ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

ম্যাডাম সুচি, প্লিজ, সম্মানটুকু নষ্ট হতে দেবেন না

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ১০ ডিসেম্বর ২০১৬

ম্যাডাম সুচি, প্লিজ, সম্মানটুকু নষ্ট হতে দেবেন না

ম্যাডাম আউং সান সুচি, কিছুকাল যাবত আরাকানী রোহিঙ্গা বা রাখাইন মুসলিম নর-নারী শিশুদের ওপর আপনার দেশ মিয়ানমারের মিলিটারি জান্তা যেভাবে অত্যাচার-নির্যাতন চালাচ্ছে তাতে আপনার নীরবতা আমাদের দারুণভাবে বিস্মিত করেছে, আহত করছে। ম্যাডাম, আমরা ভিনদেশী হলেও আপনি আমাদের নিখাঁদ সম্মানের পাত্রী। কোন অমূলক বিশ্বাস থেকে নয়, আপনি গণতন্ত্রের মানসকন্যা, সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার এবং মৌলিক-মানবাধিকার প্রশ্নে চ্যাম্পিয়ন বলেই সাদা চামড়ার পশ্চিমারা আপনার নোবেল শান্তি পুরস্কার ঠেকাতে পারেনি। আপনার এই অর্জনে কেবল মিয়ানমার নয়, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম (প্রতিবেশী) দেশ বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা খুশি হয়েছি। কেন খুশি হয়েছি তা ব্যাখ্যা করার আগে আপনার শুভ চেতনার কাছে আমাদের আকুল আহ্বান : নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের বাঁচান, তাদের নারীদের ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা করুন। আপনার দেশে কেউ ধর্ষিতা হওয়ার অর্থ আপনিও কি কম রাজনৈতিক নির্যাতনের (চড়ষরঃরপধষ ৎধঢ়ব) শিকার হচ্ছেন? একটি কাগজে দেখলাম, রোহিঙ্গা ইস্যুতে গঠিত তদন্ত কমিটির সভাপতি একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা। মিলিটারি জান্তাদের অতীত অভিজ্ঞতার শিকার আপনি। তারপরও আপনার হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা থাকার পরও কোন মিলিটারি সে সাবেক হোক বা বর্তমান, তাকে তদন্ত কর্মকর্তা বানানো যে ঠিক হয়নি তা তারই একটি মন্তব্য থেকে পরিষ্কার। রোহিঙ্গা নারীদের ওপর গণধর্ষণ সম্পর্কে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি নাকি বলেছেন, ‘আমাদের সৈন্যরা এ কাজ করতে পারে না। অসম্ভব। কারণ, রোহিঙ্গা মুসলিম নারীরা নোংরা।’ মনুষ্যরূপী দ্বিপদ কোন প্রাণী কি এমন মন্তব্য করতে পারে? বরং এই একটি মন্তব্য করে ওই ব্যক্তি গোটা বর্মি জনগোষ্ঠীকে ‘নোংরা’ করলেন! সবচেয়ে অবাক লাগছে, বৌদ্ধ ভিক্ষুরাই মিলিটারিদের সঙ্গে মিলে সেখানে রোহিঙ্গা নিধনে নেমেছে। ॥ দুই ॥ ম্যাডাম, তাহলে কি আপনার ওপর দায় চাপছে না? আমাদের পরামর্শ হলো, এই দায়মুক্তির জন্য আপনারই উচিত হবে এথনিক ক্লিনজিং বন্ধ করা। একটি জনগোষ্ঠী, সে যত ছোটই হোক, মানবাধিকারের নেত্রী হিসেবে আপনার দায়িত্ব তাদের নিরাপত্তা প্রদান। এটাকে জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী জেনোসাইড বা গণহত্যা বলা যাবে। জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় বা কোন জাতি বা কোন নৃ-গোষ্ঠীকে নিধন করার অভিপ্রায়ে হামলা পরিচালনার নামই ‘গণহত্যা’ বা ‘জেনোসাইড’। রোহিঙ্গাদের ওপর এখন যা চলছে তাকে এ ছাড়া আর কি বলা যাবে? আপনার শান্তিতে নোবেল অর্জনের সঙ্গে এর দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হচ্ছে না? ॥ তিন ॥ আপনাকে এসব প্রশ্ন করছি এ জন্য যে, ১৯৮৯ সালে যখন আপনি নির্বাচনে জিতেও গৃহবন্দী হলেন তখন সম্ভবত বাংলাদেশ থেকে আমিই প্রথম সাংবাদিক আপনার ওপর রিপোর্ট করেছিলাম তখনকার সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক ইত্তেফাকে। আমি তখন ইত্তেফাকে কাজ করছি। একদিন অফিসে টেলিপ্রিন্টারে দেখি আপনার অন্তরীণ হওয়ার কথা। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি আপনার পিতা বার্মার জাতির পিতা জেনারেল আউং সান মিলিটারি জান্তার হাতে নিহত হয়েছিলেন। ক্ষমতা তাদের হাতে চলে যাবার পর দীর্ঘদিন আপনি প্রবাসে কাটিয়েছিলেন। দেশে ফিরে এনএলডি বা ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক লীগ নামে দল করে আন্দোলনে নামেন। আপনার আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা এবং নির্বাচন এলে তাদেরই বেশি নমিনেশন দিয়েছিলেন এবং এতদিন পর যদি ভুল না করে থাকি তাহলে বলব নির্বাচনে আপনার দল ৪০৪ আসনের পার্লামেন্টে ৪০০ আসনে জয়লাভ করেছিল। তারপরও আপনাকে অন্তরীণ করেছিল মিলিটারি জান্তা। সেই সঙ্গে আপনার দলের কেন্দ্রীয় নেতাদেরও জেলে পাঠায়। বিষয়টি আমাকে অবাক করে। আমি ইত্তেফাকে এ নিয়ে রিপোর্ট করি; যা সেদিনের এরশাদবিরোধী আন্দোলনের প্রধান নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। দু’জনের জীবনের একটা অদ্ভুত মিল রয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর পিতা অর্থাৎ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও মিলিটারির হাতে নিহত হন আপনার পিতার মতো। এবং সেই হত্যাকা-ের সময় আপনি এবং আমাদের প্রধানমন্ত্রী দু’জনই বিদেশে অবস্থান করায় বেঁচে যান। শেখ হাসিনা তাই সেদিন আপনার মুক্তি চেয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন, যা ইত্তেফাকসহ তখনকার কাগজে ছাপা হয়। ॥ চার ॥ ম্যাডাম সুচি, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা ইস্যুতে কি বলছেন আপনার জানা দরকার। বুধবার (ডিসে ঃ ০৭) পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আমরা যেমন সীমান্ত অরক্ষিত রাখতে পারি না এবং স্রোতের মতো ভিন্ন দেশের নাগরিকদের (অবশ্য মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়নি) আমাদের দেশে ঢুকতে দিতে পারি না, তেমনি নির্যাতিত রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশুদের প্রতিও সমমর্তিতা রয়েছে। আমরা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি দেখছি এবং তাদের সাহায্য-সহযোগিতা দিচ্ছি।’ বিবিসির সংবাদ প্রবাহে বলা হয়েছে বিগত কয়েক দিনে ২১ হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এর আগে বিগত বছরগুলোতে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম কক্সবাজার অঞ্চলে রিফুজি হিসেবে আছে। তারা যেমন আমাদের সমাজে মিশে গেছে তেমনি মাদক চোরাচালানসহ নানান অসামাজিক এবং বেআইনী কাজে জড়িয়ে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একই সঙ্গে এও বলেছেন, ‘কেন হঠাৎ করে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের পুলিশ-আর্মি এত নিষ্ঠুর হলো তাও দেখতে হবে। কিছু রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী মিয়ানমান বর্ডার গার্ডের ফাঁড়ি আক্রমণ করে ৯ বর্ডার গার্ডকে হত্যা করে এবং অপর কয়েকটি ফাঁড়িও আক্রমণ করে। এরপরই সে দেশের পুলিশ-মিলিটারি নির্যাতন শুরু করে এবং নির্যাতিতরা বাংলাদেশে আসতে শুরু করে। আমাদের সুস্পষ্ট নীতি হচ্ছে, বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করে কাউকে অন্যদেশে আক্রমণ চালাতে আমরা দেব না। কারা ৯ মিয়ানমার বর্ডার গার্ডকে হত্যা করল আমাদের বর্ডার গার্ড ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তদন্ত করছে। তাদের চিহ্নিত করে আমরা মিয়ানমারের হাতে তুলে দেব। কতিপয় সন্ত্রাসীর জন্য একটি জনগোষ্ঠীকে সাফার করতে দেয়া হবে না। ॥ পাঁচ ॥ এখানে একটা ব্যাপার আলোচনা করা দরকার। মিয়ানমারের এই রোহিঙ্গারা মুসলমান। মধ্যযুগের আরাকান রাজ্যের বাসিন্দা। তৎকালীন আরাকান রাজসভাটি ছিল বাংলা সাহিত্যচর্চার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। মধ্যযুগের বিখ্যাত মহাকাব্য আলাউল-এর ‘পদ্মবতী’সহ ‘ইউসুফ-জুলেখা’ ‘লাইলী-মজনু’ প্রভৃতি সাড়া জাগানো কাব্যগ্রন্থ বিভিন্ন সময়ে আরাকান রাজসভার কবিরাই রচনা করেছেন। সেসব কাব্য বাংলা সাহিত্যের ভা-ারকে সমৃদ্ধ করেছে এবং আজও একইভাবে সমাদৃত। আরাকান রাজ্য মিয়ানমার দখল করে নিয়েছে। আরাকানী মুসলমানদের নাগরিকত্বও দেয়নি। রোহিঙ্গারা মুসলমান বলে আমাদের দেশে জামায়াতসহ ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নানানভাবে ব্যবহার করছে? তাদের অসহায়ত্বের সুযোগে তাদের দিয়ে নাশকতা চালিয়ে আসছিল। অস্ত্র-ড্রাগ চোরাচালানে তাদের ব্যবহার করছিল। বর্তমান শেখ হাসিনার সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে সেখানে জামায়াতী তৎপরতা কমেছে। তারা একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়নি। জামায়াতীরাই প্রচুর অর্থ ঢেলে রোহিঙ্গা রিফুজিদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বা আইডি কার্ড যোগাড় করে দিচ্ছে। এভাবে রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে না ফিরিয়ে দিয়ে আমাদের দেশে রিফুজি হয়ে থাকতে উৎসাহিত করছে। ॥ ছয় ॥ ম্যাডাম সুচি, আমরা জানি সম্প্রতি জাতিসংঘ সম্মেলনে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আপনার সাক্ষাত হয়েছে। যতদূর শুনেছি আপনারা দু’জন ওয়ান-টু-ওয়ান আলাপ করেছেন। আগেই বলেছি আপনারা দু’জনই দুই দেশের জাতির পিতার কন্যা এবং দু’জনই স্ব-স্ব দেশের ক্ষমতায় আছেন। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করেছি, যদিও মামলা করতে হয়েছিল। আপনারা দু’জন উদ্যোগ নিলে অথবা বৈঠকে বসলে এ সমস্যারও সমাধান হয়ে যাবে। ঢাকা : ৮ ডিসেম্বর ২০১৬ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব
×