ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ১০ ডিসেম্বর ২০১৬

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

কর্মজীবনের প্রথম অধ্যায় : দ্বিতীয় খ- পঞ্চম অধ্যায় পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুবের সাংবিধানিক একনায়কত্ব এবং আমার আমেরিকায় প্রথম ভ্রমণ (গতকালের পর) কিন্তু সেখানে আমাদের অবতরণ করতে প্রথমে দিল না। পরে শুধু বিমানপোতে নামতে দিল। আমরা সারাদিন ধরে উড়েছি বলে আমাদের খানাদানাও আর ঠিকমত হয়নি। তাইওয়ান কিন্তু বলে দিল যে, তারা আমাদের সেখানে থাকতে দিবে না। তারা আমাদের কিছু আনারস এবং বিস্কুট খাওয়াতে পারে। আমরা সেই আনারস এবং বিস্কুট খেলাম এবং আমাদের বিমান সেখানে তেল সংগ্রহ করলো। আমরা ঘন্টা দুয়েক পরে আবার উড়াল দিলাম। আমাদের লক্ষ্য স্থল হলো হংকং এবং টোকিও। যেখানে আমরা অবতরণ করার সুযোগ পাব সেখানেই আমরা নামবো। রাত প্রায় দু’টায় আমরা টোকিও পৌঁছলাম। প্যান আমেরিকান এয়ারলাইন্স আমাদের অতি দ্রুতগতিতে টোকিওতে হিলটন হোটেলে নিয়ে গেল এবং সেখানে এই ভোর রাতে হোটেল আমাদের গ্রহণ করার জন্য নানা ব্যবস্থা ইতোমধ্যেই সেরে ফেলেছে। তারা এই ভোরবেলা আমাদের জন্য নৈশভোজের আয়োজন করে। আমাদের ছোট মেয়েটির উপরে এই ভ্রমণটি ছিল একটি ছোটখাটো অত্যাচার। আমরা সামান্য কিছু আহার করে আমাদের জন্য নির্দিষ্ট স্যুটে চলে গেলাম। পরদিন সকালে উঠতে উঠতে প্রায় দশটা। নাস্তা করেই আমি খোঁজ নিতে থাকলাম যে, আমাদের ভ্রমণের কি হচ্ছে। প্যান এম আমাকে জানালো, পরবর্তী দিনে হয়তো অপরাহ্নে আমরা হংকং-এ যাব। আমি ঠিক করলাম, আমি আমার ভ্রমণসূচি পরিবর্তন করে টোকিও থেকে হংকং যাব এবং হংকং থেকে সরাসরি হনুলুলু যাব। সেই সব ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে দুপুরের খাবার শেষ করে আমি হোটেলের মাধ্যমে একজন দোভাষীসহ টোকিও ভ্রমণের জন্য একটি গাড়ি ভাড়া করলাম। টোকিওতে যে বিনা পয়সায় থাকছি সেই সুযোগ নিয়েই এই আরামপ্রদ ব্যবস্থাটি গ্রহণ করলাম। আমরা এক বিকাল এবং আর এক মধ্যদিন পর্যন্ত টোকিও চষে বেড়ালাম। তখন টোকিওতে এক বড় আকর্ষণ ছিল নির্মীয়মান অলিম্পিক স্টেডিয়াম। ১৯৬৪ সালে টোকিওতে এশিয়ায় সর্বপ্রথম অলিম্পিক খেলা অনুষ্ঠিত হবে। তারই প্রস্তুতি হিসেবে একটা পরিপূর্ণ অলিম্পিক গ্রাম এবং বিভিন্ন স্টেডিয়াম নির্মাণের কাজ চলছিল। টোকিও ভ্রমণ সে দিক দিয়ে খুবই আনন্দজনক ছিল। টোকিওতে ইম্পেরিয়েল ছিল একটা পুরনো নামকরা হোটেল এবং হোটেলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শপিং সেন্টারটি ছিল খুবই প্রসিদ্ধ। আমরা সেখানেও গেলাম। কারণ, আমার উদ্দেশ্য ছিল একটি জাপানি মেয়েদের জাতীয় পোশাক কিমোনো খরিদ করা। সেই পোশাকের ব্যবহার তেমন হয়নি কিন্তু এটা খুবই আকর্ষণীয়। ভ্রমণের ঝামেলায় আমার মেয়ে কিছুটা অসুস্থ হয়ে গেল। পরের দিন আমরা হংকং-এ পৌঁছলাম। হংকং-এ আমাদের থাকার ব্যবস্থা ছিল হেরিলেলার হোটেল। হেরিলেলা হংকং-এর একজন ধনী ভারতীয় ব্যবসায়ী ছিলেন। তার হোটেলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল তার বিরাট শপিং সেন্টার। হংকং-এ তখন আমাদের নামকরা সাংবাদিক সৈয়দ মোহাম্মদ আলী (খসরু ভাই) বসবাস করতেন। সম্ভবত তিনি হোটেলেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি আমাদেরকে বিশ্রাম করতে বললেন এবং বললেন যে, পরের দিন সকালে তিনি আমাদের হংকং দেখাতে নিয়ে যাবেন। সেই রাতেই আমার মেয়ের বেশ জ্বর হলো। তাই পরবর্তী সকালে আমরা আমাদের মেয়ের অসুখ নিয়েই চিন্তিত হয়ে পড়লাম। খসরু ভাই সমস্যার সমাধান করলেন। তিনি হোটেলের সঙ্গে আলোচনা করে একজন ডাক্তারের পরামর্শ নেবার ব্যবস্থা করলেন। ডাক্তার পরীক্ষা করে বললেন, মেয়েটির ঠান্ডা লেগেছে এবং আমরা খুব সাবধানে যেন তার সেবা করি। তিনি কিছু ওষুধপাতি দিয়ে গেলেন। আমরা এই অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে হংকং বেড়াতে বেরুলাম। হংকং মূলত দোকানপাটের শহর। আর শহরটি দু’ভাগে বিভক্ত। একটি হংকং আর একটি কওলুন এবং তারা দু’টি দ্বীপে অবস্থিত। তাদের সংযোগ তখন ছিল শুধুমাত্র নৌপথে, আমরা হংকং-এর যে অংশে হোটেলে ছিলাম সেখান থেকে কওলুন যেতে প্রায় ঘন্টাখানেক জাহাজ ও ট্যাক্সি চড়তে হলো। ওপারে একটা আকর্ষণীয় স্থান ছিল পিক নামে পরিচিত ব্রডকাস্টিং টাওয়ারের পাহাড় চূড়া। সেখান থেকে হংকংকে একটা চমৎকার শহর মনে হতো। সারাটি শহর শুধু দালানে ভরা এবং দালানগুলো সুউচ্চ না হলেও সর্বত্রই প্রায় ৪/৫ তলা। খসরু ভাই সারাদিন আমাদের সঙ্গে থাকলেন এবং সবসময়ই তিনি আমাদের মেয়ের অসুখ নিয়ে উৎকণ্ঠিত ছিলেন। তিনি আমার স্ত্রীকে উপদেশ দিলেন, বাজারে গিয়ে হকারদের কাছ থেকে কোন কিছু কিনতে খুব বেশি দরদাম করতে হবে। তবে ভাল এবং মূল্যবান কিছু কিনতে গেলে তিনি কয়েকটি দোকানের নাম বললেন যেখানে যাওয়া সঠিক হবে। সেখানে কোন দরদাম করতে হবে না। এ রকম একটি দোকান থেকে আমি আমার স্ত্রীর জন্য একটি মিকি মটো পার্লের সেট কিনলাম। আমাদের মেয়ের অসুখ মনে হলো বেড়ে গেছে। কিন্তু এর মধ্যে তার জন্য একটি খুব উৎফুল্লেরও ঘটনা ঘটলো। সে তার ক্রিবে (বেবী বিছানায়) ডান্ডা ধরে দাঁড়িয়ে গেল এবং কোন কিছুর উপর নির্ভর না করে কয়েক পা হাঁটলো। তার হাঁটা এই ভ্রমণকালেই শুরু হলো। হংকং-এ আমরা দু’দিন থাকলাম। তৃতীয় দিনে হনুলুলুর পথে পাড়ি দিলাম। মেয়েটির অসুখ নিয়ে খসরু ভাই সারাটি সময় খুবই বিচলিত থাকলেন। সবসময় দেখেছি যে, বাচ্চাদের অসুখ হলে তিনি খুবই বিচলিত হয়ে যান। হংকং থেকে হনুলুলু। ভয়ংকর লম্বা ভ্রমণ। আন্তর্জাতিক তারিখ রেখা অতিক্রম করে আমাদের ঘড়ির কাঁটা বদলাতে হলো। আমরা হনুলুলু যখন পৌঁছলাম তখন সেখানে সকাল প্রায় ১১টা এবং আমরা বেশ ক্ষুধার্ত। আমার মনে হয় আমাদের হোটেলটির নাম ছিল আইলেন্ডার্স হোটেল এবং এটা মোটামুটি একটি এ্যাপার্টমেন্ট হোটেল ছিল। আমরা ঠিক করলাম, কাছাকাছি একটি রেস্তরাঁয় গিয়ে দুপুরের খাবার খাব। আমরা দু’জনের জন্য খাবারের অর্ডার দিলাম। জানতাম যে, মার্কিনীরা সব কিছুতেই বেশি বেশি করে। কিন্তু খাবারের বহর দেখে বিস্ময়ের আর সীমা নেই। আমাদের প্রশ্ন হলো যে, তারা কী আমাদের রাক্ষস ভেবেছে! আমি প্রশ্ন করায় উত্তর হলো যে, যতটুকু খেতে পার ততটুকু খাও, বাকিটা আমরা ব্রাউন ব্যাগে দিয়ে দেব। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ সুস্বাদু ফলের জন্য বিখ্যাত। চলবে...
×