ) ১৯৪৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ‘মানবাধিকার কমিশন’ গঠন করে। এ কমিশন মিসেস এলিয়েনর রুজভেল্টের নেতৃত্বে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার (ঞযব টহরাবৎংধষ উবপষধৎধঃরড়হ ড়ভ ঐঁসধহ জরমযঃং, টউঐজ) ড্রাফট তৈরি করে ঊঈঙঝঙঈ-এর মাধ্যমে সাধারণ পরিষদে জমা দেয়। অতঃপর ১০ ডিসেম্বর ১৯৪৮। সাধারণ পরিষদের তথা জাতিসংঘের সদস্য ছিল ৫৮টি রাষ্ট্র। উপস্থিত ছিল ৫৬টি। সর্বজনীন ঘোষণার (টউঐজ) পক্ষে ভোট দিয়েছিল ৪৮টি। বিপক্ষে কেউ ভোট দেয়নি। ৮টি রাষ্ট্র ভোটদানে বিরত ছিল, পুরো সোভিয়েত ব্লকের ৬টি, যথা বেলারুশিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, যুগোশ্লাভিয়া, পোল্যান্ড, ইউক্রেইন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং সৌদি আরব ও দক্ষিণ আফ্রিকা। টউঐজ-এর বিপক্ষে একটিও ভোট না পড়ায় সর্বসম্মতিক্রমে এই ঘোষণা সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয় ১০ ডিসেম্বর। সেই থেকে দিনটি বিশ্ব মানবাধিকার দিবসরূপে পালিত হয়। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণায় রয়েছে ২৫টি মানবাধিকার। ঘোষণার অধিকারসমূহ পাঠে এই প্রত্যয় জন্মে যে, টউঐজ প্রণীত ও গৃহীত হয়েছিল সানফ্রান্সিসকো সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের দেয়া এই বক্তব্যকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য : ‘ডব যধাব মড়ড়ফ ৎবধংড়হ ঃড় বীঢ়বপঃ ঃযব ভৎধসরহম ড়ভ ধহ রহঃবৎহধঃরড়হধষ নরষষ ড়ভ ৎরমযঃং, ধপপবঢ়ঃধনষব ঃড় ধষষ ঃযব হধঃরড়হং রহাড়ষাবফ... ঞযব (টঘ) ঈযধৎঃবৎ রং ফবফরপধঃবফ ঃড় ঃযব ধপযরবাবসবহঃ ধহফ ড়নংবৎাধহপব ড়ভ যঁসধহ ৎরমযঃং ধহফ ভঁফধসবহঃধষ ভৎববফড়সং. টহষবংং বি পধহ ধঃঃধরহ ঃযড়ংব ড়নলবপঃরাবং ভড়ৎ ধষষ সবহ ধহফ ড়িসবহ বাবৎুযিবৎব- রিঃযড়ঁঃ ৎবমধৎফ ঃড় ৎধপব, ষধহমঁধমব ড়ৎ ৎবষরমরড়হ- বি পধহহড়ঃ যধাব ঢ়বৎসধহবহঃ ঢ়বধপব ধহফ ংবপঁৎরঃু.’ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারপার্সন মিসেস এলিয়েনর রুজভেল্ট টউঐজ-কে পৃথিবীর সকল দেশের সকল মানুষের গধমহধ ঈধৎঃধ বলে আখ্যায়িত করেছেন। বিশ্বের অন্য যে কোন আন্তর্জাতিক দলিলের তুলনায় মানবাধিকার ঘোষণার প্রভাব গভীর এবং স্থায়ী। ১৯৪৮ সালে গৃহীত হওয়ার পর থেকে ঘোষণাটি সর্বকালের সার্বিক পরিচিত এবং প্রভাবশালী দলিলসমূহের একটিতে পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে বিশ্বব্যাপী এর ব্যাপক প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। টউঐজ গৃহীত হওয়ার পর স্বাধীনতাপ্রাপ্ত প্রায় প্রত্যেক রাষ্ট্রের সংবিধানে মানবাধিকারসমূহ বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মর্যাদা সহকারে স্থান পেয়েছে। কোন কোন রাষ্ট্রের সংবিধানে বিশেষভাবে উল্লিখিত না হলেও কিছুটা প্রতিফলন রয়েছে মানবাধিকার ঘোষণার। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করেন যে, বাঙালী যুগ-যুগান্তর হয়েছে নিপীড়িত-বঞ্চিত, সাতচল্লিশ থেকে একাত্তরের ২৫ মার্চ পর্যন্ত হয়েছে শোষিত-নিষ্পেষিত, যে বাঙালীর আওয়ামী লীগ সত্তরের নির্বাচনে জয়লাভ করার পরও ক্ষমতা পাওয়ার পরিবর্তে শিকার হয়েছে পৃথিবীর জঘন্যতম গণহত্যার তার মানবাধিকার সমুন্নত হওয়া উচিত, সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। কারণ, সংবিধান হলো রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। তিনি তৈরি করে দেন একটি সংবিধান প্রণয়ন কমিটি। এ কমিটির ড্রাফ্ট-সংবিধান পার্লামেন্টে গৃহীত হয় বাহাত্তরের ৪ নবেম্বর। বিতর্ক, সংযোজন-বিয়োজনের পর কার্যকর হয় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২। বাহাত্তরের সংবিধান সর্বজনীন ঘোষণার মানবাধিকারগুলোকে ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেছে। এ সংবিধানের পূর্বে গৃহীত হয় প্রথম সংবিধান ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’, যার ড্রাফ্ট তৈরি করেন প্রথিতযশা আইনজীবী ব্যারিস্টার এম. আমীর-উল ইসলাম এবং যা তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মুজিবনগরে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গৃহীত হয় (২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে কার্যকারিতাসহ)। এই প্রথম সংবিধানেও মানবাধিকারের উপস্থিতি ছিল ‘সমতা’, ‘মানব মর্যাদা’ ও ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’রূপে। এগুলোই বিস্তৃতরূপে বর্ণিত হয়েছে বাহাত্তরের সংবিধানে, ২য় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে, ৩য় ভাগে মৌলিক অধিকার হিসেবে। ২য় ভাগের মানবাধিকার হলো অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান প্রভৃতি লাভের অধিকার। বঙ্গবন্ধু যদি উক্ত সংবিধান প্রণয়ন কমিটি না করে দিতেন কিংবা কোন চক্রে বাহাত্তরে সংবিধান তৈরি না হতো তাহলে পাকিস্তানী প্রেতাত্মারা আর কখনও এ সংবিধান তৈরি হতে দিত কি-না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। সাতচল্লিশে ভারত-পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর ভারতের সংবিধান প্রণীত হয় ১৯৫০ সালে; কিন্তু পাকিস্তানের সংবিধান তৈরি হয় আরও ছয় বছর পর, ১৯৫৬ সালে। ভারতের সংবিধান এখনও কার্যকর, চলমান। কিন্তু পাকিস্তানেরটি মাত্র দু’বছরের মাথায় স্থগিত হয় ১৯৫৮ সালে। জারি হয় মার্শাল ’ল। অতঃপর বাষট্টিতে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান রচিত ‘বেসিক ডেমোক্রেসি’- সংবলিত সংবিধান, যা কেড়ে নেয় জনগণের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার। এরপর লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার ১৯৬৯-এর অধীনে সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে সত্তরের নির্বাচন এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টের ৩১৩ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের ১৬৭ আসন লাভ, পূর্ব-পাকিস্তানের প্রাদেশিক ৩০০ আসনের আওয়ামী লীগের ২৮২ আসন লাভ সত্ত্বেও আওয়ামী লীগকে তথা বাঙালীকে ক্ষমতা না দিয়ে, পার্লামেন্টের অধিবেশন না ডেকে, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নামে ১৫ মার্চ ১৯৭১ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত কৌশলী কালক্ষেপণ এবং ফাইনালি ২৬ মার্চ ভোররাত থেকে পাক-আর্মির অপারেশন সার্চ লাইট, বর্বরতম গণহত্যা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী চিন্তায় দ্রুততম সময়ে বাহাত্তরের সংবিধান। এ সংবিধান জাতিকে উপহার দেয়ার পরই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট পাকিস্তানী চক্রের হাতে বঙ্গবন্ধু নিহত হন। অতঃপর দুবার সামরিক শাসন মানেই পুরো সংবিধান (মূলনীতি-অধিকার ও মৌলিক অধিকারসহ) স্থগিতকরণ, পাঁচবার জরুরী অবস্থা মানেই আংশিক সংবিধান (মৌলিক অধিকার) স্থগিতকরণ, সেইসঙ্গে কয়েক দফা জেনারেল জিয়া-এরশাদের হাতে সংবিধান কর্তন, সর্বোপরি পাকিস্তানী চেতনা ভেতরে দিয়ে সেলাইকরণ। এদেশের বাঙালীর বড় ভাগ্য যে, ২০১১ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে যতটুকু সম্ভব পাকিস্তানী চেতনা বের করে ফেলে বাহাত্তরের সংবিধানে ফেরার চেষ্টা করা হয়েছে। বারংবার কাটা-ছেঁড়া সত্ত্বেও সংবিধানের ২য় ও ৩য় ভাগে এখনও অটুট মানবাধিকার, মূলনীতি-অধিকার, মৌলিক অধিকার। এ কারণে বলছি, বঙ্গবন্ধু সেদিন সংবিধান প্রণয়নের উদ্যোগ না নিলে ১৯৪৮-এর সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার মানবাধিকারগুলো বাংলাদেশের জনগণ কখনও পেত কি-না কে জানে। বঙ্গবন্ধু জনগণের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য শুধু রাজপথে সংগ্রাম করেই ক্ষান্ত হননি, নিপীড়িত-নির্যাতিত-শোষিত মানুষের বিবেকের প্রতিনিধি হিসেবে কেবল উচ্চকণ্ঠই হননি, মানুষকে হৃদয় দিয়ে শুধু ভালবেসেই যাননি, তাঁর আইন-শাস্ত্রের জ্ঞানকে বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগের মানসে প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন ও সর্বোচ্চ অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন মানবাধিকারকে। বঙ্গবন্ধু ও মানবাধিকার তাই অবিচ্ছেদ্য নাম। লেখক : অধ্যাপক, আইন বিভাগ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
×